হযরত মোহাম্মাদ (সা:) ও ইয়াহুদী চক্রান্ত

হযরত মোহাম্মাদ (সা:) ও ইয়াহুদী চক্রান্ত

হযরত মোহাম্মাদ (সা:) ও ইয়াহুদী চক্রান্ত   
মানবজাতির পর্যায়ক্রমিক পূর্ণতার জন্য একজন পথ প্রদর্শকের প্রয়োজন, আর তাই মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হেদায়েতের উদ্দেশ্যে একের পর এক পয়গম্বর প্রেরণ করেছেন, যাতে করে তারা মানবজাতিকে পূর্ণতার শীর্ষে পৌছিয়ে দিতে পারেন। আর হযরত মুসা (আ:) ও এই কারণেই প্রেরিত হয়েছিলেন।
কিন্তু ইতিহাসের দীর্ঘ সময়ে তার অনুসারীরা নিজেদের পার্থিব সুবিধার জন্য দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করেছে। এমনকি যদিও ইয়াহুদীরা তাওরাতে বর্ণিত হযরত মোহাম্মাদ (সা:) এর নবুওতের সকল আলামত সম্পর্কে অবগত ও তাঁর আবির্ভাবের অপেক্ষায় ছিল কিন্তু হযরত মোহাম্মাদ (সা:) এর বেসাতের পর ইসলামি আইন যেহেতু তাদের পার্থিব চাহিদার অন্তরায় ছিল, তারা তাঁর নবুওতকে অস্বীকার করল এবং তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াল। পয়গম্বর (সা:) এর যুগে ইয়াহুদীদের সম্পাদিত কর্মসমূহ যদি পর্যালোচনা করা হয়, হযরতের বিরুদ্ধে তাদের বিরোধিতা, বিরোধিতার কারণ ও তার পরিনতি সম্পর্কে আমরা খুব সহজেই জানতে পারব।
 
ইয়াহুদী মুহাজির:
জাযিরাতুল আরবে ইয়াহুদীদের মোহাজেরাতের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে, যার মধ্যে:
১। ফিলিস্তিনের উপর বাদশা আশুর, বাখতুন নাসর বা নাবুকাদ নাসরের হামলার এবং নিজ দেশ থেকে ইয়াহুদীদের উদ্বাস্তু হবার পর যার কিছু অংশ জাযিরাতুল আরবে হিজরাত করে।
২। ৭০ খ্রি: টিটুসের হামলার কারনে ইয়াহুদীদের ইবাদতখানা ধ্বংশ হবার পর তাদের এক অংশ ফিলিস্তিন থেকে ছিন্নমুল হয়ে পরে এবং ১৩২ খ্রি: রোমীয়দের অত্যাচার ও নিপিড়নের কারণে তাদের কিছু সংখ্যক এই অঞ্চলে হিজরাত করে।
৩। হযরত সোলায়মান নবী (আ:) এর সময়ে ও তাঁর পরে ব্যবসা বাণিজ্যর কারণে সাবা দেশে ভ্রমন করে, আর জাযিরাতুল আরবের অধিবাসীরা ইয়াহুদীদের নিয়ম নীতি ও তাদের ধর্মের সাথে পরিচিতি লাভ করে।
৪। বনি ইসরাইলের একদল তাদের বাদশার নিদের্শ অমান্য করাতে নিজ ভূখন্ড হতে বিতাড়িত হয়ে হেজাজে হিজরাত করে। ইয়াহুদীদের মতে বাদশা তালুতের সময় এই ঘটনা ঘটেছিল।
৫। অন্য ঘটনা অনুসারে, ইয়াহুদীরা হযরত দাউদ (আ:) এর বংশধর এবং হযরত দাউদ (আ:) এর এক সন্তানের হত্যা করার পরিপ্রেক্ষিতে তারা জাযিরাতুল আরবে পালিয়ে যায়।
৬। কারো কারো মতে ইয়াহুদীরা বাবেলের বাদশা নাবুনীদের সৈন্য বাহীনিতে ছিল যারা জাযিরাতুল আরবে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু নাবুনীদের আলামত ও নিদর্শন সমূহ এই বিষয়ে কোন সহায়তা করে না।
৭। ফিলিস্তিনে ইয়াহুদীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চারণভূমির পেছনে তারা পার্শ্ববর্তী ভূখন্ড যেমন: মিসর ও জাযিরাতুল আরবে গমন করে।
৮। কিছু হাদীস বর্ণনা মতে ইয়াহুদীরা জাযিরাতুল আরবে নতুন পয়গম্বরের আবির্ভাবের কথা জানতো আর তাই জাযিরাতুল আরবে হিজরাত করে।
অবশ্য উপরোলক্ষিত কারণসমূহ এক দৃষ্টিভঙ্গি মাত্র। কেননা জাযিরাতুল আরবে ইয়াহুদীদের হিজরাতের ইতিহাস সম্পর্কে লিখিত কোন দলিল -প্রমাণ নেই।
মদীনার ইয়াহুদীরা সদ্বংশীয় (বংশ পরমপরায় ইয়াহুদী) নাকি স্হানীয় (ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহনকারী আরব) এ সম্পর্কে ভেজাল ও বিক্ষিপ্ত কিছু হাদীস রয়েছে। কিন্তু মনে হয় সদ্বংশীয় ও স্হানীয় এ দু’ধরনের ইয়াহুদীরাই মদীনাতে বসবাস করত। অনেকের মতে: স্থানীয় আরবদের ইয়াহুদী হওয়ার কারন হচ্ছে জাহেলিয়্যাত যুগে মায়েরা সন্তান হওয়ার জন্য মানত করত যে, তাদের সন্তান হলে তাদেরকে ইয়াহুদী করবে। অবশ্য এ দলটি হযরত মোহাম্মাদ (সা:) এর বেসাতের পর যখন মুসলমান হয়ে যায়, তাদের সন্তানদের মুসলমান হওয়ার জন্য বাধ্য করত এমতাবস্থায় এই আয়াতটি "  لا اكراه‌ في‌ الدّين‌ِ قَد تَبَّيَن‌َ الرُشدُمِن‌َ الْغَي" (সুরা বাকারা আয়াত: ২৫৬।) নাযিল হয়। আর তাদেরকে স্বরণ করিয়ে দেয়া হয় যে দ্বীনের মধ্যে কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা বা জবরদস্তির স্থান নাই। অবশ্য মদীনাতে ইয়াহুদীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এরূপ ছিল যে, আউস ও খাযরাজ সম্প্রদায় সাবা ভূখন্ড থেকে মদীনাতে প্রবেশের পূর্বে মদীনার অর্থনেতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রন ছিল ইয়াহুদীদের হাতে কিন্তু এ দুই সম্প্রদায় মদীনাতে প্রবেশের ফলে ইয়াহুদীরা তাদের অবন্থানকে ক্ষতির সম্মুখিন দেখতে পায়, নিরুপায় হয়ে তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। অবশ্য এই চুক্তিতে ইয়াহুদীরা আউস ও খাযরাজের তুলনায় নিচের অবস্থানে ছিল। সাংস্কৃতিক দিক থেকে ইয়াহুদীরা বেদুইন আরবদের ন্যায় জীবন যাপন করত। শিক্ষিত বলতে তাদের ধর্মীয় ওলামারাই ছিলেন। ইয়াহুদীরা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নেয়ার জন্য আউস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে অনৈক্যের সৃষ্টি করতো। হযরত মোহাম্মাদ (সা:) ও যখন মদীনাতে প্রবেশ করেন ইয়াহুদীদের এই কূটনীতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন, এ কারণেই মদীনার অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত ইয়াহুদীদের সাথে শান্তি চুক্তি করেন, যাতে করে মুশরিকদের সাথে যুদ্ধের জন্য নিজেদের শক্তিসমূহ একত্রিত ও কেন্দ্রিভুত করতে পারেন। এই শান্তি চুক্তি অনুযায়ী ইয়াহুদীরা তাদের ধর্মের ক্ষেত্রে স্বাধীন ছিল কিন্তু কর দেয়া তাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল এবং শত্রুদের আক্রমনের ক্ষেত্রে মুসলমান ও ইয়াহুদীরা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য ছিল।
 
ইয়াহুদীদের প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রসমূহ:
ইয়াহুদীদের প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রসমূহকে নিম্নে আলোচনা করা হল:
রাসুলুল্লাহ (সা:) এর বিরুদ্ধে ইয়াহুদীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ছিল সামরিক দিক থেকে। গভীর ভাবে বলতে গেলে ইয়াহুদীদের দলিল ও প্রমাণের ভিত্তিতে ইতিহাসের দীর্ঘ সময়ে তারা অনেক পয়গম্বরকে কষ্ট দিয়েছে ও হত্যা করেছে। এমনকি রাসুলুল্লাহ (সা:) এর সাথে আবদ্ধ হওয়া চুক্তিও তারা ভঙ্গ করেছে এবং নিজেদের পার্থিব চাহিদা পূরনার্থে নবী করিম (সা:) এর বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতায় লিপ্ত হয়েছে। বাহ্যিক ভাবে অনেকে মুসলমান হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে নিয়োজিত ছিল এবং মুসলমানদেরকে মহা নবী (সা:) এর প্রতি সাহায্যের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করতো। এমতাবস্থায় পবিত্র কোরান মজীদের সুরা আলে ইমরানের ১১৮ নং আয়াত নাযিল হয়:
 " يا اَيُّهَا الذّين‌َا'مَنوُا لاتَتَّخِذوا بِطانَة‌ٌ مِن‌ْ دوُنِكُم‌ لا يَألوُنَكُم‌ْ خَب'الاً وَدّوا ما عَنِتُّم‌ْ. قَدْ بَدَت‌ِالبغَضْاءُ مِن‌ْ اَفْواهِهِم‌ْ و ما تُخفِي‌ صُدوُرُهُم‌ْ اكْبَرُ قَدْ بَيَّنّا لَكُم‌ُ الأيات‌ِ اِن‌ْ كُنتُم‌تَعْقِلوُن‌"
আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে মুসলমানদের নির্দেশ দেন যে, তারা যেন নিজেদের গোপন রহস্যকে অপরিচিত লোকদের নিকট ফাঁস না করে। আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে শত্রুদের অন্তরে লুকায়িত গুপ্ত ইচ্ছা সম্পর্কে মুসলমানদের অবগত করেন এবং এটা মনে করিয়ে দেন যে তারা বন্ধুত্বের যোগ্য নয়। আর এভাবেই ইয়াহুদীদের পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যায়। ইয়াহুদীদের গুপ্তচরবৃত্তির এক প্রকাশ্য উদাহরণ হচ্ছে "আহযাব" যুদ্ধ। মুসলমানদের সাথে তারা চুক্তিতে আবদ্ধ থাকা সত্বেও এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুদেরকে সহযোগিতা করে। শত্রুরা পরাজিত হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা:) চুক্তিপত্র অনুযায়ী তাদের সাথে ব্যবহার করেন।
মদীনাতে রসুলুল্লাহর (সা:) সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি ছিল আউস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে বিদ্যমান ২০ বছরের সমস্যার সমাধান করা। এ দুটি গোত্রের মধ্যে সন্ধি স্থাপনের পর ইয়াহুদীরা বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে লাগল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা:) জনগণকে সতর্ক করে দেন এবং পুনরায় তাদের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করেন। পবিত্র কোরান মজীদের সুরা আলে ইমরানের ১০০ নং আয়াত এরই পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল হয় এবং মুসলমানদেরকে আহলে কেতাবের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করে:
“ يا اَيُّه'ا الَّذين‌َ امَنوُا اِن‌ْ تُطيعُوا فَريقاً مِن‌ الَّذين‌َأوُتوُا الكتاب‌َ يَرُدُّكُم‌ بَعْدَ ايمانِكُم‌ كافِرين‌. ”
এই আয়াতটি তৎকালীন মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে নাযিল হলেও মূলত সকল যুগের সকল মুসলমানদের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য এবং তাদেরকে শত্রুদের ষড়যন্ত্র হতে সতর্ক করে। কিন্ত এই আয়াত মদীনাতে মুসলমানদের হিজরাতের প্রথম দিকে মুশরিক ও ইয়াহুদদের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়। তারা বিভিন্ন পন্থায় রাসুলুল্লাহ (সা:) এর উপর চাপ প্রয়োগ করছিল যেমন: মুশরিকদের বিপক্ষে বদর ও ওহদের যুদ্ধ এবং বনি কাইনাকাহ ও বনি কুরাইযা ও ইয়াহুদীদের বিপরীতে খাইবারের যুদ্ধ।
ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইয়াহুদী ষড়যন্ত্রের একটি দিক ছিল মুসলিম উম্মার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হলে ইয়াহুদী বনি কাইনাকাহ গোত্র প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হয় এবং ফিৎনা শুরু করে ও বিভিন্ন অবমাননাকর শ্লোগান দিতে থাকে। রাসুল (সা:) তাদের উত্তরে তাওরাতে বর্ণিত নিজ পয়গম্বরীর আলামতসমূহ স্বরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে সতর্ক করে দেন। কিন্তু বনি কাইনাকাহ  আল্লাহর রাসুল (সা:) এর সতর্ক বাণীকে পরওয়া না করে বরং তার বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রদর্শণ করে এবং রাসুলুল্লাহকে (সা:) যুদ্ধ করতে বাধ্য করে। তারপরও রাসুলুল্লাহ (সা:) নিরবতা অবলম্বণ করেন কিন্তু মুসলমানরা প্রতিশোধের প্রতিক্ষায় ছিল। এমতাবস্থায় সুরা আলে ইমরানের ১২ ও ১৩ নং আয়াত নাযিল হয় এবং ইয়াহুদীদের নিকটবর্তী পরাজয় ও তাদের জাহান্নামে পুনরুথ্থান সম্পর্কে খবর দেয়। কিন্তু  বনি কাইনাকাহর ইয়াহুদীরা নিজেদের ফিৎনা সৃষ্টিমূলক কর্মতৎপরতাকে বজায় রাখে, যেমন: দ্বিতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে বনি কাইনাকাহ গোত্রের এক যুবক কোন মুসলমান মহিলাকে অপমান করায় মহিলাটি সাহায্য প্রার্থণা করে। এক মুসলমান পুরুষ সেই যুবকটিকে হত্যা করে বিপরীতে ইয়াহুদীরাও সেই পুরুষকে হত্যা করে। অতঃপর ইয়াহুদীরা নিজেদের দুর্গে প্রবেশ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি করতে থাকে। দুর্গ জয় করার পর রাসুলুল্লাহ (সা:) তাদেরকে মদীনা ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।
ইয়াহুদীদের অন্য এক গোত্র বনি নাযির রাসুলুল্লাহকে (সা:) হত্যা করার পরিকল্পনার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর (সা:) সাথে আবদ্ধ চুক্তিকে ভঙ্গ করে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুলকে (সা:) তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং তাদের চক্রান্তকে ধুলিস্বাত করেন। কেনানা ইবনে সুওয়াইরা ( كنانة‌ بن‌ صويرا ) নামক এক ইয়াহুদী বলে: তাওরাতের কসম দিয়ে বলছি, তিনি হচ্ছেন আল্লাহর রাসুল, যার আলামতসমূহ তাওরাতে এসেছে। কিন্তু ইয়াহুদীরা তার কথাকে মুল্য দেয়নি, বরং ইয়াহুদীদের আরেক গোত্র রাসুলুল্লাহর (সা:) বিরুদ্ধে তাদের শত্রুতাকে প্রকাশ করে। এই খিয়ানতের প্রতিত্তুরে  রাসুলুল্লাহ (সা:) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইচ্ছা করেন, ফলে হয় তারা মুসলমান হত অথবা নিজ দেশ ত্যাগ করতো। তারা নিজেদের গোঁড়ামির কারণে দেশ ত্যাগ করার পথকে বেছে নেয়। অনেক মুফাসসেরগণ সুরা হাশরের শানে নুযুলকে এ ঘটনা মনে করেন। আল্লাহ তায়ালা এই সুরাতে উল্লেখ করেন যে দেশ ত্যাগ হচ্চে তাদের শাস্তি আর বলেন: আল্লাহ তায়ালা যদি এই শাস্তি নির্ধারণ না করতেন তাহলে দুনিয়ার আযাব ব্যতিত আখিরাতেও তারা শাস্তি ভোগ করতো।
ইয়াহুদী প্রধানদের চলতে থাকা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে তারা অনান্য গোত্র ও মূর্তি পুজারিদের সাথে একত্র হয়ে দল গঠন করে এবং মুসলমানদের বিপরীতে অবস্থান নেয় এবং মুসলমানদের প্রতিপক্ষদের সামরিক ও অর্থনেতিকভাবে সাহায্য করে। ইয়াহুদী প্রধানরা সাধারণ ইয়াহুদীদেরকে ফন্দির মাধ্যমে বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের কাজে উস্কানি ও উৎসাহ প্রদান করে। বনি নাযির গোত্রের প্রধানরা নিজেদের খিয়ানতের কারণে বিতাড়িত হয়ে কিছু সংখ্যক শ্যাম নগরে ও কিছু সংখ্যক খাইবারে আশ্রয় নেয়। অতঃপর এই দু’দল মক্কায় যায় এবং কুরাইশ বংশের লোকদেরকে রাসুলুল্লাহ (সা:) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলে। সুতরাং বলা যেতে পারে বনি নাযিরের প্রধানেরা ও বনি ওয়ায়েল (بني‌وائل) গোত্রের কিছু লোক একত্র হয়ে “আহযাব যুদ্ধের” পটভূমি তৈরী করে। আহযাব যুদ্ধের পরিকল্পনা যা ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য করা হয়েছিল তা আরব ইতিহাসের এক নজিরবিহীন ঘ্টনা ছিল। বনি নাযিরের প্রধানরা প্রলোভন ও উস্কানির মাধ্যমে ইয়াহুদী ও মুর্তি পূজারিদের বিভিন্ন গোত্র সমন্বয়ে ১০ হাজারের এক সৈন্য বাহিনী গড়ে তোলে এবং তিন ভাগে ভাগ হয়ে হামলার জন্য মদীনার পথে রওয়ানা হয়। তারা যখন মদীনায় প্রবেশ করে শহরের চারপার্শ্বে খাদ বা পরিখা দেখতে পায় যা কারো পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না।
অনেকে বলল এটি আরব পরিকল্পনা নয় বরং কোন ইরানি এই প্রস্তাব করেছে। যখন তারা দেখলো অতিক্রম করা সম্ভব নয়, তারা সেখানে শিবির গেড়ে বসে এবং দফায় দফায় হামলা চালাতে খাকে কিন্তু মুসলমানরা তার মোকাবেলা করে। তারা প্রায় এক মাস কোন প্রকার ফলাফল অর্জন ছাড়া সেখানে অবস্থান করে, অবশেষে বনি কুরাইযার প্রধানদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, এবং তাদেরকে চুক্তি ভঙ্গ ও মদীনার ভিতর থেকে মুসলমানদের সাথে বিরোধিতা করতে উস্কানি দিতে থাকে, যাতে তারা পরিখা অতিক্রম করতে পারে। প্রথমদিকে বনি কুরাইযা এ উস্কানি বা প্রস্তাব গ্রহন করেনি কিন্তু কাফের ও ইয়াহুদী প্রধানদের অব্যাহত জোরাজুরির মুখে রাজি হয়। তাদের মধ্য থেকে এক বৃদ্ধ ইয়াহুদী তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে: যদি এই মোহাম্মাদ (সা:) তাওরাতে বর্ণিত সেই পয়গম্বর হয়ে থাকে, তাহলে কোন সৈন্য বাহিনীই তাঁর সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা রাখে না, কিন্ত হাই ইবনে আখতাব নামক এক ইয়াহুদী প্রধান বলল: মোহাম্মাদ (সা:) হচ্ছে হযরত ইসমাইলের (আ:) বংশধর কিন্তু তাওরাতে যে পয়গম্বরের কথা বর্ণিত হয়েছে তিনি হচ্ছেন বনি ইসরাইলের বংশধর অর্থাৎ হযরত ইয়াকু্বের (আ:) সন্তান। বনি কুরাইযা নিজেদের ওয়াদা ভঙ্গ করার পর যুদ্ধ ব্যতীত তাদের জন্য অন্য কোন পথ খোলা ছিল না, সুতরাং তারা বিভিন্ন পন্থায় ষড়যন্ত্র করতে থাকলো। রাসুলুল্লাহ (সা:) মুসলমানদেরকে বিজয়ের সুসংবাদ প্রদান করেন। বনি কুরাইযা পরিকল্পনা করলো যে, দু’হাজার সৈন্য নিয়ে শহরের অভ্যন্তরে হামলা করে লুটতরাজ করবে। রাসুলুল্লাহ (সা:) পাঁচশ জনকে শহরের অভ্যন্তরে নজরদারি ও তাকবির (আল্লাহু আকবার ধ্বনি) দেয়ার কাজে নিয়োজিত করেন যাতে করে শিশু ও মহিলারা নিরাপত্তা বোধ করে। আল্লাহ তায়ালা সুরা আহযাবের ১০ নং আয়াতে এ বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন: প্রচন্ড ভয়ে মুসলমানদের চোখ বিস্বয়বিহবল হয়ে গিয়েছিল আর তারা মৃত্যুকে ভয় করছিল:
“اذْ جاءوُكُم‌ْ مِن‌ْ فَوْقِكُم‌ْ و مِن‌ْاَسْفَل‌َ مِنْكُم‌ْ و اِذْ ز'اغَت‌ِ الأبْصارُ وَ بَلَغَت‌ِ القُلُوب‌ُ الحَن'اجِرَ و تَظُنُّون‌َ بِاَللهِ الظُّنُوناَ “.
এ সময় নায়িম ইবনে মাসউদ নামে এক ইয়াহুদী লোক, যে নতুন মুসলমান হয়েছিল, সে পরিস্থিতি মোকাবেলায় এক নতুন পদ্ধতি প্রদান করে। যার ফলে ইয়াহুদ ও মূর্তি পুজারিদের মধ্যে ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। দু’দলই নিজেদেরকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নেয় এবং পিছুপা হয়। আল্লাহ তায়ালা হযরত জিবরাইল (আ:) এর মাধ্যমে রাসুলুল্লাহর (সা:) প্রতি ওহি নাযিল করেন যেন বনী কুরাইযাকে শাস্তি দেওয়া হয়। রাসুলুল্লাহ (সা:) ও চুক্তিপত্র অনুযায়ী তাদের সাথে ব্যবহার করেন।
রাসুলুল্লাহ (সা:) এর বিরুদ্ধে ইয়াহুদীদের সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র:
ইসলাম ধর্মের কর্মসূচির মধ্যে একটি হচ্ছে মুনাফাখোর ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠীদের নিয়ন্ত্রন করা। আর তাই যারা এ কাজে জড়িত ছিল তারা ইসলামের ধ্বংসের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, উদাহরণ স্বরূপ আক্বিদা বিশ্বাসের বিষয়ে ইয়াহুদীরা আল্লাহ তায়ালার অমুখাপেক্ষিতা সম্পর্কে জানা সত্বেও তাঁর প্রতি দারিদ্রতার অপবাদ দেয়, আর এ কাজ, যা বড় গোনাহ সমূহের মধ্যে একটি আর তা নবীদের হত্যা করার সমপর্যায়ের। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অন্তর্জ্বালাময় আযাবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন:
“لَقَدْ سَمِع‌َ اللهُ قَول‌َ الَّذين‌َ قالُوا اِن‌َّ اللهَ فَقيرٌ وَ نَحْن‌ُ اَغْنياءُ سَنكْتُب‌ُ ما قالوُا و قَتْلُهُم‌ُ الانبياءَ بِغَيْرِحَق‌ّ و نَقوُل‌ُ ذُوقوُا عَذاب‌َ الحَريق”.
(আলে ইমরান, আয়াত: ১৮১) এই আয়াতের শানে নুযুলে বলা হয় যে, যখন আল্লাহ তায়ালা মানুষকে নামায ও যাকাতের প্রতি আহবান জানান, তখন ইয়াহুদীরা বলে: খোদা দরিদ্র ও মুখাপেক্ষি কিন্তু আমরা আমাদের পরিবার পরিজনদের রুজি রিযিকে সম্প্রসারণ দিয়েছি তাই আমরা ধনী ও অমুখাপেক্ষি। যারা পয়গম্বরদেরকে হত্যা করতে পারে তাদের কাছ থেকে এ ধরনের অপবাদ ও অবমাননা অপ্রত্যাশিত নয়। আল্লামা তাবাতাবায়ী (রা:) এই আয়াতের তফসীরে বলেন: সম্ভবত সাধারণ মুসলমানদের দারিদ্রতা দেখে ও তাদেরকে কটাক্ষ ও মানসিকভাবে আঘাতের জন্য ইয়াহুদীরা এ কথা বলেছে।
ইয়াহুদীদের সাংস্কৃতি চক্রান্তের মধ্যে আরেকটি হচ্ছে এই যে, তারা বলতো: কোরআনের বিষয়বস্তু হচ্ছে তাওরাতেরই বিষয়বস্তু যাকে বিকৃত করা হয়েছে এবং কোরআনে পারস্পরিক বৈপরীত্যতাও রয়েছে। তারা এ ধরনের সন্দেহ ও দ্বিধা সৃষ্টির মাধ্যমে মুমিনদেরকে গোমরা ও পথভ্রষ্ট করে তাদের আক্বিদা বিশ্বাসকে দুর্বল করতে চেয়েছিল। আসলে তারা নিজেরাই পথভ্রষ্ট হল। আর এ কারণেই যখন তারা এ ধরনের অলক্ষনে কাজে জড়িয়ে পড়ে, হক্ব ও সত্যকে চেনা ও গ্রহন করার সৌভাগ্য তারা হারিয়ে ফেলে। আনসারের কিছু সংখ্যক বয়োবৃদ্ধ লোক রাসুলুল্লাহ (সা:) এর নবুওতের পূর্বে ইয়াহুদীদের সাথে যাদের বন্ধুত্ব ছিল, তারা ইয়াহুদীদের বলল: তোমরাই নবুওতের পূর্বে পয়গম্বর ও তাঁর আবির্ভাবের আলামত সম্পর্কে আমাদেরকে অবগত করেছিলে সুতরাং রাসুলুল্লাহর (সা:) সাথে এই বিরোধিতার পথ থেকে ফিরে এসো এবং আল্লাহ তায়ালার আযাবকে ভয় কর। কিন্তু ইয়াহুদীরা বলল: হযরত মুসার (আ:) পর কোন পয়গম্বরের আবির্ভাব ঘটেনি এবং কোন আসমানি কেতাবও নাযিল হয় নি। যখন কিছু সংখ্যক মুশরিক নতুন ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ইয়াহুদীদের কাছে পথ নির্দেশনা চাইল, তারা রাসুলুল্লাহর (সা:) সাথে নিজেদের শত্রুতা ও বিদ্বেষের কারণে তাদেরকে বলল: তোমাদের (মুশরিকদের) ধর্ম হচ্ছে উত্তম ও প্রাচীণ আর তোমরা তাদের (মুসলমানদের) ন্যায় অধিক হেদায়াতপ্রাপ্ত। এমনকি ইয়াহুদীরা নিজেরাই তাদের এ অপকর্মের কথা স্বীকার করে। এক ইয়াহুদী লেখক তার বই “ইয়াহুদ ও সৌদি আরবের ইতিহাস” এ উল্লেখ করে: যদিও কোরাইশ তাদের কাজে সম্মতি না দেয় তবুও ইয়াহুদীদের এ রকম ভুল কাজে জড়িয়ে পরার কোন প্রয়োজনই ছিল না। কখনই এটা ঠিক নয় যে, ইয়াহুদী গোষ্ঠী মুর্তি পূজারিদের কাছে নিরাপদ আশ্রয় নেবে। কেননা এই আচরণ তাওরাতের শিক্ষার সাথে অনুকূল নয়।
ইয়াহুদীদের অন্যান্য কাজের মধ্যে একটা ছিল এই যে, কিছু সংখ্যক লোককে দায়িত্ব দেয়া হয় যে, তারা সকাল পর্যন্ত ইসলামের প্রতি ঈমান নিয়ে আসবে আর রাতে তা থেকে ফিরে যাবে, কেননা নতুন মুসলমানরা জানতো যে, ইয়াহুদী ওলামারা আসমানী দ্বীন ও পয়গম্বর সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞাত রয়েছে। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে যারা ঈমানের দিক থেকে দুর্বল ছিল তাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তাফসিরে কোম্মিতে ইমাম বাকের (আ:) থেকে বর্ণিত যে, যখন মুসলমানদের কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মক্কার দিকে পরিবর্তন হয়, ইয়াহুদীরা রাগান্বিত হয় এবং ইয়াহুদীদের সম্বোধন করে বলে শেষ দিনে যা নাযিল হয়েছে (মক্কার দিকে কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ) তোমরা তা অস্বীকার করো, হয়ত মুসলমানেরা আমাদের কেবলার দিকে ফিরে আসবে।
ইয়াহুদীদের ষড়যন্ত্রের আরেকটি দিক হচ্ছে তারা স্বয়ং রাসুলুল্লাহকে (সা:) পথভ্রষ্ট করতে চেয়েছিল। তারা রাসুলুল্লাহর (সা:) কাছে আসে এবং বলে: আমাদের ও অন্য গোত্রের লোকের মধ্যে দ্বন্দের সৃষ্টি হয়েছে, যদি আপনি আমাদের সমর্থন করেন আমরা মুসলমান হয়ে যাব। কিন্তু আল্লাহর রাসুল (সা:) খোদার হুকুম ও সুরা মায়েদার ৪৯ নং আয়াত অনুযায়ী কাজ করেন। এ সুরাতে:
১। রাসুলুল্লাহকে (সা:) ইয়াহুদীদের অনুসরণ না করার জন্য শতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
২। ইয়াহুদীদের পরিকল্পনার মুখোশকে উম্মোচন করা হয়েছে।
৩। আখেরাতে আহলে কেতাবের বেশ কিছু আযাবের প্রতি ইশারা, কেননা এ দুনিয়াতে সকল গোনাহর আযাব দেয়া হবে না বরং বেশ কিছু গোনাহর আযাব আখেরাতে দেয়া হবে।
যখন ইয়াহুদী প্রধানরা তাদের এ পরিকল্পনা থেকে নিরাশ হয়ে পড়ে, তারা অন্যান্য মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা চালায়। এমনকি রাসুলুল্লাহর (সা:) ঘনিষ্ট সাহাবায়ে কেরামদেরকেও যেমন: মা’আয ইবনে জাবাল, হুযাইফা ও আম্মার ইবনে ইয়াসের। যদি তারা এ কাজে সফল হয়ে যেত ইসলাম এক বড় ধরণের আঘাতের সম্মুখিন হত। এ সময় সুরা আলে ইমরানের ৬৯ নং আয়াত নাযিল হয়। এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন: ইয়াহুদীরা চেয়েছিল আপনাকে পথভ্রষ্ট করতে কিন্তু বিরোধের সম্পর্ক নবী করিমের (সা.) এর সাথে সংযুক্ত করার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে আত্নার কলুষতা ও নৈরাশ্যবাদের প্রতিপালন করলো এবং ইতিবাচক কাজগুলোকে উপেক্ষা করে ইসলাম থেকে দূরত্বতা অর্জন করেছে।
ইয়াহুদিদের অন্যান্য কাজের মধ্যে একটি ছিল এই যে, মুসলমানদের ব্যক্তিত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করা। তারা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যেমন রাসুলুল্লাহ (সা:) ও তাঁর অনুসারীদেরকে জনসাধারণের চোখে হীন করার চেষ্টা করতো এবং তাদের প্রতি বাজে মন্তব্য করতো, যাতে করে তাদের প্রতি জনসাধারণের আস্থা উঠে যায়। এমনকি তারা এ কাজে কুশলি কবিদেরকে ভাড়া করলো, যাদের মধ্যে একজন হচ্ছে কা’ব ইবনে আশরাফ, যে একজন বিদ্বেষি ও দুষ্ট প্রকৃতির লোক ছিল। নোংরামিকে সে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে রাসুলুল্লাহ (সা:) তাকে হত্যা করার হুকুম দেন। মুফাসসেরদের মতে আলে ইমরানের ১৮৬ নং আয়াত এ বিষয়েই নাযিল হয়েছে:
”لَتُبْلَوُن‌َ في‌ أمُوالِكُم‌ْ وَ في‌ اَنْفُسِكُم‌ْ و لَتَسْمَعُن‌َّ الَّذين‌َ أُوتوُا الكِتاب‌َ مِن‌ْ قَبلِكُم‌ْ و مِن‌َ الَّذين‌َ أَشْرَكوُا أَذي‌ً كَثيراً وَ ِان‌ تَصْبِروُا و تَتَّقوُا فَاِن‌َّ ذ'لِك‌َ مِن‌ْ عَزْم‌ِ الاُمُور. “
আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে কটাক্ষতাকে মুসলমানদের জন্য পরীক্ষা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইয়াহুদীরা আসমানী কেতাব সমূহে যেমন তাওরাতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা:) সম্পর্কিত তথ্য সমূহকে জেনে শুনে গোপন করেছে। আর এ কাজের মাধ্যমে তারা মানব জাতির প্রতি সবচেয়ে বড় খেয়ানত করেছে। আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ১৫৯ নং আয়াতে এই সত্য গোপনকারীদের প্রতি অভিশম্পাত করেছেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরা বাকারার ১৪৬ নং আয়াতে বর্ণনা করেন: তারা (ইয়াহুদীরা) রাসুলুল্লাহকে (সা:) নিজ সন্তানদের মতই জানতো। তাদের উদ্দেশ্য আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম ছিল; ইয়াহুদী যে নতুন মুসলমান হয়েছে, বলল: আমি রাসুলুল্লাহকে (সা:) নিজ সন্তানের চেয়েও ভাল চিনি। রাসুলুল্লাহর (সা:) নবুওতের পূর্বে ইয়াহুদী ওলামারা তাঁর আলামতসমূহ (যা তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে) সাধারণ মানুষকে বয়ান করত আর এই সাধারন মানুষগুলোও যখন মুসলমানদের দেখতো এই আলামতগুলো বর্ণনা করতো। কিন্তু ইয়াহুদী প্রধানরা যখন নিজেদের অবস্থানকে ক্ষতির সম্মুখীন দেখতে পায় নিজেদের স্বার্থপরতা ও দুনিয়ার ভোগবিলাসের আসক্তে সাধারন ইয়াহুদীদেরকে এ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে, আসলে ইয়াহুদী ওলামারা সত্যকে খুব ভালভাবেই জানত কিন্তু তা গোপন করত। সুরা বাকারার ৭৬, ৭৭ ও ৮৯ নং আয়াত এ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই আয়াতসমূহে উল্লেখ করেন: তারা বলতো আমরা যদি এই আলামতগুলোকে বর্ণনা না করি কেয়ামতের দিন মুসলমানরা আমাদের বিরুদ্ধে কোন অজুহাত আনতে পারবে না। এরূপ বর্ণনা করে: তারা কি জানে না আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের গোপনীয় ও প্রকাশ্য কাজ থেকে অবগত।  
ইয়াহুদীদের সাংস্কৃতি ষড়যন্ত্রের মধ্যে আরেকটি হচ্ছে এই যে, তারা তাওরাতকে বিকৃত করেছে বিশেষ করে তাওরাতের যে অংশে নবী করিম (সা:) এর সেফাত বা গুনসমূহ বর্ণিত ছিল। সাধারণ ইয়াহুদীরাও নির্দোষ ছিল না। কেননা ইমাম সাদিক (আ:) এক হাদীসে বলেন: সাধারণ ইয়াহুদীরা তাদের ওলামাদের মিথ্যাচার, হারামখোরী, ঘুষ খাওয়া সহ বিভিন্ন ব্যভিচার ও পাপকর্ম সম্পর্কে অবগত ছিল। এমতাবস্থায় ওলামাদের অনুসরন করা তাদের উচিত ছিল না।
মদীনার ইয়াহুদী প্রধানরা ইসলামের শক্তিকে দুর্বল করার জন্য, ইয়াহুদীদের মধ্য থেকে নতুন ইসলাম ধর্ম গ্রহনকারীদের তিরস্কার করত। যেমন: যখন আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম মুসলমান হয়, সে রাসুলুল্লাহ (সা:) এর কাছে অনুমতি চেয়ে বলল: আমার মুসলমান হওয়ার বিষয়টিকে গোপন রেখে আমি আমার গোত্রের নিকট যেতে চাচ্ছি যাতে করে আমার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে স্বীকারোক্তি গ্রহন করতে পারি। যখন তার গোত্রের কাছে তার সম্পর্কে জিঞ্জাসা করা হল তারা তাকে একজন জ্ঞানী ও সংযমী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু যখন জানল সে মুসলমান হয়েছে তারা তাকে অজ্ঞ ও পাপাচারী হিসেবে চিহ্নিত করে।
ইয়াহুদীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাহানা ও অজুহাত দাড় করাত। তারা রাসুলুল্লাহর (সা:) নিকট পশুর কোরবানী ও তা আগুনে পোড়ার মুজিযা বা অলৌকিক কার্য দাবি করে। পূর্বে হযরত যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া নবী এ দাবী পূরণ করা সত্বেও বনি ইসরাইল তাদেরকে হত্যা করে। আলে ইমরানের ১৮৩ নং আয়াত এ বিষয়ের প্রতি ঈংঙ্গিত করেছে। অনেক মুফাসসের এ মুজিযা কে একটি মাযহাবী সুন্নাত বলে মনে করেন যা তাওরাতেও বর্ণিত হয়েছে। তাফসিরে নেমুনা এ মতকে অস্বীকার করে, কেননা পশু হত্যা ও তা পোড়ানো একটি কুসংস্কার মাত্র এটি কোন আল্লাহর হুকুম নয়। এভাবে ইয়াহুদিরা একের পর এক বাহানা আনতে থাকে যেমন: তারা কোরআনকে তাওরাতের মত এক সাথে নাযিল হওয়ার জন্য দাবী করে। ইয়াহুদীরা এর পূর্বেও বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবী করে, তারা আল্লাহকে দেখার দাবী করে যার ফলস্বরুপ আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বজ্রপাতের মাধ্যমে আযাব দান করেন।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন