ওহাবি মতবাদঃ পঞ্চম পর্ব

কারবালায় হামলার এই বিপর্যয়কর ঘটনায় মুসলিম বিশ্বে ওহাবিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিলো। সমকালীন কবিগণ এই হত্যাকাণ্ড এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযারের সম্মান ও পবিত্রতা বিনষ্ট করার ঘটনা নিয়ে বহু মর্সিয়া রচনা করেছিলেন। ওহাবিরা বারো বছর ধরে মাঝে

ওহাবি মতবাদঃ পঞ্চম পর্ব
কারবালায় হামলার এই বিপর্যয়কর ঘটনায় মুসলিম বিশ্বে ওহাবিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিলো। সমকালীন কবিগণ এই হত্যাকাণ্ড এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযারের সম্মান ও পবিত্রতা বিনষ্ট করার ঘটনা নিয়ে বহু মর্সিয়া রচনা করেছিলেন। ওহাবিরা বারো বছর ধরে মাঝে মাঝেই কারবালা শহর এবং তার আশেপাশে হামলা চালিয়েছিল। নাজাফ শহরেও তারা হামলা চালায়। হামলা চালিয়ে তারা সেখানকার অর্থসম্পদ লুট করে নেয়। ইরাকের সমকালীন বিশিষ্ট আলেম আল্লামা সাইয়্যেদ জাওয়াদ আমেলি কারবালায় ওহাবিদের আক্রমণ সম্পর্কে লিখেছেনঃ '....(সাউদ) ১২১৬ হিজরিতে হোসাইন (আ) এর মাযারে হামলা চালায়। শিশুসহ বহু মানুষকে সে হত্যা করে। তাদের মালামাল লুট করে নেয় এবং হারাম শরিফের ওপর এমন অত্যাচার চালায় যে আল্লাহই ভালো জানেন।' কারবালায় ওহাবিদের আক্রমণের ফলে তাদের বিরুদ্ধে জনগণের ঘৃণা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছেঁ যে ১২১৮ হিজরির গ্রীষ্মে সাউদের পিতা আব্দুল আযিযকে ৮৩ বছর বয়সে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী ছিলো একজন শিয়া। সাউদের সেনারা ১২২০ হিজরিতেও পবিত্র নাজাফে ইমাম আলী (আ) এর পবিত্র মাযার স্থাপনায় আক্রমণ করে। কিন্তু নাজাফের লোকজনের নজিরবিহীন প্রতিরোধের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
লেখকদের বর্ণনায় এসেছে একদল মানুষ এবং দ্বীনী এলেম শিক্ষার্থী নাজাফের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন কাশেফ আলগাত্তার সাথে দিবারাত্রি এই শহর রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর ঘর ছিলো অস্ত্রের গুদাম। এই মুজাহিদ আলেম নাজাফের প্রতিটি প্রবেশদ্বারে এবং সকল টাওয়ারে লোকজনের সাথে তাঁর কজন ছাত্রকে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে মোতায়েন করেছিলেন। নজদের ইতিহাসবিদ ইবনে বুশরা নাজাফে ওহাবিদের হামলা সম্পর্কে লিখেছেনঃ ১২২০ হিজরিতে বিশাল একটি সেনাদল ইরাকের নাজাফ শহরের দিকে পাঠায়। শহরের পাশে পৌঁছতেই ওহাবি সেনারা বেশ গভীর খন্দকের মুখোমুখি হয়। ওহাবি সেনারা কিছুতেই ওই পরিখা অতিক্রম করতে সক্ষম হলো না। নাজাফ শহরের উঁচু প্রাচীর বা স্থান থেকে তীর নিক্ষেপের ঘটনায় বহু ওহাবি সেনা মারা যায়,বাকিদের কেউ কেউ ফিরে যায় এবং আশেপাশের গ্রামে লুটপাট চালায়। ওহাবিরা এভাবেই মূল ইসলামে ফেরার প্রতারণাপূর্ণ শ্লোগান দিয়ে নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করে। অথচ কোরআনের শিক্ষা হলো মুসলমানদেরকে ঐক্য, সংহতি, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির দিকে আহ্বান জানানো। ইতিহাস সবসময় ভালো এবং মন্দের চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরে যাতে চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ সত্য এবং বাতিলকে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পায়।
তো ওহাবি মতবাদের ইতিহাস হচ্ছে এমন একটি ক্যানভাসের মতো যেখানে উগ্র সহিংসতার বিচিত্র দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। আব্দুল ওহাবের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে বাবার সেই সহিংস ধারা অব্যাহত রাখে। মুহাম্মাদ বিন সাউদের সন্তানও ওহাবি মতবাদ প্রচারে নামে এবং তার অধীনস্থ ভূখণ্ডে ওহাবি ফের্কার বিস্তার ঘটায়। এক্ষেত্রে আব্দুল আযিযের ভূমিকাটা ছিল উল্লেখযোগ্য। সে ওহাবি ফের্কা বিস্তারে গণহত্যা চালিয়ে ব্যাপক ত্রাস সৃষ্টি করেছিলো। আব্দুল আযিয তার ছেলে সাউদসহ পবিত্র শহরগুলোতে রক্তপাত ঘটিয়েছে এবং পবিত্র সব মাযারসহ সকল ধর্মীয় নিদর্শন ধ্বংস করে দিয়েছে। পবিত্র কারবালা শহর এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযার শরিফ ধ্বংস করার পর তারা ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র মক্কা শহর দখল করতে চেয়েছিলো।
পবিত্র কারবালা ও নাজাফ শহরে হামলা চালানোর পর ওহাবিরা ১২১৭ হিজরিতে হেজাজের গুরুত্বপূর্ণ শহর তায়েফে হামলা চালায়। আব্দুল আযিযের সময় তার ছেলে সাউদ ছিল ওহাবিদের সেনা অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে পরিচালিত এই হামলা ছিল নৃশংসতম একটি হামলা। এ সম্পর্কে ইরাকের বিখ্যাত মনীষী কবি জামিল যাহাভি লিখেছেনঃ "ওহাবিদের নোংরাতম কাজগুলোর একটি ছিল তায়েফের গণহত্যা। ছোটোবড়ো কারো পরেই কোনোরকম দয়া করে নি তারা। এমনকি দুধের শিশুকেও তারা মায়ের কোলে মাথা কেটে হত্যা করেছে। ঘরে ঘরে যখন আর কেউ বাকি ছিলো না তখন তারা মসজিদে,বাজারের দোকানে দোকানে গিয়ে লোকজনকে হত্যা করেছে। কোরান পড়া অবস্থায় এমনকি নামায আদায়কালেও তারা হত্যা করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বইপুস্তক, কোরান, হাদিস, বোখারি মুসলিম শরিফসহ হাদিস-ফেকাহর অন্যান্য কিতাবও তারা বাজারের গলিতে ফেলে দিয়ে পদদলিত করেছে।
তায়েফে এই গণহত্যা চালানোর পর ওহাবিরা মক্কার আলেমদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে ওহাবি মতবাদের প্রতি আমন্ত্রণ জানায়। 'হিন্দি' নামে পরিচিত শাহ ফজলে রাসুল কাদেরি "সাইফুল জাব্বার" গ্রন্থে লিখেছেনঃ মক্কার আলেমগণ কাবার পাশে সমবেত হয়েছিলেন ওহাবিদের পত্রের জবাব দেওয়ার জন্যে। এরিমাঝে গণহত্যা-দুর্গত তায়েফের একদল লোক মাসজিদুল হারামে এসে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানালো। মক্কার জনগণের মাঝে তখন শোরগোল পড়ে গেল যে ওহাবিরা খুব শীঘ্রই মক্কায় হামলা চালাবে। তাদের মাঝে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হলো। এদিকে হজ্ব পালনের জন্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আলেমগণ, সুন্নিদের চার মাজহাবের মুফতিগণ ঘোষণা করেন যে ওহাবিরা কাফের এবং অমুসলিম,তাদের সাথে জেহাদ করা ওয়াজিব। তাঁরা মক্কার আমিরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ওহাবিদের মোকাবলায় লড়বার জন্যে।" কিন্তু ওহাবিদের সাথে যুদ্ধ করতে আলেম সমাজ সম্মত হলেও মক্কাবাসীরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলো না। এদিকে সাউদও মক্কায় একটি চিঠি লিখে হুমকি দিয়েছিল-তিন দিনের মধ্যে কাবা যিয়ারতকারীদের সবাইকে কাবা ত্যাগ করতে হবে।
মক্কার গভর্নরসহ আরো অনেক আলেম সাউদের কাছে গিয়ে মক্কাবাসীদের নিরাপত্তা চাইলো। সাউদও একটি চিঠিতে সবাইকে নিরাপত্তা দিয়েছিলো। ১২১৮ হিজরিতে সাউদ বিনাযুদ্ধে মক্কায় প্রবেশ করে। কাবা যিয়ারত করে লোকজনকে সমবেত করে তাদেরকে ওহাবি ফের্কার দাওয়াত দিয়ে বাইয়াত গ্রহণ করতে চাইলো। সেইসাথে সবাইকে বললো ওহাবি সেপাহীদের সাথে মক্কা শহরে যেতে এবং ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক মূল্যবান সব নিদর্শন ধ্বংস করে দিতে। মক্কা দখল করার পর ওহাবিরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে দেয়। নবীজী (সা) এর জন্মস্থানের গম্বুজ, হযরত আলী (আ) এর জন্মস্থানের গম্বুজ, হযরত খাদিজা (সা), আবু বকর (রা) এর স্মৃতিময় নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলো। ওহাবিরা এইসব পবিত্র স্থাপনা ধ্বংস করার সময় তবলা বাজিয়ে গান গেয়ে নেচে নেচে উল্লাস করতো। ওহাবিদের এই জঘন্য কর্মকাণ্ডের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো। অনেকেই এ বিষয়ে বহু বইপুস্তক লিখেছেন।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন