ওহাবি মতবাদঃ তৃতীয় পর্ব

আব্দুল ওহাবের ভ্রান্ত আকিদার বিরুদ্ধে মুসলিম জনগোষ্ঠি তো বটেই, এমনকি তার পিতা এবং আপন ভাইও ঐ মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার ভাই শায়খ সোলাইমানের জীবনকথায় এসেছে আব্দুল ওহাবের পিতা জীবিতকালে ছেলের এ ধরনের আকিদা প্রচারের ব্যাপারে বাধা দিয়েছিলেন। তবে হিজরি

 ওহাবি মতবাদঃ তৃতীয় পর্ব
আব্দুল ওহাবের ভ্রান্ত আকিদার বিরুদ্ধে মুসলিম জনগোষ্ঠি তো বটেই, এমনকি তার পিতা এবং আপন ভাইও ঐ মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার ভাই শায়খ সোলাইমানের জীবনকথায় এসেছে আব্দুল ওহাবের পিতা জীবিতকালে ছেলের এ ধরনের আকিদা প্রচারের ব্যাপারে বাধা দিয়েছিলেন। তবে হিজরি ১১৫৩ সালে পিতার মৃত্যুর পর অনগ্রসর কিছু লোকের মাঝে তার আকিদা প্রচারের সুযোগ পায়। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের আকিদার বিষয়টি স্পষ্ট হবার পর তার বিরুদ্ধে বড়ো বড়ো বহু আলেম উঠে আসেন। স্বয়ং তার ভাই শায়খ সোলায়মান-যিনি ছিলেন একজন হাম্বলি আলেম-তিনিও ওহাবের আকিদা প্রত্যাখ্যান করে একটি বই লেখেন। ইমানী দায়িত্বের অংশ হিসেবে ওহাবকে কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বহু চিঠিও লেখেন তিনি এবং ইসলামের ভেতর এসব বেদায়াত প্রবেশ করানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। একটি পত্রে তিনি সূরা নিসা'র ১১৫ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করেন যেখানে লেখা রয়েছেঃ 'সত্য সুস্পষ্ট হবার পর যে কেউ নবীজীর বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য কোনো পথের অনুসরণ করে, আমরা তাকে সেই বাতিল পথেই চলতে দেবো এবং দোযখে প্রবেশ করাবো,সেই স্থানটি খুবই বাজে।'
তারপরও আব্দুল ওহাব তার জাহেলি বিশ্বাসের ওপর স্থির থাকে এবং যে-ই তার দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে তাকেই কাফের বলে সাব্যস্ত করে। সোলায়মান এক জায়গায় আব্দুল ওহাবের মূর্খতার কথা উল্লেখ করে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ রাসূলে আকরাম (সা) বলেছেন 'কোনো বিষয়ে যার সঠিক জ্ঞান নেই সে বিষয়ে তার উচিত নয় মতামত ব্যক্ত করা,বরং তার উচিত হলো যেটা সে জানে না তা একজন জ্ঞানী লোকের কাছ থেকে জেনে নেওয়া'। সূরা আম্বিয়ার ৭ নম্বর আয়াতেও এসেছেঃ فاَسئلوا أهلَ الذکر ان کنتم لا تعلمون অর্থাৎ'যদি না জানো তাহলে যে জানে তার কাছে জিজ্ঞেস করো।'সেজন্যেই শায়খ সোলায়মান বলতেন-ওহাবের জ্ঞানের অভাব রয়েছে,তাই তার উচিত যারা জ্ঞানী ও ইসলামী চিন্তাবিদ তাদেরকে জিজ্ঞেস করা এবং তাদের অনুসরণ করা।
যাই হোক ওহাবের বিরুদ্ধে সে সময় এতোসব বিরোধিতা সত্ত্বেও সে তার ভ্রান্ত আকিদাকে নাজদ অঞ্চলের কিছু লোকের মাঝে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিল। সমাজ বিজ্ঞানীগণ এর কারণ হিসেবে বলেছেন ঐ এলাকাটি ছিল প্রত্যন্ত মরু,তাদের লেখাপড়া কিংবা দ্বীনী জ্ঞান ছিল একেবারেই নগণ্য। সেই এলাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৈন্যতার কারণেই সেখানকার কিছু লোকজন ওহাবের আকিদা গ্রহণ করেছিল। এই শ্রেণীর লোকজনকে যে-কেউ খুব সহজেই প্রতারিত করতে পারে। তাছাড়া ওহাবের কথাবার্তার ভঙ্গিটাও ছিল বেশ আকর্ষণীয় এবং মুগ্ধকর। সবোর্পরি মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শক্তির ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা ছিল তার পেছনে।
এমনিতেই পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো এ সময় চারদিক থেকে মুসলিম বিশ্বকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। ব্রিটিশরা পূর্বদিক থেকে ভারতের বৃহৎ অংশ দখল করে পারস্য উপসাগর উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। তারা প্রতিটি মুহূর্তে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। ফরাশিরাও নেপোলিয়নের নেতৃত্বে মিশর, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন দখল করে ভারতের দিকে যাবার চিন্তা করছিলো। রুশরাও চেয়েছিলো ইরান এবং তুরস্কে বারবার হামলা চালিয়ে তাদের সাম্রাজ্য একদিক থেকে সেই ফিলিস্তিন পর্যন্ত অন্যদিকে সুদূর পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে। সে সময়কার আমেরিকাও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাদের লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল। তারা লিবিয়া এবং আলজেরিয়ায় গুলিবর্ষণ করে মুসলিম বিশ্বে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এরকম একটি কঠিন পরিস্থিতিতে যখন শত্রুদের মোকাবেলায় মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতামূলক হৃদ্যতার প্রয়োজন ছিলো,ঠিক সে সময় মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব ভ্রান্ত মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে কাফের সাব্যস্ত করে মুসলিম ঐক্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিলো।
এদের মাঝে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদই ছিলো সবচেয়ে অগ্রসর। তারা মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করে তাদের সম্পদ লুট করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এই ফাটল সৃষ্টি করার জন্যে মুসলিম বিশ্বে মাজহাবগত মতপার্থক্য সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। এ কারণেই কোনো কোনো ঐতিহাসিক ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের স্বার্থসিদ্ধির সাথে ওহাবি ফের্কার আবির্ভাবের যোগসূত্রের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেন নি। ইতিহাসে ব্রিটিশ গোয়েন্দা মিস্টার হ্যাম্পারের সাথে আব্দুল ওহাবের যোগাযোগের কথা এসেছে। হ্যাম্পার মুসলিম দেশগুলোতে বৃটেনের পক্ষে গোয়েন্দাবৃত্তি করতো। সে ইসলামী বেশভুষায় মূলত মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির পথ খুজেঁ বেড়াতো। হ্যাম্পার তার ডায়েরিতে ব্যক্তিগত স্মৃতিকথায় লিখেছে ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলীয় বসরা শহরে আব্দুল ওহাবের সাথে তার দেখা হয়। ওহাব সম্পর্কে তার মূল্যায়ন এরকমঃ 'মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের মাঝে আমি আমার হারানো আমিকে খুজেঁ পেলাম। মাজহাব সংরক্ষণে তার নির্লিপ্তি, তার আত্মম্ভরি ও অহমিকাপূর্ণ আত্মা ও মানসিকতা, সমকালীন আলেমদের প্রতি তার ঘৃণা, স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি এমনকি চার খলিফা সম্পর্কে গুরুত্বহীনতা ইত্যাদি ছিল তার চিন্তাগত বৈশিষ্ট্য। কোরআন ও সুন্নাহর সামান্য জ্ঞানই ছিল মূল ভিত্তি। ওহাবের এইসব গুণাবলিই ছিল দুর্বল স্থান যার মধ্য দিয়ে তার ভেতরে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ ঘটে।'
হ্যাম্পারের বক্তব্য থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় তাহলো সে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবকে ওহাবি ফের্কা প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলো এবং এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার তাকে ও মুহাম্মাদ ইবনে সাউদকে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেবে বলেও ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাধ সেধেছে সে সময়কার আলেম সমাজ। ওহাবের ভাই,পিতাসহ সবাই তার ভ্রান্ত আকিদার বিরোধিতা করেছে। পিতার মৃত্যুর পর ওহাব যখন যেখানে গেছে কিছুদিন পরপর সেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। সবশেষে এসে ভিড়েছে নজদের বিখ্যাত শহর দারিয়ার গভর্নর মুহাম্মাদ ইবনে সাউদের কাছে। ইনিই ছিলেন আলে সউদের পূর্বপুরুষ। তার সাথে ওহাবের চুক্তি হয় উগ্র ওহাবি চিন্তাধারা বিকাশের মধ্য দিয়ে ইবনে সাউদের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটানো হবে। শাসক থাকবেন ইবনে সাউদ আর ধর্মীয় প্রচারণা চালাবে ওহাব। এই চুক্তিকে আরো মজবুত করার জন্যে দুই পরিবার বৈবাহিক সূত্রেও আবদ্ধ হয়।
সূত্রঃইন্টারনেট

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন