সূরা কাহাফ; আয়াত ৬২-৬৬

সূরা কাহাফ; আয়াত ৬২-৬৬

সূরা কাহাফ; আয়াত ৬২-৬৬


সূরা কাহাফের ৬২ ও ৬৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَلَمَّا جَاوَزَا قَالَ لِفَتَاهُ آَتِنَا غَدَاءَنَا لَقَدْ لَقِينَا مِنْ سَفَرِنَا هَذَا نَصَبًا (62) قَالَ أَرَأَيْتَ إِذْ أَوَيْنَا إِلَى الصَّخْرَةِ فَإِنِّي نَسِيتُ الْحُوتَ وَمَا أَنْسَانِيهُ إِلَّا الشَّيْطَانُ أَنْ أَذْكُرَهُ وَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ عَجَبًا (63)
“এরপর যখন তারা (সাগর তীরের) সে স্থান অতিক্রম করে গেল, মুসা তার যুবক সঙ্গীকে বলল, এবার আমাদের প্রাতঃরাশ আন, আমরা এ সফরে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।” (১৮:৬২)
“সে (যুবক) বলল, আপনি কি এটা লক্ষ্য করেছেন, যখন আমরা পাথরের কাছে বিশ্রাম করছিলাম,তখন আমি মাছটির (পানিতে চলে যাওয়ার ঘটনা বলতে) কথা ভুলে গেছি; শয়তানই সেটার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল এবং মাছটি বিস্ময়করভাবে সাগরে সেটার পথ ধরেছে।” (১৮:৬৩)

আগের পর্বে বলা হয়েছে, হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে খিজির (আ.) সম্পর্কে জানতে পারেন। তাঁর নিজের চেয়েও জ্ঞানী এই ব্যক্তির কাছে যাওয়ার আবেদন জানালে আল্লাহ মুসা (আ.)-কে একটি মাছের মাধ্যমে পথ-নির্দেশনা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এই নির্দেশনা অনুযায়ী শহর থেকে বেরিয়ে সাগরের তীরে পৌঁছার পর মুসা (আ.) একটি পাথরের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন বিশ্রাম নেয়ার জন্য। কিন্তু তার সঙ্গী জেগে ছিলেন। ইউশা দেখেন যে মাছটি চলতে শুরু করেছে ও সাগরে ঝাঁপ দিয়েছে। কিন্তু মুসা (আ.) ঘুমে থাকায় তিনি তাকে এ বিষয়টি জানাননি। মুসা (আ.) ঘুম থেকে জাগার পর ইউশা মাছটির ঘটনা তাঁর সঙ্গীকে বলতে ভুলে যান। ফলে তারা পথ চলতে থাকেন। এক সময় মুসা (আ.) ক্ষুধা অনুভব করলে ইউশা মাছের ঘটনাটি তাঁকে বলেন। ফলে তাঁরা ঠিক যেখানে মাছটি সাগরে লাফিয়ে পড়েছিল সেই স্থানটিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এ আয়াতে বলা হচ্ছে, সাগর-তীর থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মাছটি খাওয়ার চিন্তা মাথায় এলে মুসা (আ.)'র সঙ্গী মাছটি চলে যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন।

মুসা (আ.) তাঁর জীবনে কয়েকটি দীর্ঘ সফরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। এইসব সফর ছিল বেশ কষ্টকর ও সমস্যা-সংকুল। প্রথম সফরে তিনি ফেরাউন ও তার দল-বলের নাগাল থেকে পালিয়ে হযরত শোয়াইব (আ.)'র কাছে পৌঁছেন। এখানে তিনি এই নবীর কন্যাকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় দীর্ঘ সফরটি ছিল মিশরে তাঁর ফিরে আসা। এ সময় তিনি নবুওত লাভ করেছিলেন। তৃতীয় সফরে তিনি তুর পর্বতে গিয়েছিলেন খোদায়ী ধর্মগ্রন্থ তৌরাত আনতে। আর এই সর্বশেষ সফর ছিল তার চতুর্থ সফর। এ সফরও তার জন্য নানা প্রশ্ন ও সমস্যা সৃষ্টি করেছিল।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার :
১. জ্ঞান অর্জনের জন্য এবং এ লক্ষে আলেম বা জ্ঞানীদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নবী-রাসূলগণও অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন।
২. মানুষের জ্ঞান অর্জন ও উন্নতির পথে মানব ও জিন জাতির শয়তানরা নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করে।

সূরা কাহাফের ৬৪ ও ৬৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ ذَلِكَ مَا كُنَّا نَبْغِ فَارْتَدَّا عَلَى آَثَارِهِمَا قَصَصًا (64) فَوَجَدَا عَبْدًا مِنْ عِبَادِنَا آَتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِنْ لَدُنَّا عِلْمًا (65)
“সে (মুসা) বলল, সেটাই তো সেই স্থান যার অনুসন্ধানে আমরা ছিলাম। অতঃপর তারা উভয়ে নিজেদের পদচিহ্ন লক্ষ্য করে পশ্চাদগমন করল।” (১৮:৬৪)
“এবং আমাদের বান্দাদের মধ্যে একজনের সাক্ষাৎ পেল যাকে আমি আমার পক্ষ হতে আমার (অশেষ) অনুগ্রহের একটি অংশ দান করেছিলাম এবং আমার বিশেষ জ্ঞান থেকে কিছু শিক্ষা দিয়েছিলাম। (১৮:৬৫)

এভাবে হযরত মুসা (আ.) যখন মাছের ঘটনাটি জানলেন তখন আবারও সেই সঙ্গীকে নিয়ে সাগরের তীরের ওই নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে আসেন। তিনি সেখানেই হযরত খিজির (আ.)'র সাক্ষাত পান। মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে হযরত খিজির (আ.) খোদায়ী জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কিছু অংশ লাভ করেছিলেন।

হযরত খিজির (আ.) নবী ছিলেন কিনা তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে নানা যুক্তির আলোকে তাঁকেও নবী বলা যায়। কারণ, হযরত মুসা (আ.)'র মত অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের নবীর শিক্ষকও অবশ্যই নবী হয়ে থাকবেন যাতে তাঁর কথা ও আচরণ এই মহান নবীর কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়। এক্ষেত্রে আরেকটি যুক্তি হল, কুরআনে নবী-রাসূলগণকে সাধারণত 'আবদ' বা দাস হিসেবে উল্লেখ করা হয় যা খিজির (আ.)'র ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি বা প্রমাণ হল, তিনি আল্লাহর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন বলে কুরআনের এই অংশে উল্লেখ করা হয়েছে যা কেবল নবী-রাসূলগণেরই বৈশিষ্ট্য।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. কোনো কোনো জ্ঞান অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বা বুদ্ধি খাটিয়ে অর্জন করা যায় না। সেইসব জ্ঞান কেবল আল্লাহর জ্ঞান থেকেই অর্জন করা, যেমন, নবী-রাসূলগণের জ্ঞান।
২. ধর্মের জ্ঞান কেবল এমন মানুষের কাছ থেকেই শেখা উচিত যারা আল্লাহর অনুগত বান্দা বা দাস এবং মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়তা করেন।
৩. মানুষের মধ্যে এমন অনেক অপরিচিত বা অজ্ঞাত জ্ঞানী রয়েছেন যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আমাদের উচিত তাঁদের খুঁজে বের করা এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ হওয়া।

সূরা কাহাফের ৬৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَ لَهُ مُوسَى هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا (66)
“মূসা তাঁকে (খিজির -আ.) বলল, আমি কি আপনার অনুসরণ করতে পারি যাতে আপনি আমাকে সেই জ্ঞান থেকে কিছু শিক্ষাদান করেন যাতে আমি পূর্ণতা ও প্রবৃদ্ধি অর্জন করি, যা সত্যপথের জ্ঞানস্বরূপ আপনাকে দেয়া হয়েছে?” (১৮:৬৬)

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট, হযরত মুসা (আ.) যে জন্য সফরের কষ্ট সহ্য করেছিলেন তার লক্ষ্য ছিল আরো জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা হাসিল করা যাতে পূর্ণতা ও প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়। তাই হযরত খিজির (আ.)'র সঙ্গে সাক্ষাত লাভের পরপরই তিনি তাঁকে এই উদ্দেশ্যের কথা জানান। অর্থাত তিনি তাঁর ছাত্র হতে চাইলেন এবং শিক্ষকের প্রতি ছাত্ররা যে রকম সম্মান দেখিয়ে থাকে তিনিও হযরত খিজির (আ.)'র প্রতি সেরকম সম্মান দেখালেন। এ ছাড়াও হযরত খিজির (আ.)'র প্রতি মুসা (আ.)'র বিনয় ও নম্রতা ছিল তাঁর নবুওতি চরিত্রেরই বৈশিষ্ট্য। একজন অতি উচ্চ পর্যায়ের নবী, ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও খোদায়ী গুপ্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য তিনি ছাত্র হতে এবং কষ্ট স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হননি। তিনি এমন জ্ঞান অর্জন করতে চেয়েছিলেন যে জ্ঞান মানুষকে উন্নত করে ও পূর্ণতার পানে এগিয়ে নেয় এবং সেই জ্ঞানের পেছনে তিনি ছোটেননি যা মানুষের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. জ্ঞান ও পূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে নবী-রাসূলদের অবস্থানের মধ্যে তারতম্য রয়েছে। তাদের অনেকের অবস্থান অন্যদের চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের। কিন্তু সব নবী-রাসূলের জ্ঞানও সীমিত এবং তাঁদের জ্ঞানের পরিধি পরিবর্ধনযোগ্য।
দুই. পূর্ণতা ও প্রবৃদ্ধি অর্জন বা আত্ম-বিকাশের জন্য জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা অর্জন জরুরি।
তিন. শিক্ষার্থীকে অবশ্যই শিক্ষকের মোকাবেলায় বিনয়ী হতে হবে যাতে অর্জিত জ্ঞান তার জন্য পূর্ণতা ও বিকাশের মাধ্যম হয়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন