শিয়ারা কি কোরআন বিকৃত হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বাসী?

পবিত্র কোরআন হজরত মোহাম্মাদ (সা.) এর যুগেই সংকলিত হয়েছিল এবং এ কারণেই শিয়ারা বিশ্বাসী যে, কোরআনের একটি সূরা, আয়াত, হুরুফ এমনকি একটি নোকতাও বিকৃত হয়নি এবং রাসুল (সা.) এর যুগ থেকে নিয়ে আজও তা অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু আমরা বিভিন্ন পুস্তকে কিছু রেও

শিয়ারা কি কোরআন বিকৃত হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বাসী?
উত্তরঃ শিয়ারা কোরআন বিকৃত হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বাসী না। কেননা শিয়া মাযহাব হচ্ছে একটি এমন মাযহাব যার সূচনা হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর যুগেই হয়েছিল এবং এই মাযহাবের পবিত্র ইমামেরা হচ্ছেন মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হজরত রাসুল (সা.) এর কর্তিৃক নির্বাচিত।
পবিত্র কোরআন হজরত মোহাম্মাদ (সা.) এর যুগেই সংকলিত হয়েছিল এবং এ কারণেই শিয়ারা বিশ্বাসী যে, কোরআনের একটি সূরা, আয়াত, হুরুফ এমনকি একটি নোকতাও বিকৃত হয়নি এবং রাসুল (সা.) এর যুগ থেকে নিয়ে আজও তা অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু আমরা বিভিন্ন পুস্তকে কিছু রেওয়ায়েত পরিলক্ষিত করি যার ফলে অনেকেই মনে করেন যে, নাউযুবিল্লাহ কোরআন বিকৃত হয়েছে এবং ইসলামের শত্রুরা এই রেওয়ায়েতগুলোকে ছুতা বানিয়ে দ্বীনে ইসলাম এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং শিয়া মাযহাবের ভাবমূর্তিকে মুসলিম বিশ্বের কাছে খারাপ করার লক্ষে বিভিন্ন বিভ্রান্তি মূলক প্রশ্নের অবতারণা করে ষড়যন্ত্রমূলক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই যে, কিছু উগ্রপন্থি এবং কঠোরপন্থি গোষ্ঠি ছিল যাদেরকে সেই যুগে হাসাওয়িয়ে বলা হতো এবং বর্তমানে তাদেরকে সালাফি বলা হয়ে থাকে। যারা বিভিন্ন সময়ে ইসলামে বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা করে মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।
আসুন আমরা এই বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্নের উত্তরে কিছু আলোচনা করিঃ
বিভিন্ন রেওয়ায়েত সমূহে কোরআনের বিকৃত হওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে এবং যে রেওয়ায়েত সমূহ বর্ণিত হয়েছে তার সনদ সমূহ হচ্ছে দূর্বল। নিন্মে কিছু আয়াতের নমুনা উল্লেখ করা হলোঃ
১- রাজমের আয়াতঃ কোরআনে এই ধরণের আয়াত নাযিল হয়নি শুধুমাত্র জালাদা শব্দটি এসেছে যা চাবুক মারার অর্থে ব্যাবহৃত হয়েছে। সতরাং চাবুক মারাটি এক বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে ব্যাবহৃত হয়ে থাকে। ( যদি কোন লোকের যৌন চাহিদা মিটানোর কোন হালাল ব্যাবস্থা থাকে কিন্তু সে অবৈধ পথ অবলম্বন করে তাহলে তাকে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যম হত্যা করা হবে তাছাড়া তাকে চাবুক মারা হবে)
কিন্তু হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব মনে করেন যে, কোরআন সংকলনের সময়ে তা বাদ পড়ে যায় এবং তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন যে, সাহাবীরা যেন তা মেনে নেয়। তার আরবী বাক্যটি হচ্ছে নিন্মরূপ
الشیخ و الشیخه إذا زنیا فارجموهما إلبته نکالا من الله و الله عزیز حکیم
যদি বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা যেনা করে তাহলে তাদের কে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে হত্যা কর কেননা এই শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে খোদার পক্ষ থেকে যিনি হচ্ছেন আযিয এবং হাকিম।
যখন তার কাছে উক্ত আয়াত সম্পর্কে দুইজন সাক্ষি আনতে বলা হয় তখন তিনি সাক্ষি উপস্থাপন না করতে পারার কারণে তার উক্ত আয়াতটি গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু পরে তিনি চেষ্টা করেন যেন উক্ত আয়াতটি যেন সমাজে বাস্তবায়িত হয় এবং তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মেম্বারে চড়ে বলতে থাকেন যে, হে লোক সকল তোমরা কেয়ামতের দিন খোদার কাছে অভিযোগ করো না যে ওমর আমাদের কাছে উক্ত আয়াত সম্পর্কে কিছুই বলেননি। (সহীস বুখারী, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ২০৮-২১১, সহীহ মুসলিম, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৮৭, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১১৬, মুসনাদে আহমাদ, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৩, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৩২, ১৮৩, আবু দাউদ, হুদুদ ২৩, তিরমিযি হুদুদ ৭, ইবনে মাজা হুদুদ ৯, মোআত্তা হুদুদ ১০।
২- রাগবাতের আয়াতঃ হজরত ওমর মনে করেন যে উক্ত আয়াতটিও কোরআনের আয়াত কিন্তু তা বাদ দেয়া হয়েছে তা নিন্মরূপ
أن لا ترغبوا عن آبائکم فإنه کفربکم أن ترغبوا عن آبائکم
হয়তো বিষয়টি এমনও হতে পারে যে তিনি রাসুল (সা.) থেকে হাদীসটি শুনেছেন এবং মনে করেছেন যে তা হচ্ছে কোরআনের আয়াত। সহীহ বুখারী, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ২০৮-২১১, সহীহ মুসলিম, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৬৭, খন্ড ৫, পৃষ্টা ১১৬।
৩- জিহাদের আয়াতঃ তিনি মনে করেন যে উক্ত আয়াতটিও ছিল কোরআনের আয়াত কিন্তু তা পরে বাদ দেয়া হয়েছে। আয়াতটি হচ্ছে নিন্মরূপঃ (দূররে মানসুর, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১০৬)
أن جاهدوا کما جاهدتم أول مره
৪- আয়াতে ফারাশঃ হজরত ওমরের মতে আয়াতে ফারাশ কোরআনের একটি আয়াত ছিল। আয়াতটি ছিল নিন্মরূপ
الولد للفراش و للعاهر الحجر
দূররে মানসুর, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১০৬, ফাতহুল বারী, খন্ড ১২, পৃষ্ঠা ১২৭, তাফসীরে ইবনে কাসীর, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৬১, আল বুরহান, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৬-৩৭।
৫- হজরত ওমরের মতে কোরআনে অক্ষরের সংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ ২৭ হাজার কিন্তু বর্তমানে আমরা কোরআনে অক্ষরের সংখ্যা দেখতে পাই ৩ লক্ষ ২৩ হাজার ৬৭১ টি। আমরা তার থেকে আরো একটি রেওয়ায়েত দেখতে পাই আর তা হচ্ছে কোরআনে এক লক্ষ ২৭ হাজার আয়াত রয়েছে যদি কেউ উক্ত আয়াত সমূহকে খোদার জন্য এবং ধৈর্যের সাথে পাঠ করবে খোদা তাকে প্রত্যেকটি অক্ষরের জন্য হুরদের মধ্যে থেকে তাকে একটি স্ত্রী দান করবেন। (আল ইতকান, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৯৮)
৬- হজরত ওমরের সন্তান আব্দুল্লাহ তিনি মনে করেন যে, কোরআনের অনেক আয়াত পরে কোরআনের লিপিবদ্ধ হয়নি তিনি আরো বলেছেন যে, তোমরা কেউ এমনটি বলোনা যে আমরা সম্পূর্ণ কোরআনকে একত্রিত করেছি। কি করে বুঝবে যে এটা হচ্ছে পরিপূর্ণ কোরআন? কেননা কোরআনের অনেক আয়াত বিলিন হয়ে গেছে। বরং এভাবে বল যে, যতটুকু ছিল সংগ্রহ করেছি।(আল ইতকান, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৭৩)
৭- অনেকেই মনে করেন যে, ইয়ামামার যুদ্ধে (যা হজরত আবু বকরের খেলাফতের প্রথম বর্ষে উক্ত যুদ্ধটি সংঘটিত হয় এবং সেই যুদ্ধে অনেক সাহাবী মারা যান যার ফলে কোরআনের কিছু অংশ বাদ পড়ে যায় কেননা কোরআনের অনেক আলেম উক্ত যুদ্ধে মারা যায়)অনেকেই মারা যান ইবনে আবি দাউদ উক্ত বিষয়টি ইবনে শাহাব থেকে বর্ণনা করেছেন। (মুনতাখঅবে কানযুল উম্মালমুসনাদে আহমাদের বিবরণে, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৫০।
৮- হজরত আয়েশার কাছে যে লিখাগুলো ছিল তাতে কিছু বাড়তি কথা ছিল যেমন আবি ইউনুসের কন্যা হামিদা যিনি ছিলেন হজরত আয়েশার খাদেমদের মধ্যে একজন তিনি বলেন যে, একটি আয়াত ততদিন পর্যন্ত আয়াত বলে পরিগণিত হতো
یا ایها الذین آمنوا صلو علیه و سلموا تسلیما و علی الذین یصلون الصفوف الأولی
যতদিন হজরত উসমান উক্ত লিখাটিকে পরিবর্তন করেননি।(আল ইতকান, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৭৩)
৯- হজরত আয়েশার মতে কোরআনে বাচ্চাকে দুধ দান করা সম্পর্কে আয়াত ছিল যা রাসুল (সা.) এর দাফন কার্যের সময় একটি ছাগল তার ঘরে প্রবেশ করে এবং উক্ত আয়াতটি খেয়ে ফেলে! উক্ত আয়াতের শুরু ছিল এরূপ
عشر رضنات یحرمن
অপর আয়াতটি হচ্ছে
خمس رضعات یحرمن
তিনি বলেন রাসুল (সা.) এর ওয়াফাতের পূর্ব পর্যন্ত উক্ত আয়াত দুটি কোরআনের অংশ হিসেবে তেলাওয়াত করা হতো।(সহীহ মুসলিম, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৬৭, আবু দাউদ, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২২৪)
১০- আবু মূসা আশআরী মনে করেন যে, কোরআনে সূরা বারাআতের ন্যায় একটি সূরা ছিল এবং অনুরূপভাবে ঐ সমস্ত সূরা সমূহ যা সাববাহা, ইয়ুসাববিহু দ্বারা শুরু হয় এই ধরণের সূরা সমূহও কোরআন থেকে বাদ পড়ে গেছে। তিনি আরো বলেছেন যে, বর্তমানে আমার সূরা বারাআতের ন্যায় সেই সূরার একটি আয়াত মনে আছে যা হচ্ছেঃ
لو کان لابن آدم و ادیان من مال لا تبغی وادیا ثالثا و لا یملا جوف ابن آدم إلا لاتراب
یا ایها الذین آمنوا لم تقولون ما لا تفعلوا فتکتب شهاده فی أعناقکم فتسألون عنها یوم القیامه
কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, আবু মূসা যিনি উক্ত বাক্যটি যা তিনি কোরআনের আয়াত বলে মনে করেছিলেন আসলে তা ছিল হাদীসে কুদসী।(মুসনাদে আহমাদ, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ২১৯)
১১- জলিলুল ক্বদর সাহাবী উবাই ইবনে কাআব এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, তিনি বলেছেনঃ বর্তমানে সূরা আহযাব যাতে ৮৩টি আয়াত রয়েছে প্রকৃত পক্ষে তা ছিল সূরা বাকারার ন্যায় যাতে ২৮৬ টি আয়াত ছিল। উক্ত কথাটি হজরত আয়েশার উদ্ধৃতি দিয়েও বর্ননা করা হয় আর ধারণা করা হয় যে, উক্ত কথাটি হজরত উসমানের বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কানোর জন্য বলা হয়েছিল।(মুসনাদে আহমাদ, খন্ড ৫, পৃষ্ঠঅ ১৩২, আল ইতকান, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৭২, সিয়ানাতুল কোরআন মিনাল তাহরিক, পৃষ্ঠা ১৭০-১৭১)
১২- মালিক ইবনে আনাস তিনিও মনে করেন যে, সূরা বারাআতের এক চতূর্থাংশেরও বেশী আয়াত কোরআনের অবশিষ্ট নেই। তিনি আরো বলেনঃ উক্ত সূরাটি সূরা বাকারার ন্যায় ছিল এবং তার প্রথমাংশের কিছু আয়াত বাদ পড়ে যায় এবং তার মধ্যে বিসমিল্লাহ যা কোরআনের আয়াত ছিল তাও বাদ পড়ে যায় এবং এ সম্পর্কে একাধিক রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে।(আল ইতকান, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৮৪, আল মুসতাদরাক, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৩০-৩৩১, দুররে মানসুর, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২০৯)
উপরোক্ত রেওয়ায়েত সমূহ থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে শিয়ারা কোরআন বিকৃতিতে বিশ্বাসী না। বরং এই ধরণের হাদীসের ব্যাবহার করে এবং বিভ্রান্ত মূলক প্রশ্নের উপস্থাপন করে ইসলামের কিছু মুসলমান নামধারী শত্রুরা শিয়া ও সুন্নীদের মাঝে দ্বন্দ সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আসুন মুসলমান ভাই ও বোনেরা আমরা তাদের এই ফেতনা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখি। কেননা এখনই সময় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার এবং ইসলামের শত্রুদের বিরূদ্ধে রূখে দাড়ানোর সময়।

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন