ওহাবি মতবাদঃ চতুর্থ পর্ব

ওহাবি মতবাদঃ চতুর্থ পর্ব

 ওহাবি মতবাদঃ চতুর্থ পর্ব
আলে সাউদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আব্দুল ওহাব তার মতবাদের বিস্তার ঘটায়। বিশেষ করে তারা আশপাশের শহর এবং গোত্রগুলোতে দ্রুততার সাথে প্রচার কাজ শুরু করে। ওহাবি মতবাদ প্রচারের একেবারে শুরুতেই যে কাজটি করা হয় তাহলো উয়াইনা'য় সাহাবাদের এবং আওলিয়াদের মাযারগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। আব্দুল ওহাব আল্লাহর অলিদের শরণাপন্ন হওয়াকে শিরক এবং মূর্তিপূজার মতো অপরাধ বলে গণ্য করতো এবং যারা একাজ করতো তাদেরকে কাফের বলে সাব্যস্ত করতো। তাদেরকে হত্যা করা জায়েয এবং তাদের মালামালকে যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমত বলে ঘোষণা করেছিল। এই ফতোয়া পেয়ে ওহাবের অনুসারীরা হাজার হাজার নিরীহ মুসলমানের রক্ত ঝরিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো সে সময় দিরইয়ের লোকজন অভাবগ্রস্ত ছিল। এই রক্তপাতের পর তাদের ভাষায় প্রচুর গনিমত পাবার ফলে অভাব কেটে যায়। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ বুশ্‌র নজদি' লিখেছেনঃ আমি আমার কাজের শুরুতে দিরইয়া শহরের দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখেছি,কিন্তু পরবর্তীতে এই শহর সাউদের অর্থাৎ মুহাম্মাদ ইবনে সাউদের উত্তর পুরুষের সময়ে বেশ সম্পদশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু কীভাবে এতোটা সম্পদশালী হলো তার বর্ণনা প্রসঙ্গে ইবনে বুশর ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেনঃ নজদের অন্যান্য শহরসহ বিভিন্ন গোত্রের মুসলমানদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের সম্পদ লুট করে এরকম সম্পদশালী হয়েছে। যারাই ওহাবি মতবাদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। হামলা করে যেসব গনিমত পেত তার সবই শায়খ মুহাম্মাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতো আর মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ, তার অনুমতিক্রমে একটা অংশ নিতো। আব্দুল ওহাব তার ইচ্ছামতো এই সম্পদ ব্যবহার করতো। অনেক সময় দেখা যেত ওহাব সকল সম্পদ মাত্র দু'তিন জনের মাঝে বিলি করে দিয়েছে। ওহাব বিভিন্ন শহরের লোকজনকে তার মতবাদের দিকে আমন্ত্রণ জানাতো। যারা গ্রহণ করতো তারা নিরাপদ ছিলো,আর যারা বিরোধিতা করতো তাদের জান-মালকে হালাল ঘোষণা করে আক্রমণ চালাতো। নজদ এবং নজদের বাইরে ওহাবিরা এরকম বহু যুদ্ধ করেছে। ইয়েমেন, হেজাজ, সিরিয়ার উপকণ্ঠ, ইরাকে ওহাবিরা যতো যুদ্ধ করেছে সবই তাদের মতবাদ গ্রহণে অস্বীকৃতির কারণেই করেছে। 'আহসা' শহরের 'ফুসুল' নামের একটি গ্রামের তিন শ' মুসলমানকে ওহাবিরা হত্যা করে তাদের সকল মালামাল লুট করেছে।
আব্দুল ওহাব নিজেকে হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী বলে পরিচয় দিতেন। অথচ এই মাজহাবের মূল প্রবক্তা আহমাদ ইবনে হাম্বলকেও কাফের বলে ঘোষণা করেছিল। কেননা তিনি কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযার যিয়ারত সম্পর্কে বই লিখেছিলেন। ওহাবের দৃষ্টিতে পবিত্র কোনো স্থাপনা যেমন অলি-আওলিয়া, মাসুমিনদের মাযারের মতো মহান স্থাপনাগুলো যিয়ারত করা শির্‌ক, তাই এইসব স্থাপনা যিয়ারতকারীদের জানমাল হরণ করা মোবাহ অর্থাৎ সওয়াবের কাজ। তার এই চরমপন্থী মতবাদ শুরু থেকেই যে আলেমদের বিরোধিতার সম্মুখিন হয়েছিল সেকথা আমরা ইতোপূর্বেও বলেছি। সে সময়কার হেজাজের বিখ্যাত আলেমে দ্বীন এবং মক্কার মুফতি সাইয়্যেদ আহমাদ ইবনে যিনি দাহলান 'খুলাসাতুল কালাম' নামক গ্রন্থে লিখেছেন '১১৬৫ হিজরিতে আব্দুল ওহাবের জীবিতাবস্থায় নজদের একদল ওহাবি আলেম মক্কা শহরে গিয়েছিলেন সেখানকার আলেমদের সাথে বাহাস করার জন্যে। তারা তাদের আকিদার কথা বর্ণনা করতো আর মক্কার আলেমগণ তাদের বক্তব্য খণ্ডন করতেন। কোরান-হাদিস বিরোধী ওহাবি আকিদা মক্কী আলেমগণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁরা ওহাবি মতবাদকে ভিত্তিহীন এবং নষ্ট আকিদা বলে মনে করতেন। ঠিক সে সময় মক্কার কাজি ওহাবি আলেমদেরকে কারাবন্দী করার আদেশ দেন। ঐ আদেশের পর কিছু কিছু ওহাবি আলেম পালিয়ে গিয়েছিলো আর কিছু কিছু আলেমকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
ওহাবি আলেমদেরকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা একটু ভিন্নভাবে ১১৯৫ হিজরি তথা ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দেও ঘটেছিলো। আলে সাউদ এবং ওহাবি ফের্কার মূল কেন্দ্র দিরইয়া শহরের ওহাবি আলেমরা মক্কায় গিয়েছিলো সেখানকার আলেমদের সাথে নতুন তৌহিদ নিয়ে কথা বলার জন্যে। মক্কার আলেমগণ তখনো ওহাবি আলেমদেরকে কাফের বলে তাদেরকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছিল এবং তাদের ওপর হজ্ব করা বা আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো। এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায়,তাহলো ওহাবিরা কেন তাদের আকিদা নিয়ে মক্কায় যেত? জবাব হলো মক্কা শহর ছিলো ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান ও প্রাণকেন্দ্র। তাই ওহাবিরা চেয়েছিল মক্কা দখল করে তাকে তাদের ধর্মীয় কেন্দ্র বানাতে যাতে মুসলমানরা ইসলামের পরিবর্তে ওহাবি আকিদায় দীক্ষিত হয়।
ইতোমধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ ১১৭৯ হিজরি তথা ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁরই পুত্র আব্দুল আযিয। বাবার মতো আব্দুল আযিযও ওহাবের সাথে মৈত্রীতে আব্দ্ধ হন। বাবা বেঁচে থাকতে আব্দুল আযিয পিতার সেনাবাহিনীর একাংশের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন,আব্দুল ওহাবের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাই সৌদি আরবের বিরাট একটি অংশ দখল করতে সক্ষম হন তিনি। ওহাবি মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব শেষ পর্যন্ত ১২০৭ হিজরিতে অর্থাৎ ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ৯৬ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা ওহাবি মতবাদ প্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। তারই উত্তরপুরুষ আব্দুল লতিফ ওহাবি মতবাদের ওপর বহু বই লিখেছেন। এভাবে ওহাবের ছেলেরা, পৌত্রেরা ভ্রান্ত ওই মতবাদ ব্যাখ্যা করে বহু বই লিখেছেন।
ওহাবিদের চরমপন্থার ভয়াবহ একটি নিদর্শন হলো ইরাকের পবিত্র কারবালা শহরে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার যিয়ারতকারীকে হত্যা করা এবং সেখানে অবস্থিত ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযারে হামলা চালানো। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে সাউদ বিন আব্দুল আযিয,নজদের জঙ্গি আরব সেনাদের মধ্য থেকে বিশ হাজারের একটি বাহিনীকে কারবালা শহরে হামলার উদ্দেশ্যে পাঠান। ঐ সেনারা প্রতমে কারবালা শহর অবরোধ করে এভং পরে জোর করে শহরে প্রবেশ করে। সে সময় কারবালা ছিলো ব্যাপক খাতিমান ও সম্মানীয়। ইরান, তুরস্ক এভং আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যিয়ারতকারীগণ কারবালায় যেতেন ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযার যিয়ারত করার জন্যে। সাউদ এই যিয়ারতকারী এবং তাদেরকে আশ্রয় প্রদানকারীকে কাফের বলে ঘোষণা করে সবাইকে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করে। আত্মগোপনকারী কিংবা পলায়নকারীরা ছাড়া কেউ তাদের হাত থেকে রক্ষা পায় নি।
ইতিহাসে এসেছে ওহাবিরা কারবালা শহরের অন্তত ৫ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। সাউদের এই নৃশংস সেনারা নবীজীর সন্তান হোসাইন ইবনে আলি (আ) এর মাযারের মর্যাদাটুকুও রাখে নি,মাযারটিকে তারা ধ্বংস করে দিয়ে সোনা-রূপাসহ সকল সম্পদ লুট করে নিয়ে গিয়েছিলো। ভয়াবহ সেই ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো সে সময়।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন