নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৯তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৯তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৯তম পর্ব

বিশ্বের সমস্ত মুসলমান এ ব্যাপারে একমত যে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং ইসলামী বিধান বা শরিয়ত খোদায়ী ধর্মগুলোর মধ্যে পরিপূর্ণতম৷ রাসূল (সাঃ) যে সর্বশেষ নবী এ বিশ্বাস ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিশ্বাসগুলোর মধ্যে অন্যতম৷ এই বিশ্বাসের সপক্ষে পবিত্র কোরআন ও হাদীসে অনেক স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ রয়েছে৷ এ ছাড়াও ইসলামী বিধি-বিধানের প্রকৃতি থেকেও ইসলামী বিধানের স্থায়ীত্ব ও সার্বজনীনতা স্পষ্ট৷ (বাজনা) পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পর আর কোনো নবী আসবেন না৷সূরা আহযাবের ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যকার কোনো পুরুষের পিতা নয়, কিন্তু তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী৷ আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে অবহিত৷
অন্যদিকে পবিত্র কোরআনের আয়াতে ইসলামকে চিরন্তন ও সর্বজনীন ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷ ইসলামের বিধানও কোনো স্থান বা সময়সীমার গন্ডীতে সিমীত নয়৷ যেমন, সূরা ফোরক্বানের এক নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, কত মহান তিনি যিনি তাঁর দাসের প্রতি ফোরকান (কোরআন) নাজিল করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হতে পারে৷
মহান আল্লাহ নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন মানুষকে শির্ক বা অংশীবাদিতা থেকে একত্ববাদ এবং অজ্ঞতা থেকে বুদ্ধিবৃত্তি ও কল্যাণকর বা সৌভাগ্যময় জীবনের দিকে আহবান জানাতে৷ যুগে যুগে মানুষের চাহিদার পরিবর্তন ঘটায় ধর্ম-বিধান পরিবর্তিত হয়েছে এবং প্রত্যেক যুগেই মানব জাতির জন্যে নতুন বাণীর প্রয়োজন হয়েছিল৷ অতীতে আসমানী ধর্মগ্রন্থগুলোর বাণী ও শিক্ষা বিকৃত হতো বলেও যুগে যুগে নতুন নবী-রাসূল পাঠাতে হয়েছিল৷ কিন্তু মানবজাতি যখন বিকাশের এমন এক পর্যায়ে উপনীত হল যখন সে খোদায়ী ধর্মের শিক্ষা ও নীতিগুলোকে সংরক্ষণ করতে শিখেছে তথা বিকৃতি ও পরিবর্তনের হাত থেকে সেগুলোকে মুক্ত রাখবার মত সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং সেগুলো খাঁটি, অবিকৃত অবস্থায় প্রচার করতে সক্ষম তখন অতীতের মতো নতুন নবী পাঠানোর প্রয়োজন আর থাকে না৷
পরিপূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে মানব জাতিকে এমন এক কাফেলার সাথে তুলনা করা যায় যে কাফেলা তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে রওনা দিয়েছে, কিন্তু ঐ লক্ষ্যে পৌঁছার পথ তারা ভালোভাবে চিনে না৷ পথে কারো সাথে দেখা হলে তার কাছ থেকে পথ নির্দেশনা নিয়ে কাফেলা কিছুটা পথ অগ্রসর হয়৷ এরপর নতুন ও অপরিচিত স্থানে পৌঁছার পর নতুন পথ প্রদর্শক ও নতুন দিক নির্দেশনা তার জন্যে জরুরী হয়ে যায়৷ এভাবে ধীরে ধীরে ঐ কাফেলা ব্যাপকতর অভিজ্ঞতা ও উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তাকে পুরো পথের মানচিত্র দেয়া হয়৷ আর এই সামগ্রীক মানচিত্র ও পথনির্দেশনা পাবার পর তাদের কাছে ভবিষ্যতের পথও স্পষ্ট হয়ে যায়৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)ও মহান আল্লাহর সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে মানব কাফেলার কাছে সামগ্রীক পথ নির্দেশনা ও সামগ্রীক সৌভাগ্যের পথ তথা ইসলাম ধর্ম উপহার দিয়ে গেছেন৷ আর এ সময় মানব জাতি চিন্তাগত দিক থেকে এই মহান ধর্মের সত্যতা উপলব্ধি কর এবং এ ধর্মের শিক্ষাগুলো রক্ষার মতো পরিপক্কতা অর্জন করেছিল৷
মানুষ চিন্তাগত ও সামাজিক দিক থেকে পরিপক্কতা অর্জন করতে পেরেছে বলেই পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও কোরআন বিকৃতি বা পরিবর্তনের শিকার হয় নি৷ এটাও লক্ষ্যনীয় যে ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মই সর্বশেষ খোদায়ী ধর্ম হবার দাবী করেনি৷ অতীতের সমস্ত নবী তাঁর পরবর্তী নবীর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে যেতেন৷ যেমন হযরত আদম (আঃ) হযরত নূহ (আঃ) ও অন্যান্য আগমন ঘটার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন৷ হযরত নূহ (আঃ) ও পরবর্তী নবীগণ তাঁদের পরে হযরত মূসা, হযরত ঈসা ও মুহাম্মাদ (সাঃ)'র আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন৷ কিন্তু পবিত্র কোরআন এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র ঘোষণা থেকে স্পষ্ট যে তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না৷
খতমে নবুওত অর্থ ধর্মের সমাপ্তি নয়৷ বরং এ থেকে বোঝা যায় ধর্মের বাস্তবতা অতীতের চেয়েও বেশী স্পষ্ট৷ বর্তমান যুগে মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে এমন ধর্ম তথা ইসলাম ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অতীতের চেয়েও বেশী অনুভূত হচেছ৷ প্রশ্ন হলো নবুওত তো শেষ হয়ে গেছে, তাহলে মানুষকে কারা পথ দেখাবেন? এর উত্তর হলো, পবিত্র কোরআন অবিকৃত রয়ে গেছে এবং পবিত্র কোরআন ও হাদীস থেকে যুগোপযোগী ব্যাখ্য বা বিধান দিতে সক্ষম আলেমরাই মানুষকে পথ দেখানোর দায়িত্ব পালন করবেন৷
এখানে এটাও মনে রাখা দরকার খোদায়ী ধর্মগুলোর মূল নীতিতে কখনও কোন পার্থক্য ছিল না যেরকম পার্থক্য নেই প্রাকৃতিক আইনে৷ যেমন, মাধ্যাকর্ষণ বা দিন ও রাতের পরিবর্তনের বিধান যেমন চিরকালই অপরিবর্তনীয়, তেমনি ন্যায়বিচারকামীতা, মানবপ্রেম বা পরোপকার, সততা- এগুলো সবযুগেই প্রশংসিত হয়ে আসছে৷ তদ্রুপ মিথ্যাচার, দূর্নীতি, ব্যাভিচার, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা ও অন্যের অধিকার লংঘন করা সব যুগেই মানুষের কাছে নিন্দনীয়৷ মোটকথা ইসলামের মৌলিক বিধানগুলো অপরিবর্তনীয় ও সার্বজনীন এবং সেগুলো স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে সব যুগেই প্রযোজ্য৷ সময় ও যুগের পরিবর্তনের ফলে যেসব নতুন চাহিদা সৃষ্টি হয় ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ আলেমগণ পবিত্র কোরআন ও হাদীস থেকে সেসবের জন্যে ব্যাখ্যা বা নতুন বিধান দিতে সক্ষম৷ আর এ জন্যেই বলা হয়েছে, আলেমরা নবী-রাসূলের উত্তরাধিকারী৷ পবিত্র কোরআনে মানব জীবনের সমস্ত দিকের ও নতুন যুগের চাহিদার যোগান রয়েছে৷ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,আমরা তোমার ওপর এ কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে রয়েছে প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা ও পথ নির্দেশ৷
এভাবে এটা স্পষ্ট বিশ্বনবী (সাঃ)'র ধর্ম ও পবিত্র কোরআন মানুষের জ্ঞানগত ও চিন্তাগত পরিপূর্ণতা সৃষ্টির মাধ্যম৷ এ কারণেই ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং চিন্তা ও গবেষণার ওপর অসীম গুরুত্ব দিয়েছে৷ বিশ্বনবী (সাঃ) শুধু কথা নয় কাজের মাধ্যমেও শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার ওপর অশেষ গুরুত্ব দিয়ে গেছেন৷ জ্ঞানার্জন সংক্রান্ত তাঁর বাণীগুলো জগত-বিখ্যাত৷ যেমন, তিনি বলেছেন, জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্যে ফরজ; জ্ঞান মুমিনের হারানো ধন, যেখানে পাও তা কুড়িয়ে নাও; জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম; জ্ঞান অর্জনের জন্যে প্রয়োজনে চীন দেশে যাও৷ জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কিত রাসূল(সাঃ)'র জীবনের একটি ঘটনা শুনিয়ে আজকের এই আলোচনা শেষ করবো৷
একদিন বিশ্বনবী (সাঃ) মসজিদে ঢুকে মসজিদের লোকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন৷ তিনি দেখলেন, একদল মুসলমান দোয়া, মোনাজাত এবং মহান আল্লাহর পবিত্র নামগুলোর যিকির আযকারে মশগুল এবং অন্য দলটি শিক্ষাদান, আলাপ আলোচনা ও পড়াশোনায় মগ্ন৷ রাসূল (সাঃ) উভয় গ্রুপের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ উভয় দলই কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে নিয়োজিত, কিন্তু আমি জ্ঞানের আলোচনায় নিয়োজিত দলটিকে বেশী পছন্দ করি৷ এই বলে জ্ঞানী ও গুণীদের দিশারী বিশ্বনবী (সাঃ) জ্ঞান সংক্রান্ত আলোচকদের দলেই যোগ দিলেন যাতে সবাই এটা বুঝতে পারেন যে মহান আল্লাহর কাছে ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) কাছে তথা ইসলাম ধর্মে জ্ঞান চর্চা কত বেশী গুরুত্বপূর্ণ!
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন