রাসুল (সা.) এর শেষ হজ্ব ও পবিত্র ঈদে গাদীর

রাসুল (সা.) এর শেষ হজ্ব ও পবিত্র ঈদে গাদীর

রাসুল (সা.) এর শেষ হজ্ব ও পবিত্র ঈদে গাদীর
আরবী ১৮ ই জিলহজ্ব ইসলামের ইতিহাসে একটি স্মরনীয় দিন । ঈদে গাদীর নামে এ দিনটি পরিচিত । দশম হিজরীর এ দিনে রাসুলে খোদা (সাঃ) যে ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন তারই আলোকে এ দিনটি উদযাপিত হয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ।

আল্লাহর রাসুল এটা জানতেন যে প্রত্যাদেশ বাণী বা আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান পূর্ণতা লাভ করার পর তিনি বেশি দিন ইহজগতে থাকবেন না । তাই নবম হিজরীর পর থেকেই মূলত তিনি এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু করেছিলেন । ঐ সময় ইসলামের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধা- দ্বন্দ ও সংশয় সৃষ্টির জন্যে কাফের মুশরেকদের পক্ষ থেকেও জোর তৎপরতা শুরু হয়েছিল। তারা প্রচার করতো ইসলামের নবীর কোন পুত্র সন্তান নেই , কাজেই তার মৃত্যু হলে ইসলাম ধর্মের অস্তিত্বও আস্তে আস্তে বিলিন হয়ে পড়েবে । এমন এক অবস্থায় মুসলমানদের মনে কিছুটা অস্বস্তি বিরাজ করছিল । সাহাবায়ে কেরাম এটা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করতেন ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একটি জীবন বিধান । এটা চিরস্থায়ী এবং পূর্ণাঙ্গ । পবিত্র কোরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্যে সর্বশেষ ঐশি গ্রন্থ এবং হযরত মুহাম্মদ (দঃ) হচ্ছেন সর্বশেষ নবী এবং রাসুল । কাজেই এই ধর্ম চিরকাল টিকে থাকবে । ইসলামের বিধান শ্বাশত, অমর ও অক্ষয় । যতদিন এ জগত থাকবে ইসলামের দেদীপ্যমান দ্বীপ্তি আলো বিকিরণ করে যাবে । এ আলো নিভিয়ে দেয়ার ক্ষমতা কোন শক্তির পক্ষে সম্ভব নয় ।
জাজ্বল্যমান এই বিশ্বাসকে ধারণ করার পরও মুসলমানদের মনে অস্থিরতা বিরাজ করছিল । আল্লাহর রাসুলের ইহলোক ত্যাগের সম্ভাবনায় একদিকে তাদের মনে ছিল বিরহজনিত অন্তর্দাহ । অন্যদিকে ইহুদী, খৃষ্টান ও পৌত্তলিকদের অব্যাহত চক্রান্তের কথা ভেবে তারা ইসলামের ভবিষ্যতের ব্যাপারেও নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন । সবার কাছে এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল, প্রিয় নবীজী যখন এ জগতে থাকবেন না, তখন পবিত্র কোরআনকে ব্যাখ্যা করবেন , মুসলমানরাই বা জীবন জিজ্ঞাসার জবাব জানার জন্যে কার দ্বারস্থ হবেন ?
ইতোমধ্যে হজ্বের সময় ঘনিয়ে এলো । রাসুলে খাদা মুসলমানদেরকে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র হজ্ব পালন করলেন । এটাই ছিল আল্লাহর রাসুলের শেষ হজ্ব । বিদায় হজ্ব নামে যা আজও পরিচিত । হজ্বের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে নবীজী এবার লক্ষ মুসলমানদের কাফেলাকে সঙ্গে নিয়ে মাতৃভূমি মক্কাকে বিদায় জানালেন, চলছেন প্রিয় মদিনার পথে । আল্লাহর রাসূলকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছিল, এটা বিশিষ্ট সকল সাহাবীই লক্ষ্য করলেন । সবার মনেই এক অজানা আশঙ্কা । এমন সময় কাফেলা গাদীরে খুম নামক এক স্থানে এসে পৌঁছায় ।
ছোট্ট জলাশয় বা ডোবাকে আরবীতে গাদীর বলা হয় । গাদীরে খুম নামক স্থানটি মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি একটি এলাকায় অবস্থিত । মরু আরবের মুসাফির বা বাণিজ্য কাফেলাগুলো সাধারণত এই ছোট্ট জলাশয়ের পাশে সাময়িক বিশ্রামের জন্যে অবস্থান করতো । আল্লাহর রাসুল যখন এই স্থানে এসে পৌঁছলেন তখন হযরত জিব্রাইল (আ) সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াত নিয়ে হাজির হলেন । বলা হলো- "হে রাসুল ! তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা তুমি সবার কাছে পৌঁছে দাও , যদি তা না কর তাহলে তো তুমি তার বার্তা প্রচার করলে না । ''
রাসুলে খোদা (সাঃ) আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার পর দায়িত্বের এই বোঝা থেকে মুক্ত হতে উদ্যোগী হলেন । তিনি সবাইকে সমবেত হতে বললেন। যারা কিছুটা এগিয়ে ছিলেন তারা পেছনে ফিরে তাকালেন । আর যারা পেছনে ছিলেন তারা খানিকটা এগিয়ে এলেন । রৌদ্রস্নাত উত্তপ্ত মরু হাওয়ায় সবাই ক্লান্ত অবসন্ন । তারপরও সকলেই প্রবল মনোযোগ সহকারে অপেক্ষা করতে লাগলেন আল্লাহর রাসুল কিছু একটা বলবেন । মুসলমানদের জন্যে নতুন কোন বিধান বা দিক নির্দেশনা দেবেন ।
আল্লাহর রাসুল উটের জিনকে মঞ্চের মত করে তাতে আরোহণ করলেন । এরপর সমবেত সকলকে লক্ষ করে বললেন, '' হে মুসলমানগণ! অচিরেই আমার জীবনের অবসান ঘটবে, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এ জগত ছেলে চলে যেতে হবে আমাকে । আমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল । আমি কি আমার উপর অর্পিত রেসালতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি ? সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো , হে নবী আপনি আপনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন এবং এ পথে আপনি অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন।
এরপর আল্লাহর রাসুল ( সাঃ) চারদিকে তাকিয়ে আলীকে খুঁজে বের করলেন এবং হযরত আলীর দুই হাত উত্তোলন করে বললেন, মহান আল্লাহ হচ্ছে আমার অলী এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী । আমি হচ্ছি মুমিন বিশ্বাসীদের অলী ও অভিভাবক, আর আমি যার নেতা ও অভিভাবক, আলীও তার নেতা ও অভিভাবক । হে আল্লাহ ! যে আলীকে বন্ধু মনে করে তুমি তাকে দয়া ও অনুগ্রহ করো, আর যে আলীর সাথে শত্রুতা করে, তুমি তার প্রতি একই মনোভাব পোষণ করো ।
রাসু্লে খোদা (সাঃ) এর এই ভাষণের পরপরই হযরত জিব্রাইল ( আঃ) আবার অহী বা প্রত্যাদেশ বাণী নিয়ে এলেন । বলা হলো "আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন বা জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম । ( সুরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াত )
গাদীরে খুমের ঐতিহাসিক ঘোষণায় আল্লাহর রাসুল কার্যত হযরত আলীকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবেই নিযুক্ত করেছিলেন । তাই আমরা লক্ষ্য করি তাবুক অভিযানের সময় নবী করিম (দঃ) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে । কিন্তু নবীজী হযরত আলীকে মদিনায় থেকে যেতে বল্লেন । হযরত আলী এর কারণ জানতে চাইলে আল্লাহর রাসূল উত্তরে বলেছিলেন, '' তুমি কি চাও না মুসার স্থলে হারুন যেমন ছিল , তেমনি আমার স্থলেও হোক তোমার স্থান । যদিও আমার পরে আর কোন নবী বা রাসুল আসবে না ।
রাসুলে খোদা ( সাঃ) এর অসংখ্য উক্তি বা বক্তব্যের আলোকে মুসলমানদের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করেন, মহানবী (সাঃ) এর পর মুসলমানদের নেতৃত্ব বা পবিত্র কোরআনের যথার্থ ব্যাখ্যার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল হযরত আলীর উপর । তিনি মুসলমানদের ইমাম হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন, আর এই দায়িত্ব চূড়ান্তভাবে অর্পিত হয়েছিল গাদিরে খুমের ঐতিহাসিক স্থানে ।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন