নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৪ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৪ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৪ তম পর্ব


আমরা সবাই জানি যে,বস্তুগত কিংবা সামরিক কোনোধরনের শক্তি ছাড়াই এমনকি রাসূলের নিকটাত্মীয়দের অনেকেরই ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসলামের দাওয়াতী কাজ প্রাথমিক পর্বে ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়েছিল৷ যারাই ইসলাম গ্রহণ করতো তারাই বিচিত্র সমস্যা ও চাপের মুখোমুখি হতো৷ এই চাপের মুখেও দিনের পর দিন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছিল৷ নিঃসন্দেহে এমন কোনো একটা শক্তি ছিল যার ফলে নতুন এই ইসলামী সমাজে প্রাণ ও শক্তির সঞ্চার হয়েছিল এবং ইসলাম দিনের পর দিন বিকাশ লাভ করেছিলো৷ গবেষকগণ এই শক্তি বলতে রাসূলে কারীম ( সা ) এর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কথা বলেছেন৷ সেইসাথে তাঁর নৈতিক চরিত্র ,তাঁর নেতৃত্বের গুণগত বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর পরিচালনাশক্তির প্রভাবকেও ইসলামের বিস্তার ও উন্নয়নের নেপথ্য শক্তি বলে মনে করেন গবেষকমহল৷ তাঁর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো কিংবা তাঁর আচার-ব্যবহার যাঁরা কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন,তাঁরাই যে কেবল নবীজীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন তাই নয় বরং যাঁরা তাঁদের কাছ থেকে রাসূলের কথা শুনেছেন তাঁরাও বিনম্র শ্রদ্ধায় তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেছেন৷
হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) তাঁর উন্নত রুচিবোধ ও আচার ব্যবহারের মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধকেই সবার সামনে ফুটিয়ে তুলতেন ৷ তলোয়ারের জোরে যদি ইসলামকে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো , তাহলে সবার আগে সেই কাজটি করতেন স্বয়ং নবীজী ( সা )৷ অথচ তিনি তা না করে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে ,সুন্দর ব্যবহার দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন৷ যারা তাঁর সাথে দীর্ঘ বিরোধিতাও করেছেন ,তাকেও তিনি নিরাপত্তা দিয়েছেন৷ ইসলামী রাষ্ট্রে সে যাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারে সেই ব্যবস্থাও করেছেন৷ ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্যে রাসূলের ওপর যেসব যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল , ইসলামের স্বার্থে মানুষের জন্যে সত্য ও হেদায়াতের পথ সুগম করার স্বার্থে সেসব যুদ্ধে সাহসিকতার সাথে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প ছিল না৷ হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধি নয়াভারত নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ "একথা জ্ঞাতব্য যে , সামপ্রতিককালে যেই মহান ব্যক্তিত্ব তর্কাতীতভাবে কোটি কোটি মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন,তিনি হলেন মুহাম্মাদ৷ আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, জনগণ তলোয়ারের ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করে নি৷ মুহাম্মাদ সাদামাটা জীযনযাপন করতেন৷ তিনি অন্যান্য নবীর মতোই তাকওয়াবান এবং পরহেজগার ছিলেন৷ কঠোর আমানতদার অর্থাৎ বিশ্বস্ত ছিলেন এবং তুলনামূলকভাবে তিনি নিজেই বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বেশি যেতেন৷ আমি যখন ইসলামের নবীর জীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড পড়লাম, খুব দুঃখ হলো এই ভেবে যে, কেন আমি এই নবীর জীবনী সম্পর্কে আরো বেশি জানতে পারলাম না৷"
সততা এবং সত্য কথা বলাটা নবী ব্যক্তিত্বের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ৷ এই বৈশিষ্ট্য জনগণকে ইসলামে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল৷ নবীজী সবসময় লোকজনের সাথে সততার সাথে কথা বলতেন৷ তাঁর ওপর যেসব ওহী নাযিল হতো , সেসব তিনি কোনোরকম পরিবর্তন বা পরিবর্ধন না করে হুবহু লোকজনের সামনে তুলে ধরতেন৷ এছাড়া জনগণের কাছে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাও ছিল শুভ স্মৃতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ সে কারণেই রাসূলে খোদা যেদিন জনগণকে সুস্পষ্টভাবে ইসলামের দাওয়াত দিলেন সেদিন তাদেরকে নবীব্যক্তিত্বের সেইসব বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন-'হে জনগণ ! তোমরা কি আজ পর্যন্ত আমাকে কোনোরকম মিথ্যা কথা বলতে শুনেছো?' সবাই তখন একবাক্যে বললো যে, তুমি সবসময় সত্যবাদী ছিলে এবং সবসময় সঠিক কাজটিই করেছো ৷ ইমাম সাদেক ( আ ) বলেন, "রাসূলে খোদা সবকিছুকেই সুন্দর ও মহত্‍ দৃষ্টিতে দেখতেন৷ দৈহিকভাবে তিনি ছিলেন লম্বা ৷ পথচলার সময় অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে চলতেন৷ যখন কোনোকিছু বুঝতে পারতেন , গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন ৷ কিন্তু জনগণের দিকে অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে তাকাতেন৷ যার কাছেই যেতেন সালাম দিতেন, সবসময় তিনি জনগণের পথপ্রদর্শক ছিলেন৷ পার্থিব কোনো সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হলে তিনি মোটেও রাগান্বিত হতেন না৷ তাঁর কাছে সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিল সে-ই , যিনি অন্যদের প্রতি বেশি বেশি সদয় ছিলেন৷ লজ্জাশীলতা ছিল তাঁর অন্যতম গুণ , ঔদার্য ছিল তাঁর সহজাত প্রকৃতি৷ আল্লাহ তাঁকে পছন্দ করলেন,নির্বাচন করলেন,তারপর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করলেন৷ তাঁকে নবুয়্যতি দান করলেন যাতে তিনি পৃথিবীর বুকে বয়ে আনেন রহমতের বসন্ত৷"
এমন এক পরিস্থিতিতে নবীজীর আবির্ভাব হয়েছিল যখন মানুষের মাঝে নৈতিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছিল৷ যেই সময়টায় আত্মগৌরবের লড়াই , মারামারি-হানাহানি , প্রতারণা ও ভণ্ডামি এবং বিচিত্ররকমের বিচ্যুতিতে নিমজ্জিত ছিল মানুষ , সেইসময় নবীজী সামাজিক এইসব বিশৃঙ্খলা দূরীভূত করবার জন্যে প্রত্যয়ী হয়ে উঠলেন৷ কিন্তু এই কাজ সহজসাধ্য ছিল না মোটেই৷ স্রোতের বিপরীতে তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছে-এটাই ছিল সবচে কষ্টকর৷ এই পরিস্থিতিতে তাঁকে ধৈর্য ধারণ করতে হয়েছে অনেক বেশি,সংযত হতে হয়েছে অনেক বেশি৷ আমরা জানি যে,ধৈর্যই হলো সাফল্যের চাবিকাঠি৷ নিঃসন্দেহে যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে প্রয়োজন ধীর স্থিরভাবে অগ্রসর হওয়া৷ নবীজী মক্কায় তেরোটি বছর বহু অত্যাচার-উত্পী ড়ন সহ্য করেছেন৷ মদীনাতেও দশ বছর বিভিন্ন সমস্যা উত্তীর্ণ করে নতুন একটি সমাজ ব্যবস্থা ইসলামের প্রবর্তন করেন৷ এতোসব চড়াই-উত্রারইয়ের মধ্যেও যে শক্তি তাঁকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে সহযোগিতা করেছে তা হলো তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্ব ও উন্নত আধ্যাত্মিক সত্ত্বা৷ দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে নবীজী এতোবেশি আলোকিত হয়েছেন যে , তাঁর চারিত্র্যিক সৌন্দর্যের কথা সর্বসাধারণের মুখে মুখে ছিল প্রবাদের মতো৷ তিনি নিজেই বলেছেন-'নৈতিক গুণাবলীসম্পন্ন মুমিনগণ তাঁদের পর্যায়ে উপনীত হন যাঁরা রাতভর ইবাদাতে কাটান আর দিনভর রোযা রাখেন৷'
এ সম্পর্কে আমরা নবীজীবনের আরেকটি গল্প বলবো যেখানে তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠবে৷
মদীনায় যায়েদ নামে এক ইহুদি তাঁর নিজের একটা ঘটনা নবীজীকে এভাবে বললো-'একদিন একাকী ঘরে বসে ছিলাম৷ তৌরাত পড়ছিলাম৷ তৌরাতের এক জায়গায় সর্বশেষ পয়গাম্বরের কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পড়লাম৷ একটা বৈশিষ্ট্য হলো নম্রতা ও সহিষ্ণুতা৷ নিজে নিজে ভাবলাম ,মন্দ নয়, মুহাম্মাদের এই বৈশিষ্ট্যটা পরীক্ষা করে দেখবো এবং কিছুক্ষণ তাঁর কথাবার্তা ও আচার আচরণ লক্ষ্য করবো৷ তৌরাতে পড়েছিলাম যে রাগের ওপরে তাঁর ধৈর্য বিজয়ী৷ এই বিষয়টা দেখার জন্যে আমি মদীনার মসজিদের দিকে রওনা হলাম৷ ঘটনাক্রমে ঠিক সেই সময়েই মরুবাসী আরবদের দেখলাম মুহাম্মাদের কাছে এসে তাদের নওমুসলিম গোত্রের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে বলছে৷ তারা মুহাম্মাদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতারও আবেদন জানায়৷ মুহাম্মাদ তাদের কথা শোনার পর হযরত আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন,'এমন কোনো মালামাল কি আছে এদেরকে দেওয়ার মতো?' আলী ( আ ) বললেন,আপাতত কিছুই নাই৷ ঠিক সে সময় আমার প্ল্যান অনুযায়ী বললাম এই টাকাটা আমি ঋণ হিসেবে তোমাকে দিচ্ছি৷ তবে এই টাকার বিনিময়ে আমাকে খুরমার একটা অংশ দিতে হবে৷ মুহাম্মাদ আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলো এবং আমার কাছ থেকে একটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিল৷ সেই টাকা দিয়ে মরুবাসী ঐ আরবদের প্রয়োজন মেটালো৷
যায়েদ আরো বললোঃ খুরমা তোলার আর অল্প কদিন বাকি ছিল৷ কিন্তু আমি মুহাম্মাদের ধৈর্য পরীক্ষা করবার জন্যে তাঁর কাছে গেলাম৷ আমি জানতাম যে আমার ঋণ পরিশোধ করবার এখনো কিছুদিন বাকি আছে৷ তারপরও ঝগড়াটে মনোবৃত্তি নিয়ে বললাম'হে মুহাম্মাদ জনগণের সম্পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃচ্ছতা করো কেন ? 'আমি একদম বেপরোয়াভাবে অসৌজন্যমূলক ভাষায় কথা বললাম,অথচ উনি এতো শান্ত এবং মার্জিত ছিলেন যে,এরকম ধৈর্য আমি আর কারো মাঝে দেখি নি৷ মুহাম্মাদ খালি শুনলোই আর আমি কেবল অসৌজন্যমূলক আচরণই করে যাচ্ছিলাম৷ এমন সময় মুহাম্মাদের সঙ্গীদের একজন রেগেমেগে আমার কাছে আমাকে গালি দিল৷ মুহাম্মাদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো-'শান্ত হও ! উত্তেজিত হবার প্রয়োজন নেই৷ বরং যায়েদকে ধৈর্য ধারণ করতে বলা উচিত৷' অবশেষে যখন খুরমা পাকলো এবং আমার ঋণ পরিশোধ করার সময় হলো,তখন তিনি আদেশ দিলেন আমার প্রাপ্য খুরমাকে অন্যভাবে প্রস্তুত করতে৷ যখন খুরমাগুলো গ্রহণ করলাম বুঝতে পারলাম আমার প্রাপ্য যতোটুকু তারচে বেশি খুরমা আমাকে দেওয়া হয়েছে৷ জিজ্ঞেস করলাম এই অতিরিক্ত খুরমাগুলো কীজন্যে? বললেন-'যেহেতু তুমি নবীজীর এক সঙ্গীর উত্তেজিত কণ্ঠের কারণে কষ্ট পেয়েছো,সেজন্যে রাসূলে খোদা আদেশ দিয়েছেন তোমার সন্তুষ্টির জন্যে , তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে অতিরিক্ত কিছু খেজুর তোমাকে দিয়ে দিতে৷' যায়েদ বললো-আমি মুহাম্মাদের নজীরবিহীন চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হলাম এবং আল্লাহর একত্ব ও মুহাম্মাদের রেসালাতের সাক্ষ্য দিলাম৷ অবশেষে মুসলমানদের কাতারে নিজেও অন্তর্ভুক্ত হলাম ৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন