ওহাবি মতবাদঃ ৭ম পর্ব

ওহাবি মতবাদঃ ৭ম পর্ব

 ওহাবি মতবাদঃ ৭ম পর্ব
সাউদ কেবল হজ্বের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেই ক্ষান্ত হয় নি, এবার সে নজর দিয়েছে মদিনাতুন্নাবির দিকে। মদীনা শহরও সে অবরোধ করে ফেলে। কিন্তু মদিনাবাসীগণ যেহেতু ওহাবি আকিদা এবং তাদের সহিংসতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন সেহেতু তাঁরা ওহাবিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। প্রায় বছর খানেক এই প্রতিরোধ সংগ্রামের পর অবশেষে ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দে সাউদ ঐ শহরটিকেও দখল করে। ওহাবিরা নবীজী (সা) এর হেরেমের মূল্যবান সকল জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। তবে মুসলমানদের গণ বিরোধিতার ভয়ে রাসূলে আকরাম (সা) এর পবিত্র রওজা ধ্বংস করে নি ওহাবিরা। সাউদ বিন আব্দুল আযিয মদিনা মুনাওয়ারা দখল করার পর ঐ শহরবাসীদেরকে মাসজিদুন নববীতে সমবেত করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্য শুরু করেন এভাবেঃ "হে মদিনার জনগণ! আল কোরআনের পবিত্র আয়াত আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দীনাকুম অর্থাৎ আজ তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্যে পরিপূর্ণ করে দিলাম এর ভিত্তিতে তোমাদের ধর্ম ও বিধিবিধান আজ পূর্ণতায় পৌঁছেছে, ইসলামের নিয়ামতে তোমরা মর্যাদাবান হয়েছো,একক অদ্বিতীয় সত্ত্বা আল্লাহ তোমাদের ওপর সন্তুষ্ট ও খুশি হয়েছেন। তোমাদের পূর্বপুরুষদের বাতিল ধর্মগুলো ছেড়ে দাও এবং কক্ষণো তাদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে মনে করো না। তাদের ওপর দরুদ বা রহমত প্রেরণ করা কঠোরভাবে পরিহার করবে কেননা তাদের সবাই শেরেকি নীতির মধ্যেই মারা গেছে।"
সাউদ তার সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে বহু গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। সে সময়ে তার এবং তার অনুসৃত ওহাবি ফের্কার ভয়াবহ সহিংসতা আরবের বাদশা এবং জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে মৃত্যুর ভয়ে হজ্ব এবং যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করতেও সাহস করতো না। মক্কার শাসক নিজের জীবনের ভয়ে সাউদের ইচ্ছায় আদেশ দিতে বাধ্য হয়েছিল মক্কা ও মদিনায় ইমামদের যতো মাযার আছে এবং এ ছাড়াও আরো যতো পবিত্র স্থাপনা আছে,সকল স্থাপনা ভেঙ্গে গুড়িয়েঁ মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। ওহাবি মাযহাবকে হেজাজে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল এবং ওহাবিরা চাওয়া অনুযায়ী আযান থেকে ইসলামের মহান নবী (সা) এর ওপর দরুদ পাঠানো সংক্রান্ত অংশটিও বাদ দেওয়া হয়েছিল। হেজাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ববর্গ এবং আরবের আমির ওমরাগণ ওহাবিদের এই বলদর্পী, বিচ্যুত আকিদা বিশ্বাসপূর্ণ ফের্কাকে আর সহ্য করতে না পেরে সর্বোচ্চ মহলে অর্থাৎ ওসমানী বাদশার কাছে প্রচুর চিঠি লেখেন এবং ওহাবিদের ক্রমবর্ধমান শক্তির ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে তাকেঁ অবহিত করেন। তাঁরা আরো গুরুত্বের সাথে বলেন যে ওহাবি ফের্কা কেবল সৌদি আরবের মধ্যেই সীমিত থাকবে না,তারা সমগ্র ওসমানী সাম্রাজ্যজুড়ে সকল মুসলমানের ওপর ওহাবি মতবাদের প্রসার ঘটাতে চায়।

ওসমানী সাম্রাজ্য সে সময় হেজাজ, ইয়েমেন, মিশর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং ইরাকের মতো মুসলিম ভূখণ্ডজুড়ে বিস্তৃত ছিল। ওসমানী বাদশা তাই মিশরের গভর্নরকে আদেশ দিয়েছিলেন ওহাবিদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে। ঠিক সে সময় সাউদের বয়স ছিল ছেষট্টি বছর এবং অন্ত্রের ক্যান্সারে সে তখন মারা যায়। সাউদের মৃত্যুর পর তার ছেলে আব্দুল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত হয়। যাই হোক, মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ আলি পাশা ওসমানী সরকারের পক্ষ থেকে ওহাবিদের বিরুদ্ধে বেশ কটি সশস্ত্র যুদ্ধ করে ওহাবিদেরকে পরাজিত করে মক্কা, মদিনা এবং তায়েফকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়। এই যুদ্ধে মিশরের গভর্নর ওহাবিদের বেশ কজন কমান্ডারকে আটক করে ওসমানী সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী ইস্তাম্বুলে পাঠিয়ে দেয়। এই বিজয়কে ঘিরে মিশরে বেশ আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়। কিন্তু ওহাবিদের কাজ তখনো শেষ হয়ে যায় নি। মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ আলি পাশা সেজন্যে জলপথে আরেকটি বাহিনী হেজাজের উদ্দেশ্যে পাঠায়। পাশা তখন মক্কা শহরকে তাদের ঘাটিঁ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার আমির এবং তার ছেলেকে নির্বাসনে পাঠায়,আর তার মালামাল বাজেয়াপ্ত করে। এরপর মিশরে ফিরে গিয়ে তাদের কওমের ইব্রাহিম পাশা নামের একজনের নেতৃত্বে একটি বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে নজদের দিকে পাঠায়।
ইব্রাহিম পাশা নজদের দিরইয়া শহরটিকে অবরুদ্ধ করে। দিরইয়া ছিল ওহাবিদের তৎকালীন মূল কেন্দ্র। ওহাবিদের প্রতিরক্ষা বাহিনী ইব্রাহিম পাশার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু ইব্রাহিম পাশার বাহিনী ছিল কামানের মতো আরো অনেক ভারি অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত। ফলে ওহাবিরা সুবিধা করতে পারে নি এবং ইব্রাহিম পাশার কাছে পরাজিত হয়। ওহাবিদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইব্রাহিম পাশা দিরইয়া শহর জয় করে এবং আব্দুল...ইবনে সাউদকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর আব্দুল...ইবনে সাউদসহ তার আরো বহু নিকটজনকে ওসমানী বাদশার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওসমানী সম্রাট আব্দুল... এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদেরকে বাজারঘাট শহর নগর প্রদক্ষিণ করানোর পর ফাসিতেঁ ঝুলিয়ে হত্যা করে। আব্দুল...ইবনে সাউদের মৃত্যুর পর আলসাউদের সমকালীন শাসকসহ তার সহযোগীরা মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন শহরে আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে।
ইব্রাহিম পাশা ৯ মাসের মতো দিরইয়া শহরে অবস্থান করেন এবং তারপর শহরটিকে সকল অধিবাসীশূন্য করার নির্দেশ দেন। অবশেষে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেন দিরইয়া শহরটি। ইব্রাহিম পাশা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব এবং আলে সাউদের বহু বংশ ও উত্তর প্রজন্মকেও নির্মূল করেন অথবা নির্বাসনে পাঠান যাতে ভয়াবহ বিপজ্জনক ঐ ফের্কাটির নামও আর অবশিষ্ট না থাকে। এই বিজয়ের পর ওসমানী সম্রাট নজদ এবং হেজাজ ভূখণ্ডের শাসনের ভার মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ আলী পাশার ওপর অর্পন করেন। এভাবেই ১২১৩ হিজরিতে অর্থাৎ ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ওহাবি মতবাদের বিলুপ্তি ঘটে। এরপর অন্তত এক শতাব্দি সময়কাল পর্যন্ত ওহাবি মতবাদের নামটিরও আর কোনো অস্তিত্ব ছিল না কিংবা বলা ভালো এই ফের্কাটি নিয়ে আর কেউ কখনো কোনোরকম চিন্তাভাবনা করেনি।
মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ আলী পাশা ইব্রাহিম পাশার নেতৃত্বে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বিশাল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে নজদ ভূখণ্ডে যেরকম সফল অভিযান চালিয়েছিল, সৌদিআরব ভূখণ্ডে সেই অভিযানের প্রতিক্রিয়া ছিল সুস্পষ্ট এবং চোখে পড়ার মতো। নজদ বিজয়ের পর আব্দুল আযিয এবং তার ছেলে সাউদের বিশাল বিস্তৃত দেশটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বহু সংখ্যক ওহাবি প্রাণ হারায়। ওহাবি ফের্কার দাওয়াত দেওয়ার ধারা এবং বিচ্যুত এই আকিদা-বিশ্বাস জনগণের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার ধারা বন্ধ হয়ে যায়। আপামর জনগণ ওহাবিপন্থীদের ভয়ে যেভাবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল সেই ভয় মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে কেটে যায়।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন