হজরত আবু তালিবের ঈমান

আবু তালিবের জন্মঃ রাসুল (সা.) এর জন্মের ৩৫ বছর পূর্বে আব্দুল মোত্তালেবের ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতার নাম ছিল ফাতেমা।   আবু তালিবের নামঃ সেই যুগে আরবদের নিয়ম ছিল ছেলে হলে তার নামের পূর্বে আবু এবং মেয়ে হলে তার নামের পূর্বে উম শব্দটি যোগ করা হতো। অনেক

হজরত আবু তালিবের ঈমান
আবু তালিবের জন্মঃ
রাসুল (সা.) এর জন্মের ৩৫ বছর পূর্বে আব্দুল মোত্তালেবের ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতার নাম ছিল ফাতেমা।  
আবু তালিবের নামঃ
সেই যুগে আরবদের নিয়ম ছিল ছেলে হলে তার নামের পূর্বে আবু এবং মেয়ে হলে তার নামের পূর্বে উম শব্দটি যোগ করা হতো। অনেকের মতে তার নাম ছিল আব্দে মানাফ যার অর্থ হচ্ছে অতি সম্মানিত বান্দা।

আবু তালিবের উৎসর্গতাঃ
রাসুল (সা.) এর জন্মের সাথে সাথে তাঁর বাবা মারা যান। তখন তাঁর দেখাশুনার দ্বায়িত্ব তার দাদা আব্দুল মোত্তালিবের কাছে আসে যখন তিনিও রাসুলের (সা.) ৭ বছর বয়স হতে না হতে দুনিয়ার বুক থেকে বিদায় নেন অতপর তাঁর দেখশুনার দ্বায়িত্ব আবু তালিবের কাছ আসে।
আবু তালিব তাকে নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন এবং রাতের বেলায় তাকে নিজের কাছে নিয়ে ঘুমাতেন এমনকি যখন তিনি সফরে যেতেন তখনও তাকে সাথে করে নিয়ে যেতেন। তিনি রাসুল (সা.) ভাল খাদ্য খাওয়াতেন। (তাবাকাতে কুবরা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১০১)
ইবনে আব্বাসস বলেন আবু তালিব রাসুল (সা.) কে নিজের সন্তানদের চেয়ে বেশী ভালবাসতেন কখনও তাকে দূরে ঘুম পাড়াতেন না এবং তিনি যেখানে যেতেন রাসুল (সা.) কে সাথে করে নিয়ে যেতেন। (আল গ্বাদীর, খন্ড ৭, পৃষ্ঠা ৩৭৬)
আল্লামা মাজলিসী বলেনঃ রাসুল (সা.) ঘুমিয়ে পড়লে আবু তালিব আলী (আ.) রাসুলের (সা.) বিছানায় ঘুম পাড়াতেন এবং তার ভাইদেরকে কার রক্ষার জন্য নির্দেশ দিতেন। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৩৫, পৃষ্ঠা ৯৩)
ইয়াকুবি লিখেছেন যে, ফাতেমা বিনতে আসাদ মারা গেলে রাসুল (সা.) বলেন তিনি ছিলেন একজন মুসলমান নারী। তিনি আরো বলতেন ( الیوم ماتت امی) আজ আমার মা মারা গেছে। রাসুলকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে কেন আপনি ফাতেমা বিনতে আসাদের জন্য এত দুঃখ প্রকাশ করছেন তিনি তার উত্তরে বলেন কেননা তিনি আমার মায়ের মতো ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি নিজের সন্তানদের ক্ষুধার্ত রাখতেন এবং আমাকে খাদ্য দান করতেন, তার সন্তানদের শরীরে ধুলা ময়লা লেগে থাকতো কিন্তু তিনি আমাকে পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতেন।(তারিখে ইয়াকুবী, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৬৮)

ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেন যে, আবু তালিব ছিলেন সেই ব্যাক্তি যিনি রাসুল (সা.) কে ছোট বেলায় নিজের দ্বায়িত্বে নেন , যুবক বয়সে তাকে সাহায্যে করেন এবং কুরাইশদের ষড়যন্ত্রের মুকাবিলা করতেন এবং এই পথে তিনি যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করেছেন এবং বহুবার নিজের জীবনের ঝুকি নিয়েছেন। তার মৃত্যুর সময় হযরত জিব্রাইল (আ.) নাযিল হন এবং রাসুল (সা.) কে বলেন যে, আপনি মক্কা থেকে বাহির হয়ে যান কেননা  আপনার সাহায্যেকারী  আজ আর দুনিয়ার বুকে নেই। (ইবনে আবিল হাদীদ, শারহে নাহজুল বালাগা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৯, খন্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৭০)
আবু তালিব ও হযরত খাদিজার মৃত্যু রাসুল (সা.) কে এতই মর্মাহত করে যে তিনি সেই বছরকে আমুল হুযন বলে আখ্যায়িত করেন। (আল গ্বাদীর, খন্ড ৭, পৃষ্ঠা ৩৭৩- ৩৭৬, তারিখে কামেল ইবনে আসীর, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৯১)

আবু তালিবের ঈমান সম্পর্কিত বিশ্লেষণাত্মক আলোচনাঃ
অনেকেই আলী (আ.) এর প্রতি শত্রুতা থাকার কারণে আব তালিবকে কাফের বলে প্রমাণিত করার চেষ্টা করে। আবার অনেকে রাসুলের বাবা মা কেও কাফের বলে প্রমাণিত করার চেষ্ট করে। কিন্তু হযরত আলী (আ.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেনঃ শপথ খোদার না আমার বাবা এবং আমার পূর্ব পুরুষেরা ( আব্দুল মোত্তালেব, হাশেম এবং আব্দে মানাফ ) কখনই মূর্তি পুজা করেননি। তারা কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়তেন এবং তারা দ্বীনে ইব্রাহিমের উপরে ঈমান রাখতেন। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৩৫, পৃষ্ঠা ৮১)
আবু তালিবের ঈমান সম্পর্কে বড় বড় আলেমেরা তাদের পুস্তকে লিখেছেন এছাড়া অসংখ্য হাদীস আমরা এ সম্পর্কে দেখতে পাইিএবং ইসলামী ইতিহাসে তা প্রমাণিত হয়েছে। আল্লামা মাজলিসী ১১৫ পৃষ্ঠায় ৮৫ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে আহলে সুন্নাতের বড় বড়  আলেমদের কথাও সেখানে বর্ণিত হয়েছে।
আল গাদ্বীর নামক গ্রন্থের ৭ম এবং ৮ম খন্ডে তিনি আহলে সুন্নাতের বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে সহস্রাধিক হাদীস তিনি বর্ণনা করেছেন। (আল গ্বাদীর, খন্ড ৭, পৃষ্ঠা ৩৩১- ৪১৩)
আহলে সুন্নাতের বহু আলেম এবং গবেষকগণ তাদের লিখাগুলোতে কম বেশী আবু তালিবের ঈমান সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন এবং তার সম্পর্কে নেতিবাচক মতামত প্রকাশ করেছেন।
এই ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে,ইবনে আবিল হাদীদ উক্ত বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং একাধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন যা সত্যান্বেষীদের জন্য খুবই উপকারী।
অনেকেই আবু তালিবকে কাফের বলে থাকেন। কিন্তু তারা একবারও আবু তালিবের জিবনীর অধ্যায়ন করে না। যদি তারা জানতো যে আবু তালিব ছিলেন এমন ব্যাক্তিত্ব যিনি রাসুল (সা.) কে নিজের ছত্রছায়ায় লালন পালন করেন, তিনি রাসুল (সা.) কে তার রেসালাতের তাবলিগকালীন সময়ে অর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে সাহায্যে সহযোগিতা করেন। আবু তালিব মক্কায় এবং তার সন্তান মদীনায় রাসুলের (সা.) জীবন রক্ষার কাজে নিজেদেরকে নিযোজিত রাখেন। (শারহে নাহজুল বালাগা, খন্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৮৪)
আবু তালিব রাসুল (সা.) এর জীবন রক্ষার জন্য রাজনৈতীক পদ মর্যাদা, সম্মানের থেকে তিন বছর পাহাড়, গুহা, ছন্নছাড়া জীবনকে বেশী প্রাধান্য দান করেন। তিনি রাসুল (সা.) কে বাচানোর জন্য নিজের সমস্ত সন্তানকে খোদার পথে উৎসর্গ করতে কুন্ঠা বোধ করেননি। মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর সন্তানদের বলেন আমি তোমাদেরকে মুহাম্মাদ সম্পর্কে বলতে চায় যে, সে হচ্ছে কুরাইশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সত্যবাদী এবং অন্যান্য গুনাবলিও তাঁর মধ্যে রয়েছে। তোমরা তার অনুসরণ করো।
১- ইবনে আবিল হাদীদ মোতাযেলী তিনি আব্বাস ইবনে আব্দুল মোত্তালিব, আবু বকর বিন আবু কুহাফা থেকে বণনা করেছেন যে আবু তালিব (لااله الا الله، محمد (صلی‏الله‏علیه‏وآله) رسول الله) পাঠ করার পূর্বে মৃত্যু বরণ করেনি। (সীরাহে সহীহ পায়াম্বারে ইসলাম, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ২২১)
২- হজরত আলী (আ.) বলেন যখন আমি রাসুল (সা.) কে আমার বাবা আবু তালিবের মৃত্যুর খবর জানায় তখন তিনি খুব ক্রন্দন করেন এবং বলেন যে, যাও তাকে গোসল ও কাফন পরাও কেননা আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন এবং তার প্রতি নিজের রহমত নাযিল করবেন। (শারহে নাহজুল বালাগা, খন্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৭৬)
অতপর রাসুল (সা.) তার লাশের পাশে আসেন এবং বলেন হে আমার চাচা আপনি আমাকে শৈশবে আমার দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন, আমার পিতৃহারা অবস্থায় আমাকে আশ্রয় দান করেন এবং যৌবনে আমাকে সার্বিক সাহায্যে করেন। আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে আপনার উক্ত কষ্টের উপযুক্ত প্রাপ্য দান করবেন। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৩৫, পৃষ্ঠা ৬৮, হাদীস নং ১)
৩- ইবনে আবিল হাদীদ মোতাযেলী তিনি বলেছেন রাসুল (সা.) বলেছেন হে আমার চাচা আমি আপনার জন্য খোদার কাছে মাগফেরাত চাইব যে, জ্বিন ও মানুষ তা দেখে আশ্চর্যিত হবে। (শারহে নাহজুল বালাগা, খন্ড ১৬, পৃষ্ঠা ৭৬)
৪- ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.) থেকে বর্ণিত যে: যখন আমীরুল মুমিনিন আলী (আ.) এর মা যখন রাসুল (সা.) এর জন্মের সুসংবাদ আবু তালিবকে দান করেন। তিনিও তার জবাবে বলেন যে: আমিও তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি যে, তুমিও এমন এক সন্তান এই দুনিয়ার বুকে জন্মদান করবে যে হবে তার ওয়াসী ও ওয়াযির। (উসুলে কাফী, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৫২, হাদীস নং ১ ও ৩)
৫- ইমাম হুসাইন (আ.) থেকে বর্ণিত হযেছে যে, আমার বাবা হজরত আলী বলেছেন একদা তিনি ঘরে কিছু লোকের সাথে বসে ছিলেন হঠাৎ একজন প্রশ্ন করে যে, হে আমীরুল মুমিনিন আপনি এমন এক পদমর্যাদার অধিকারী অথচ আপনার বাবা হচ্ছে জাহান্নামী। তিনি তার উত্তরে বলেন চুপ কর খোদা তোমার মুখ কালো করুক এইটা কেমন কথা কসম হচ্ছে সেই সত্তার যিনি রাসুল (সা.) কে নবুওয়াত দান করেছেন যদি আমার বাবা যদি কোন গুনাহগারের জন্যও দোয়া করে তাহলে আল্লাহ তা কবুল করে নিবেন। কি তার বাবা জাহান্নামে থাকবে যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের বেহেস্ত ও জাহান্নামের বন্টনের দ্বায়িত্ব দান করেছেন। (বিহারুল আনওয়ার, খন্ড ৩৫, পৃষ্ঠা ১১০, হাদীস নং ৩৯)

আবু তালিবের ঈমানের প্রমাণাদি
(১) স্বয়ং রাসুল (সা.) এবং আহলে বাইত (আ.) থেকে বর্ণিত কথা সমূহই হচ্ছে আবু তালিবের ঈমানের জন্য বড় একটি দলিল।
২- সংকটপূর্ণ মূহুর্তেও রাসুল (সা.) কে সাহায্যে হচ্ছে ঈমানের আরেকটি দলিল।
৩- আবু তালিবের কবিতা সমূহ যেখানে তিনি রাসুল এবং স্বয়ং খোদা সম্পর্কে  উল্লেখ করেছেন।
৪- রাসুলের (সা.) এর পিছনে নামাজ পড়ার জন্য তার স্ত্রী, সন্তানাদি এবং তার ভাই হযরত হামযাকে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেন।
৫- রাসুল (সা.) হযরত আবু তালিব ও হযরত খাদিজার মৃত্যুর কারণ সেই বছরকে আমুল হুযন বলে উল্লেখ করেন।
৬- হযরত আবু বকর এবং হযরত আব্বাস সাক্ষি দেন যে আবু তালিব মৃত্যুর পূর্বে কলেমা শাহাদাতাইন পাঠ করেন।
৭- হযরত আবু তালিবের জন্য রাসুল (সা.) দোয়া করেন এবং তার কাফন দানের জন্য নির্দেশ দান করেন। তিনি তার জানাযার নামাজ পড়ান।
৮- হযরত আলী (আ.) মাবিয়ার কাছে প্রেরিত চিঠিতে লিখেন যে, আমার বাবা আবু তালিব এবং তোমার বাবা আবু সুফিয়ানের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
৯- রাসুল (সা.) বলেছেন যে, আমি কেয়ামতের দিন আমার বাবা মা এবং আমার চাচার জন্য শেফায়াত করব।
১০- হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ বলেছেন যে, আমি তোমার বাবা মা এবং তোমার চাচা আবু তালিবের উপরে জাহান্নামের আগুনকে হারাম করেছি।
১১- ফাতেমা বিনতে আসাদ যিনি মুহাজির ছিলেন। যদি আবু তালিব মুসলমান না হতেন তাহলে কখন তিনি তার স্ত্রীকে রাসুলের  সাথে হিজরত করার অনুমতি দিতেন না।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে আবু তালিবের ঈমানের বহিপ্রকাশ না করার বিষয়টি হচ্ছে সম্পূন একটি রাজনৈতীক বিষয় কেননা আবু তালিবের ঈমানের ক্ষেত্রে  একাধিক দলিল রয়েছে যে তিনি ইসলামের প্রতি ঈমান নিয়ে এসেছিলেন। যার সম্পর্কে শিয়া সুন্নী উভয়েই তার ঈমান সম্পর্কে নিজেদের অভিমত ব্যাক্ত করেছেন এবং সত্যায়িত করেছেন যে সে ছিল একজন মুমিন ব্যাক্তি।
কিন্তু তারপরেও কিছু বিদ্বেষী ভাবাপন্ন লোকেরা তাকে কাফির বলে প্রমাণিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের শত্রুতা হচ্ছে হজরত আলীর (আ.) সাথে কেননা যদি তারা আবু তালিবকে কাফির বলে প্রমানিত করতে পারে তাহলে তারা হজরত আলী (আ.) এর মনক্ষুন্নতার ক্ষেত্রে সাফল্যতা লাভ করতে পাবে।
রাসুল (সা.) থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে হে আলী তোমাকে তারাই ভালবাসবে যারা হবে মুমিন আর তারাই শত্রুতা পোষণ করবে যারা হবে মুনাফিক। আর তাই আমাদের উচিত হবে যে কাউকে অযথা কাফের না বলে প্রকৃত সত্যকে জানার চেষ্টা করা। তাহলেই আমাদের  বিচার বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে।

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন