রেনেসাঁর কবি ইকবাল -৫

রেনেসাঁর কবি ইকবাল -৫

রেনেসাঁর কবি ইকবাল -৫


পাঠক ! কবি ইকবালের জীবন ও কর্ম ভিত্তিক ধারাবাহিক অনুষ্ঠান রেনেসাঁর কবি ইকবালের আজকের পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। গত আসরে আমরা তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের শৈলী ও বিষয়গত পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছি। আজকের আসরে আমরা ইকবালের কবিচিন্তা ও বিষয়বস্তু চিন্তায় ইরানী সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের প্রভাব সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইকবালের দৃষ্টিতে কবিতা ইসলামী সমাজে চিন্তাগত বিপ্লব প্রতিষ্ঠার জন্যে একটি যথার্থ মাধ্যম। ইকবাল কবিতার মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন মুসলিম জাতিকে একত্রিত করতে,চেষ্টা করেছেন মানবপ্রেম,পবিত্রতা, মুক্তি এবং প্রেমের বাণী সমাজে পৌঁছিয়ে দিতে। তিনি তাঁর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে উর্দু এবং ফার্সি উভয় ভাষাতেই কবিতা লিখেছেন,তবে ফার্সি কবিতার সংখ্যাই এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বেশি। মজার ব্যাপারটি হলো ইকবাল নিজে ফার্সি বলতে পারতেন না,অথচ ফার্সি ভাষায় প্রচুর লিখে গেছেন। ফার্সি সাহিত্য অধ্যয়ন এবং ইরানের বড়ো বড়ো কবিদের সাথে পরিচয়ের সুবাদে তিনি এই ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন।
ইকবাল তাঁর একটি কবিতায় ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার কারণ সম্পর্কে বলেছেন, ফার্সি ভাষার ওজস্বিতা এবং সমৃদ্ধি তাঁর উন্নত চিন্তা প্রকাশ করার জন্যে যথার্থ একটি ভাষা। তিনি মনে করতেন এই ভাষার মাধ্যমেই তিনি তাঁর চিন্তা-চেতনাগুলোকে সবচে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারবেন,চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারবেন। কবি ইকবাল লিখেছেনঃ

হিন্দী ভাষার স্বাদ যদি চিনির মতো
প্রকাশভঙ্গিতে দারী আরো মধুরতরো
আমার চিন্তা বিমোহিত দ্যুতিতে তার
তুরের খুরমা শাখা যেন লেখনী আমার
আমার উন্নত চিন্তার জন্যে ফার্সি ভাষা
সৃষ্টিশীল কর্মের যথার্থ বাহন ফার্সি ভাষা
আট শ' বছরেরও বেশি সময় ধরে ফার্সি ভাষা ছিল ভারত উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক এবং রাষ্ট্রিয় ভাষা। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই ভাষা চালু ছিল। এতো দীর্ঘ সময় ধরে ফার্সি ভাষা প্রচলিত ছিল বলে এই ভাষার গুরুত্ব মোটেও হেলাফেলা করার মতো নয়। এই সময়কালে ভারতের প্রত্যেক মুসলিম আরেফ এবং মনীষী ফার্সি ভাষা জানাটাকে অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করতেন। এই ফার্সি ভাষার সৌকর্য ও সমৃদ্ধি ব্রিটিশ উপনিবেশের কাল থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে যেতে একেবারে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। কেবল স্বনামধন্য ও অভিজাত কতিপয় মুসলিম পরিবার ছাড়া আর কোথাও তার অস্তিত্ব রইলো না। এদিক থেকে বিচার করলে অবশ্যই বলা উচিত যে ইকবাল ফার্সি ভাষায় কবিতা লিখে এই ভাষার অসামান্য সেবা করে গেছেন। যেই ভাষাটিকে প্রাচ্যে বা ভারত উপমহাদেশে ভুলতে বসেছিল, সেই ভাষাটি পুনরায় প্রাণ ফিরে পেল।
আগেই বলেছিলাম যে ইকবাল ইরানী ফার্সি মরমী কবি বা বড়ো বড়ো কবিদের কবিতার সাথে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে মৌলাভি এবং হাফেজের কবিতার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল অপিরিসীম। মৌলাভির মাসনাবি এবং হাফেজের গযল তাঁর রক্ত-মাংসের সাথে মিশে ছিলে। তাছাড়া সে সময় পাঞ্জাবে কোরআন এবং নাহজুল বালাগার পরে মৌলাভির মাসনাভি এবং হাফেজের দিওয়ানের কাছে অন্য কোনো গ্রন্থই স্থান পেত না। ইকবাল মৌলাভিকে তাঁর পীর-মুর্শিদ বলে মনে করতেন। এ কারণে ইকবাল বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে ইকবালের যে শিল্প চিন্তা বা তিনি যে চিন্তা-চেতনা পোষণ করতেন, তার ওপর মৌলাভির ব্যাপক প্রভাব ছিল। ইকবালের সমগ্র কবিজীবনে মৌলাভি ছিলেন তাঁর পথপ্রদর্শক এবং প্রেরণার উৎস। ইকবাল নিজেই লিখেছেনঃ
অগ্রজ রুমি প্রিয় মুর্শিদ আমার সুমহান চিন্তার
আমির তিনি নেশাগ্রস্ত আর প্রেমের কাফেলার
মৌলাভির প্রভাব অবশ্য ইকবালের কবিতার মধ্যে সহজেই বোঝা যায়। কারণ ইকবাল তাঁর অনেক কবিতাই মৌলাভির অনুকরণে রচনা করেছেন। তাঁর আসরারে খুদি,রুমুযে বেখুদি, বান্দেগি নমেহ, জভিদ নমেহ, মুসাফির ও বিলআখারে, পাস চে বয়াদ র্কাদ এই আকওয়ামে র্শাক' ইত্যাদি মৌলাভির অনুসরণে রচিত হয়েছে।
ইকবাল ছোটোবেলা থেকেই হাফেজের কবিতার সাথে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাঁর কবিজীবনের শুরুতে হাফেজের বিপরীতে কবিতা লিখেছিলেন। অবশ্য পরে এ জন্যে অনুতপ্তও হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারার পর ঐ কবিতা নষ্ট করে ফেলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি যেসব কবিতা লিখেছিলেন তার সাথে হাফেজের কবিতার সুরের ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। সর্বোপরি ইকবাল যে ইরানী কবিদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন