সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৪৯-৫৪ (পর্ব-৮)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৪৯-৫৪ (পর্ব-৮)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৪৯-৫৪ (পর্ব-৮)
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৪৯ ও ৫০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
قَالَ فَمَنْ رَبُّكُمَا يَا مُوسَى (49) قَالَ رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَى (50)
“সে (অর্থাত ফেরাউন) বলেছিল- হে মুসা! কে তোমাদের প্রতিপালক?”(২০:৪৯)
“সে (অর্থাত মুসা) বলল- আমাদের প্রতিপালক তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন ও তার প্রকৃতি নির্ধারণ করেছেন।” (২০:৫০)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, আল্লাহ-তায়ালা হযরত মুসা (আ.) ও তার ভাই হারুনকে নবুওয়াত দান করার পর মিশরের অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের দরবারে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আল্লাহর সে নির্দেশ পালন করে হযরত মুসা (আ.) তার ভাইকে নিয়ে ফেরাউনের রাজ-দরবারে উপস্থিত হন। তারা বনী-ইসরাইল সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অত্যাচার বন্ধ করার জন্য ফেরাউনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তুমি এক পালনকর্তার প্রতি ঈমান আনো। এ সময় ফেরাউন জিজ্ঞাসা করে, হে মুসা! তোমার সৃষ্টিকর্তা কে যে তার দিকে আমাকে আহ্বান করছো এবং তার ক্রোধের ব্যাপারে আমাকে হুমকি দিচ্ছো? ফেরাউনের এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত মুসা সংক্ষিপ্ত অথচ দৃঢ়চেতা বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, আমার সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন তিনি যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি তার সৃষ্টির সব প্রয়োজনও মিটিয়েছেনে। সেইসঙ্গে তিনি তার সৃষ্টিকূলকে পূর্ণতায় পৌঁছার পথও বাতলে দিয়েছেন।
ফেরাউন এর আগে নিজেকে কখনো কারো সৃষ্টিকর্তা হিসেবে দাবি করেনি, তাই হযরত মুসা (আ.) এর এই বক্তব্যের কোনো উত্তর দিতে পারলো না। সে নিজেকে সৃষ্টিকর্তা বলে দাবি করতো ঠিকই কিন্তু সে জানতো, সে নিজেকে পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারেনি, অন্যকে সৃষ্টি করা তো দূরের কথা।
অবশ্য হযরত মুসা শুধু সৃষ্টির কথা বলেই ক্ষান্ত হননি, সেইসঙ্গে তিনি বলেছেন, সৃষ্টি জীবের পূর্ণতার পৌঁছারও ব্যবস্থা আল্লাহ করেছেন। যেমন কীভাবে একটি ধানের বীজ থেকে একগুচ্ছ ধান সৃষ্টি হয়, কীভাবে পাখিরা নিজেদের জন্য বাসা বানায়, কীভাবে সব জীব-জন্তু বংশ বিস্তার করে এই পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করে রেখেছে- তার সব নিয়ম-কানুন আল্লাহ তৈরি করে দিয়েছেন। হযরত মুসা ফেরাউনকে সংক্ষেপে এসব কথা বুঝিয়ে বলেন।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. মহান আল্লাহ নিজের দয়া ও ভালোবাসা দিয়ে সব প্রাণীকূল সৃষ্টি করেছেন। কোনো জীবই আল্লাহর কাছে নিজের অস্তিত্ব সৃষ্টির আবেদন করেনি।
২. এই সৃষ্টিজগতের ওপর তারই কর্তৃত্ব খাটে যিনি এ সব কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের প্রত্যেকের পূর্ণতায় পৌঁছার ব্যবস্থা করেছেন।
৩. পৃথিবীর সব সৃষ্টি আল্লাহর নির্দেশে চলে এবং একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মে তাদের পরিচালিত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের প্রমাণ বহন করে।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৫১ ও ৫২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَ فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الْأُولَى (51) قَالَ عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي فِي كِتَابٍ لَا يَضِلُّ رَبِّي وَلَا يَنْسَى (52)
“ফেরাউন বলল: তাহলে অতীত জাতিগুলোর পরিণতি কি হবে?” (২০:৫১)
“মুসা বলল : এ প্রশ্নের উত্তর আমার পালনকর্তার কাছে থাকা কিতাবে রয়েছে। আমার সৃষ্টিকর্তা কখনো ভুল করেন না এবং কোনো কিছু ভুলেও যান না।” (৫২)
ফেরাউন যখন দেখলো হযরত মুসা (আ.) এর প্রশ্নের কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর তার কাছে নেই তখন সে ভিন্ন প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। সে বলল, তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের আগে যে সব জাতি শিরক ও মূর্তিপুজা করে গত হয়ে গেছে তাদের পরিণতি কি হবে? তাদের সবাই কি জাহান্নামে যাবে? এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত মুসা (আ.) অতীত জাতিগুলোর পরিণামের বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আল্লাহ তাদের প্রতিটি কাজের হিসাব নেবেন। বিচার করার ক্ষেত্রে তিনি কোনো ভুল বা পক্ষপাতিত্ব করবেন না এবং সবার প্রতি ন্যায়বিচার করবেন। কাজেই তাদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
১. অতীত জাতিগুলো জান্নাতে যাবে নাকি জাহান্নামি হবে সে সম্পর্কে আমাদের কোনো মন্তব্য করা ঠিক নয়। এ বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তিনি আমাদের ভেতর ও বাইরের সব খবর রাখেন এবং কারো ওপর জুলুম করেন না।
২. পৃথিবীর সব ঘটনারই রেকর্ড রয়েছে আল্লাহর হাতে। তিনি এর ভিত্তিতে পরকালে শাস্তি বা পুরস্কার দেবেন।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৫৩ ও ৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ مَهْدًا وَسَلَكَ لَكُمْ فِيهَا سُبُلًا وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْ نَبَاتٍ شَتَّى (53) كُلُوا وَارْعَوْا أَنْعَامَكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِأُولِي النُّهَى (54)
“যিনি জমিনকে তোমাদের জন্য বিছানা করেছেন এবং তাতে তোমাদের চলার পথ করে দিয়েছেন। তিনি আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ উত্‌পন্ন করেন।”(২০:৫৩)
“তোমরা আহার কর এবং তোমাদের পশু চরাও, অবশ্যই এতে বিবেকসম্পন্ন লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (২০:৫৪)
পবিত্র কুরআন এখানে হযরত মুসা (আ.)’র বক্তব্যের মাঝখানে এ জগত সৃষ্টি এবং তা পরিচালনার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ক্ষমতার কথা বর্ণনা করেছে। সেইসঙ্গে কিছু উদাহরণও তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ আসমান ও জমিন একক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। একদিকে এ পৃথিবীকে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর বসবাস উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে এবং তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার নানা পথ বাতলে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে আকাশ থেকে পানিবর্ষণ করে পৃথিবীর মাটি উর্বর করে রাখা হয়েছে যাতে সেখানে উতপাদিত ফসল ও ফলমূল খেয়ে মানুষসহ সব প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে। এ সব কিছুই মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও শক্তিমত্তাকে প্রমাণ করে।
অবশ্য বিজ্ঞজনেরাই এসব নিদর্শনের দিকে দৃষ্টি দেয় এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। বাকিরা এসব নিদর্শন বারবার দেখলেও তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো চেতনা তৈরি হয় না।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :
১. এ পৃথিবী মানুষের উন্নতি ও পূর্ণতায় পৌঁছার উপযুক্ত স্থান এবং এখানে তার সব প্রয়োজন মেটানো হয়েছে।
২. মানুষের খাবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদ থেকে আসে। উদ্ভিদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে আকাশ থেকে বৃষ্টির পানি বর্ষণের ওপর। নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর দিক-নির্দেশনা ছাড়া এটি সম্ভব ছিল না।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন