নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৭ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৭ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৭ তম পর্ব


যে-কোনো সমাজেই যুবকদেরকে মনে করা হয় উন্নতি ও অগ্রগতির সোপান এবং অনুপ্রেরণার মূলশক্তি ৷ শিল্প কল-কারখানা ও উত্পাগদনের চাকা তাদের হাতেই ঘোরে৷ সংকট মোকাবেলায় গঠনমূলক প্রচেষ্টা চালানো তাদেরই কাজ ৷ আজ আমরা দেখবো যুবকদের ব্যাপারে নবীজীর দৃষ্টিভঙ্গি কী এবং নবীজীবনে যুবকদের সাথে তাঁর আচার-ব্যবহার কেমন ছিল ৷
ইসলামের মহান নবী যুবকদেরকে মনে করতেন একটা সমাজের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পুঁজি ৷ তাদেরকে তিনি ভীষণ সম্মান করতেন ৷ এই সম্মানের ফলে বহু যুবক রাসূলের প্রতি ঝুঁকেছিল ৷ যুবকদের সহযোগিতা আর নবীজীর মেধাবি নেতৃত্বের সুবাদে ইসলাম ব্যাপক উন্নতি লাভ করে ৷ নবীজী বলেছেন-'আমি যখন ইসলামের দাওয়াতী কাজ শুরু করলাম,তখন যারা আমার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল এবং যারা আমাকে সহযোগিতা করেছিল তারা ছিল যুবক ৷ অনেকে আবার আমাকে অস্বীকারও করেছিল-যদিও এটা ছিল সমকালীন স্বাভাবিকতা ৷'
হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) যুবকদেরকে পূত-পবিত্র স্বভাব-প্রকৃতি , শক্তিমত্তার উদ্দীপক এবং উচ্চতরো লক্ষ্যাধিকারী বলে মনে করতেন ৷ আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহের সাহায্যে জ্ঞান ও বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার বৃক্ষকে তারা নিজেদের ভেতরে লালন ও উন্নয়ন ঘটাতে পারে৷ যৌবন পর্বের এই বৃহত্‍ পুঁজির প্রতি ইঙ্গিত করে নবীজী বলেছেন-'যুবকদের ব্যাপারে তোমাদেরকে সদুপদেশ দিচ্ছি ৷ কেননা তারা নরম অন্তর ও মানসিকতার অধিকারী ৷'
নবীজী তাঁর নবুয়্যতকালে কী মক্কায় কী মদিনায় যুবকদেরকে বিশেষ আনুকূল্য দিয়েছিলেন ৷ এমনকি তিনি সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ বহু দায়িত্বভার যুবকদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন ৷ এই বক্তব্যের প্রমাণ হলেন মাসআব ইবনে ওবায়েদ৷ তিনি মক্কায় বসবাস করতেন ৷ দেখতে তিনি এতো সুদর্শন ও যৌবনদীপ্ত ছিলেন যে , তাঁর কথা প্রায় সর্বত্রই ছিল সবার মুখেমুখে ৷ জনগণের সাথে কাজ-কারবারের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন যথার্থ ও সুশৃঙ্খল ৷ তিনি যখন নবীজীর ঐশী বক্তব্যে আপ্লুত হলেন , অতি দ্রুত ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করলেন এবং ঈমান আনলেন ৷
ঈমান আনার ফলে তাঁকে আপন লোকজনদের পক্ষ থেকেও অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে ৷ তারপরও তিনি তাঁর বিশ্বাস থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়ান নি ৷ রাসূলে খোদা তাই মাসআবের চেয়ে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও যুবক মাসআবকেই মদীনায় তাঁর প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছিলেন ইসলাম প্রচার করার জন্যে ৷ মাসআব নবীজীর কাছ থেকে যা যা শিখেছিল , সেইসব শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে , নিজস্ব চারিত্র্যিক মাধুর্য দিয়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলোর যথার্থ বাস্তবায়ন ঘটিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মদীনার নারী-পুরুষ,শিশু-বৃদ্ধকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন ৷ এই মাসআবই মদীনায় রাসূলের হিজরতের ব্যবস্থা করেছিলেন ৷
যৌবন কালটা হলো জীবনের সোনালী অধ্যায়৷ পৃথিবীও যুবকদের উদ্যমের মধ্য দিয়ে সবুজ-সতেজ হয়ে ওঠে ৷ যৌবনের বৈশিষ্ট্যই হলো আনন্দ-ফুর্তি করা, চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো, অনুসন্ধিত্সুস হওয়া ,নতুনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠা, সহযাত্রী হওয়া ইত্যাদি৷ যৌবনকে বলা হয় জ্ঞানার্জনের বসন্তকাল ৷ এ কারণেই নবী করিম ( সা ) জনগণকে বিশেষ করে যুবকদেরকে জ্ঞানার্জনের জন্যে উত্সাইহিত করতেন , অনুপ্রাণিত করতেন ৷ যুবকদের প্রতি রাসূলে খোদার ছিল ভালোবাসাপূর্ণ দৃষ্টি , তাদের ব্যক্তিত্বের প্রতি ছিল অকৃত্রিম সম্মান এবং তাদের প্রকৃত চাওয়া-পাওয়াগুলোর ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই সতর্ক ৷ তিনি অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে সচেতন হবার জন্যে পরামর্শ দিতেন ৷ নবীজী চাইতেন যুবকদের মাঝে সবসময় হাসি-খুশি অবস্থা এবং কর্মচাঞ্চল্য বিরাজমান থাকুক ৷ রাসূলের আন্তরিকতাপূর্ণ সুকোমল আচার-ব্যবহারের কারণে যুবকরা তাঁর চারপাশে মোমবাতির বৃত্তের মতো ঘিরে থাকতো ৷ তাঁর কথা যুবকদের অন্তরগুলোকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতো ৷ তাঁর সহাস্য চেহারা যুবকদের আনন্দের কারণ হয়ে দাঁড়াতো ৷
যৌবন হলো মহামূল্যবান একটা সময়,তবে তা সীমিত ৷ জীবনের এই মূল্যবান পুঁজির ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্যে প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা ৷ যৌবনকে গনীমত হিসেবে মনে করার জন্যে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করে বলেছেন,' যৌবনকে বার্ধক্যের আগে গনীমত মনে করো ৷ মানুষ যখন কেয়ামতের দিন উপস্থিত হবে , তখন তাকে তার যৌবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, কীভাবে যৌবনকে কাজে লাগিয়েছে ?'
ইসলামের নবী যুবকদের আত্মাকে শক্তিশালী করবার জন্যে সবসময় চেষ্টা করতেন , তাদের অন্তরে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখতে ৷ পৃথিবীর সকল জটিলতা ,দুর্গমতা , সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করবার জন্যে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,তা হলো এই আশাবাদ ৷ 'আশা' যুবকদের জীবনের সকল উদ্বেগ , হতাশা , সমস্যা উত্তরনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে ৷ নবীজী এই আশাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত বলে মনে করতেন এবং বলতেন-'আমার অনুসারীদের জন্যে আশা হলো রহমত ৷ আশা যদি না থাকতো কোনো মা-ই তার সন্তানকে দুধ দিত না এবং কোনো মালিই গাছ বাগানে লাগাতো না ৷'
যুবকদের ব্যাপারে নবীজীর এই গুরুত্ব প্রদানের পেছনে তাদেরকে গুনাহ থেকে দূরে রাখার বিষয়টিই ছিল উদ্দেশ্য ৷ তারা যাতে যৌবনের সীমারেখা লঙ্ঘন করতে না পারে সেজন্যে তাদের আচার-আচরণ,কথাবার্তা, চিন্তা-চেতনার দিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরী বলে তিনি মনে করতেন ৷ কেননা , পাপাচার বা নোংরামি থেকে দূরে থাকলে যুবকদের মন বা চিন্তাশক্তি আল্লাহর দিকে , আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকতে সাহায্য করে ৷ তিনি বলেছেন,'আল্লাহর কাছে তওবাকারী বা অনুশোচনাকারী যুবকদের চেয়ে পছন্দনীয় অন্য কিছুই নেই ৷'
যুবকদের চিত্তবিনোদনের জন্যে সুস্থ-স্বাভাবিক আনন্দানুষ্ঠানের প্রয়োজন রয়েছে৷ এই বিনোদন বিচ্যুতির ঢেউ থেকে যুবককে রক্ষা করবে এবং নিরাপদ উপকূলে নিয়ে যাবে ৷ যুবকদের মাঝে এই সুস্থ ও গঠনমূলক বিনোদনের ব্যবস্থার ওপর নবীজী ব্যাপক গুরুত্ব দিতেন ৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুবকদের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্যে তাদেরকে খেলাধুলা করতে উত্সাূহিত করেছেন ৷ তিনি যুবকদের মাঝে ঘোড়দৌড় , তীরন্দাজিসহ আরো অনেক প্রতিযোগিতার আয়োজন করার পদক্ষেপ নিয়েছেন ৷ যুবকদের সাথে তাঁর এতো বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল যে, তিনি অনেক সময় নিজে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন ৷
ইতিহাসে রাসূলে খোদার জীবন থেকে বহু উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে যে, তিনি যুবকদের বক্তব্য শোনার জন্যে ভালো একজন শ্রোতা ছিলেন ৷ কখনো কখনো লম্বা সময় ধরে যুবকদের সাথে বসতেন,বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দিক-নির্দেশনা দিতেন ৷ ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী এ কারণেই নবুয়্যতির কঠিন বছরগুলোতে তাঁর অনুসারীদের একটা বিরাট অংশ ছিল যুবক শ্রেণী ৷ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যুবকদের কর্মপ্রচেষ্টার ওপর তাঁর গুরুত্বারোপ ৷ কর্মচাঞ্চল্য যুবকদের মাঝে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় এবং তারা সামাজিক দায়িত্ব গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হয় ।ণ রহমতের নবী এ ব্যাপারে বলেছেন,'তোমরা সবাই কাজ করো,চেষ্টা করো! তবে জেনে রেখো,প্রত্যেককেই কোনো না কোনো কাজের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে ৷ তারা তা সহজভাবে আঞ্জাম দেয় ৷' এখানে কাজের মনস্তত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে ৷ ভাবতেই অবাক লাগে-সেইযুগে নবীজী এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ৷ বিষয়টা হলো, মেধা এবং পছন্দ অনুযায়ী যুবকদের পেশা নির্বাচন৷ এ বিষয়ে নবী জীবনের একটা গল্প শুনিয়ে আমরা আজকের আসর থেকে বিদায় নেবো৷
একদিন নবীজী একদল যুবকের সাথে কথাবার্তা বলছিলেন ৷ আলাপ করে বুঝতে পেরেছেন যে,একটি যুবক মসজিদের পাশে ভোর থেকে কঠোর পরিশ্রম করছে৷ যুবকটি ছিল যথেষ্ট শক্তিমান ও পরিশ্রমী৷ তার হাতের রগগুলো অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে ফুলে উঠেছিল ৷ ঐ রগফোলা হাত দিয়ে সে তার কপালের ঘাম মুছছিল ৷ নবীজী যুবকটিকে খুব ভালো করে দেখছিলেন৷ নবীজীর খেদমতে বসে থাকা একজন ব্যাপারটি লক্ষ্য করে বললো-'এই যুবকটি তার কাজে এতোই মশগুল যে আশেপাশের খবরও তার নেই ৷ কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটি হলো তার এই শক্তিকে আল্লাহর পথে কাজে লাগাচ্ছে না,আল্লাহর ইবাদাতে ব্যয় করছে না কিংবা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে ব্যবহার করছে না ৷'
নবীজী এবার বক্তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন ৷ সবাই তাঁর প্রতিক্রিয়া জানার অপেক্ষায় ছিলেন৷ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর নবীজী বললেনঃ 'হে সাথীগণ! এভাবে বলবেন না৷ শক্তিমান এই যুবকটি-যে আমাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করেছে-কয়েকটি অবস্থা থেকে বাইরে নয়৷ যদি সে অন্য কারো মুখাপেক্ষী না হবার জন্যে নিজস্ব জীবিকার তাড়নায় কাজ করে থাকে তাহলে সে খোদার পথেই শ্রম দিচ্ছে ৷ যদি তার অক্ষম পিতা-মাতাকে সাহায্য করবার জন্যে কিংবা তার সন্তানদের প্রয়োজন মেটাবার জন্যে কাজ করে থাকে,তাহলেও সে খোদার পথেই কাজ করে যাচ্ছে ৷ আর যদি সে গরীবদের ওপর বড়াই করার জন্যে নিজের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই কাজ করে থাকে তাহলে সে শয়তানের পথে গেছে এবং সত্য-সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে ৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন