রক্তিম শাহাদতে কাবার একমাত্র সন্তান

রক্তিম শাহাদতে কাবার একমাত্র সন্তান

রক্তিম শাহাদতে কাবার একমাত্র সন্তান

৪০ হিজরীর একুশে রমজান। সব-হারানোর বেদনায় গোটা বিশ্ব জগত যেন ব্যথিত, প্রকৃতি যেন নির্জীব, অচল, স্পন্দনহীন। ইয়াতীম, বঞ্চিত আর মজলুমের মর্মভেদী কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত! যে অবিস্মরণীয় নিষ্পাপ-ফুলেল সত্তা হিজরী-পূর্ব ২৩ সনের ১৩ই রজব পবিত্র কাবা ঘরে জন্ম নিয়ে তাঁর বহুমুখী সৌরভে ও অতুলনীয় সব গুণের ছোঁয়ায় বারে বারে ইসলামকে দিয়েছে নব-জীবন সেই পবিত্র ব্যক্তিত্বের শাহাদত শোক-সাহারায় তুলেছে অনন্ত মাতম! প্রায় ১৪০০ বছর ধরে মুমিনের চোখে রক্ত-অশ্রু-ঝরাচ্ছে এই রাত! কিন্তু সে রাতে বিশ্বনবী (সাঃ)'র পর হেদায়াতের উজ্জ্বলতম প্রদীপ অসময়ে চিরতরে নির্বাপিত হলেও মানুষের অন্তরে তিনি আজো অমর, অক্ষয় এবং ঈমানের অফুরন্ত শক্তির উৎস !
যদিও একুশে রমজান পৃথিবী হারিয়েছিল বিশ্বনবী-সাঃ'র শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ও শ্রেষ্ঠ অনুসারীকে, বিশ্বনবী-(সাঃ)এর জ্ঞান-নগরীর মহাতোরণকে, রাসূল (সাঃ)'র পর সবচেয়ে দয়াদ্র ও উদার আত্মার অধিকারী মানুষকে, সাধানা ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতার সর্বোত্তম আদর্শকে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সাঃ)'র নিজ হাতে গড়ে তোলা ইসলামের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও সবচেয়ে আপোসহীন নেতাকে , তবুও আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের স্বর্গীয় আলোকোজ্জ্বল প্রভা যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পরতে পরতে আদর্শ মুমিনের কর্মতৎপরতার গভীরে অতুলনীয় ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে। মুমিন ব্যক্তির কাছে তিনি কিংবদন্তীতুল্য। বিশ্বনবী (সাঃ) বলেছেন, আমি যাদের মাওলা বা নেতা, আমার পরে আলী তাদের নেতা। হে আল্লাহ! যে আলীকে ভালবাসে তুমি তাকে ভালোবাস, যে আলীর সাথে শত্রুতা করে তুমি তার সাথে শত্রুতা কর। বিশ্বনবী (সাঃ) আলীকে সম্বোধন করে আরো বলেছেন, হে আলী! মূসার সাথে হারুনের যে সম্পর্ক, তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক, শুধু পার্থক্য হলো, হারুন নবী ছিলেন, কিন্তু তুমি নবী নও। মহানবী (সাঃ) আরো বলেছেন, আলী প্রেম হচ্ছে ঈমানের অঙ্গ। * হে আম্মার! যদি দেখ সমস্ত মানুষ একদিকে চলে গেছে, কিন্তু আলী চলে গেছে অন্য দিকে, তবুও আলীকে অনুসরণ কর, কারণ, সে তোমাকে ধ্বংসের দিকে নেবে না।* আমি জ্ঞানের নগরী, আলী তার দরজা, যে কেউ আমার জ্ঞানের মহানগরীতে প্রবেশ করতে চায় তাকে এ দরজা দিয়েই আসতে হবে।* আমি আলী থেকে, আর আলী আমার থেকে, যা কিছু আলীকে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা কিছু আমাকে কষ্ট দেয় তা আল্লাহকে কষ্ট দেয়। * হে আলী! ঈমানদার কখনও তোমার শত্রু হবে না এবং মোনাফেকরা কখনও তোমাকে ভালবাসবে না। অনেক সাহাবী এ হাদীসের ভিত্তিতে মোনাফেকদের সনাক্ত করতেন।একবার শাওয়াল মাসের শেষ শুক্রবারে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনার মসজিদে রমজানের গুরুত্ব সম্পর্কে বয়ান করার সময় রাসূল (সাঃ) কাঁদলেন। হযরত আলী (আঃ) প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কেন কাঁদলেন? উত্তরে তিনি বললেন, এ মাসে তোমার ওপর যে মুসিবৎ বা কষ্ট হবে তা মনে করছি । আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, তুমি আল্লাহর দরবারে নামাজ পড়ছো এবং সবচেয়ে হতভাগা লোকটি তোমার মাথায় কয়েকটি আঘাত হানছে ও এরফলে তোমার দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে! আলী (আঃ) প্রশ্ন করলেন, সে সময় কি আমার ঈমান অটুট থাকবে? রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ। ৪০ হিজরীর ১৯ শে রমজানে ইবনে মোলজেম নামের নরাধম খারেজী যখন ফজরের নামাজে সেজদারত আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ)'র মাথায় বিষ-মাখানো তরবারী দিয়ে আঘাত হানে, তখনই তিনি বলে ওঠেন, কাবার প্রভুর শপথ, আমি সফল! ২১ রমজানের রাতে শাহাদতের কিছুক্ষণ আগেও তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ! শাহাদত আমার কাছে এমন কিছু নয় যে তার সম্মুখীন হতে আমি অসন্তুষ্ট হব, বরং তা যেন আমার কাছে নিজের হারানো অস্তিত্বকে ফিরে পাবার মত আনন্দদায়ক, কিংবা আমি যেন রাতের অন্ধকারে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি খুঁজছিলাম, আর হঠাৎ তা পেয়ে গেলাম, আল্লাহর কাছে যা আছে সৎকর্মশীলদের জন্য সেটাই তো উত্তম। ইরানের বিখ্যাত চিন্তাবিদ শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মূর্তাজা মোতাহহারী হযরত আলী (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন, "আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র মহৎ ও সুন্দর ব্যক্তিত্ব এতো বিশাল-বিস্তৃত ও এতো বিভিন্নমুখী যে একজন মানুষের পক্ষে তাঁর সকল বৈশিষ্ট্য ও পরিধি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করাও সম্ভব নয়। হযরত আলী (আঃ)'র জীবন দার্শনিক, বিপ্লবী নেতা, সুফী শায়খ এবং নবী-রাসূলগণের অনেক বৈশিষ্ট্যের সমাহার।" তিনি ছিলেন জালিমের ত্রাস, মজলুমের সহায়, এতিম ও অনাথের সেবক । ন্যায় বিচার ও সুশাসনের প্রতীক। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের অতুলনীয় ও শ্রেষ্ঠ বীরযোদ্ধা। আল্লাহর সিংহ বা আসাদুল্লাহ ছিল তাঁর উপাধি। মহানবী (সাঃ)'র জীবদ্দশায় তাবুক যুদ্ধ ছাড়া প্রতিটি যুদ্ধে অংশ নিয়ে আলী (আঃ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এবং প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে বিজয়ের তিনিই ছিলেন প্রধান স্থপতি। তিনি অনেকবার নিজ জীবন বাজি রেখে রাসূল (সাঃ)'র জীবন রক্ষা করেছিলেন। জিহাদের ময়দানে তাঁর উপস্থিতিই শত্রু -সেনার মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতো।আল্লাহর রাসূল (সাঃ)'র সাথে নিজের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, যখন আমি শিশু ছিলাম তখনই তিনি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আমি তাঁকে অনুসরণ করে চলতাম যেভাবে উট-শাবক তাঁর মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। প্রতি বছর তিনি হেরা পাহাড়ে নির্জনবাসে যেতেন। সেখানে আমি ছাড়া কেউ তাঁকে দেখে নি। সে সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও খাদিজার ঘর ছাড়া অন্য কোথাও ইসলামের অস্তিত্ব ছিল না এবং সে সময় এ দুজনের পর আমিই ছিলাম তৃতীয়। আল্লাহর প্রত্যাদেশ ও বাণীর তাজাল্লি আমি দেখতাম এবং নবুওতের ঘ্রাণ প্রাণভরে গ্রহণ করতাম। (নাহজুল বালাঘা, খোতবা নম্বর-১৯১) হযরত আলী (আঃ) বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ বিশ্বনবী (সাঃ)'র সাথে প্রায় সব সময় ছায়ার মত থাকতেন। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের রাতে মক্কার কাফেররা যখন আল্লাহর সর্বশেষ নবী (সাঃ)কে হত্যার জন্যে তাঁর বাড়ী ঘেরাও করে, তখন আলী (আঃ) রাসূলে পাক (সাঃ)এর বিছানায় শুয়ে থেকে নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহানবী (সাঃ)কে হিজরতের সুযোগ করে দেন। যে ব্যক্তির তরবারীর আঘাতে হযরত আলী (আঃ) শাহাদত বরণ করেছিলেন, শহীদ হবার আগে মারাত্মক আহত অবস্থায়ও তিনি গ্রেফতারকৃত ঐ হামলাকারীর যত্ন নেয়া ও তাকে খাবার দাবার দেয়ার বিষয়ে খোঁজ নিতেন। তিনি বলেছিলেন, যদি আমি মারা যাই, তবে সে যেমন আমাকে একটি আঘাত করেছে তরবারি দিয়ে, তেমনি তাকে একটি মাত্র আঘাত করবে। সিফফিনের যুদ্ধে আমীরে মোয়াবিয়ার সেনারা প্রথম দিকে নদীর তীর দখল করে হযরত আলী (আঃ) 'র অনুগত সেনাদেরকে খাবার পানি থেকে বঞ্চিত করেছিল। কিন্তু পরে হযরত আলী (আঃ) 'র সেনারা ঐ নদীর তীর দখল করে শত্রু সেনাদেরকে নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ পেয়েও নিজ সেনাদেরকে তা করার অনুমতি দেন নি। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)কে তাঁর কঠোর ও নিখাঁদ ন্যায় বিচারের জন্য মোনাফেকরা ছাড়াও তাঁর অনেক পুরনো বন্ধু বা সহযোগীও শত্রুতে পরিণত হয়েছিল এবং এজন্যই অকালে তাঁকে শাহাদত বরণ করতে হয়েছে। এছাড়াও একদল সরলমনা ও ধর্মান্ধ ব্যক্তি দুনিয়াপুজারী ও ক্ষমতালোভীদের প্রতারণার শিকার হয়ে হযরত আলী (আঃ)'র মতো নিষ্পাপ মুমিনকেও কাফের বলে ঘোষণা দেয়! ইতিহাসে এই শ্রেণী খারেজী বলে খ্যাত। এই খারেজীদেরই অন্ধ অনুসারী ইবনে মুলজেম ১৯ শে রমজানের ফজরের নামাজের সময় সেজদারত অবস্থায় হযরত আলী (আঃ)'র শির মোবারকে বিষাক্ত তরবারীর আঘাত হানে। ফলে ২১শে রমজানের রাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন এবং শেষ হয়ে যায় চার বছর ও নয় মাসের খেলাফত । তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩। শাহাদতের কিছুক্ষণ আগে বড় ছেলে হযরত হাসান মুজতবাকে কাঁদতে দেখে হযরত আলী (আঃ) বলেন, হে আমার সন্তান কেঁদো না, এখন রাসূলে খোদা (সাঃ), তোমার মা হযরত ফাতেমা ও ফেরেশতারা আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন এবং তাঁরা আমাকে স্বাগতঃ জানাচ্ছেন। রাসূলে পাক (সাঃ)'র সহধর্মিনী বিবি আয়শা হযরত আলী (আঃ)'র শাহাদতের খবর শুনে বলেছিলেন, হে রাসূল! আপনার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র শাহাদত বরণ করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, আলীর চারটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য ছিল যা অন্য কারো ছিল না। আরব ও অনারবের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি রাসূলের সাথে নামাজ আদায় করেছেন। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক জিহাদেই তাঁর হাতে ঝান্ডা থাকতো। তৃতীয়তঃ লোকেরা যখন রাসূলের কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেত তখনও আলী তাঁর পাশেই থাকতো। চতুর্থতঃ আলীই রাসূল (সাঃ)কে শেষ গোসল দিয়েছিলেন এবং তাঁকে কবরে শায়িত করেছিলেন। জীরার ইবনেহামজা তাঁর প্রিয় নেতার গুণাবলী তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন, আলীর ব্যক্তিত্ব ছিল সীমাহীন, তিনি ক্ষমতায় ছিলেন দোর্দন্ড, তাঁর বক্তব্য ছিল সিদ্ধান্তমূলক, তাঁর বিচার ছিল ন্যায়ভিত্তিক, সব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল, তাঁর প্রতিটি আচরণে প্রজ্ঞা প্রকাশিত হত। তিনি দুনিয়া ও এর চাকচিক্যকে ঘৃণা করতেন । আমি আলী ইবনে আবি তালিবকে গভীর রাতে বহুবার এ অবস্থায় মসজিদে দেখেছি যে তিনি নিজ দাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে এমনভাবে আর্তনাদ করতেন যেন সাপে কামড় খাওয়া মানুষ এবং শোকাহত লোকের মতো রোদন করে বলতেন, হে দুনিয়া, ওহে দুনিয়া, আমার কাছ থেকে দূর হও! আমাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো না! .. .. .. এরপর জীরার বলেন, আলী (আঃ)'র অনুপস্থিতিতে আমি সেই মহিলার মতো শোকাহত যার সন্তানকে তার কোলে রেখে কেটে ফেলা হয়েছে।পৃথিবীতে এমন কিছু বিরল ব্যক্তিত্ব জন্মলাভ করেছেন, যাঁরা আল্লাহ প্রদত্ত অলৌকিক প্রতিভা, আধ্যাত্মিক সুষমা আর আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্যের ঐশ্বর্যে নিজেদের জীবনকে যেমন ধন্য করেছেন, তেমনি পরবর্তীকালের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের জন্যেও রেখে গেছেন তাঁর আদর্শ, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার অপরাজেয় উদাহরণ।তিনিই সত্য , স্বয়ং সত্য যাঁর নিত্য সহগামী পৃথিবীর পবিত্রতম গৃহেজন্ম নিয়ে যিনি অনন্য
যাঁরজ্ঞানের দরোজা পেরিয়ে যেতে হয় নগরে রাসূলের জ্ঞান-ধ্যানেরপবিত্র আলোয় ধন্য
যেনগর জাহেলি পৃথিবীকে দিয়েছে আলোর দিশা শ্বাশ্বতযে আলোয় কেটে গেছে কালের সকল অমানিশা।না, কেবল জ্ঞানের ক্ষেত্রেই নয়, বরং রাসূলের প্রশ্নহীন আনুগত্যের ক্ষেত্রেও তিনি অনন্য উদাহরণ রেখে গেছেন। রাসূলের ওপর যখন وانذر عشيرتك الاقربين  আয়াত নাযিল করার মাধ্যমে নিকটাত্মীয়দেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানানোর নির্দেশ দেওয়া হলো, রাসূল তখন তাঁর দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে একটা ভোজসভার আয়োজন করলেন। ভোজসভায় তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, এই বৈঠকে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম আমার প্রতি ঈমান আনবে অর্থাৎ আনুগত্য স্বীকার করবে, সে-ই হবে আমার স্থলাভিষিক্ত। ঘোষণা শুনে একজন আরেকজনের দিকে যখন মুখ দেখাদেখি করতে শুরু করলো তখন হযরত আলী (আঃ) নির্ভীকচিত্তে উঠে দাঁড়িয়ে রাসূলের প্রতি তাঁর পরিপূর্ণ আনুগত্যের ঘোষণা দিলেন। রাসূল তখন বলে উঠলেন-আমি যার নেতা, আলীও তার নেতা।আনুগত্যের প্রথম হাত তুলে পেয়েছিলে পুরস্কার পেয়েছিলে নেতৃত্বেরগর্বিত অপূর্ব উত্তরাধিকার হিজরতেররাতে চাদর মুড়িয়ে শুয়ে মৃত্যুকে করেছো তুচ্ছ মৃত্যুনয় নেতার আদেশই ছিল তোমার কাছে সর্বোচ্চ।হ্যাঁ, হিজরতের রাতেও তিনি রাসূলের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের আরেক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। কাফেররা তাঁকে না দেখেই হত্যা করতে পারতো, তা জেনেও তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে রাসূলের নির্দেশকে সাদরে বরণ করলেন এবং তাঁরি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। এটা যে তাঁর নির্ভীক চিত্তেরই লক্ষণ তা কিন্তু নয়, বরং এ হলো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসারই অকাট্য নিদর্শন। হযরত আলী (আঃ) যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন , তা-ও রাসূলের প্রতি ভালোবাসা তথা নেতার আদেশের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শনের কারণেই। ফলে তাঁর বীরত্ব, তাঁর অকুতোভয় যোদ্ধা সত্ত্বার পেছনে লুকিয়ে আছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অকৃত্রিম ঈমান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর আনুগত্যেরই প্রকাশ। আর এইসব গুণাবলী যে নিঃসন্দেহে একজন আবেদ, একজন প্রকৃত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বেরই চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য, তা তাঁর সমগ্র জীবন পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝা যাবে। আর তাইতো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত করে তাঁর বংশকে নিষ্পাপ-নিষ্কলুষ করেছেন এবং তাঁর বংশের সবাইকে ইহকালে দান করেছেন অনুসরণীয় ও আদর্শস্থানীয় ব্যক্তিত্বের মর্যাদা আর পরকালেও দিয়েছেন সমগ্র বেহেশতবাসীর ওপর অনন্য সম্মান । তুমি ধ্যানী , তুমি পূর্ণপুরুষ , আবেদ , বীর-মহাবীর , নামাযেও তুমিভিক্ষুকের প্রতি মহান উদার দানবীর আল্লাহতোমার বংশকে করেছেন নিষ্কলুতা দান
স্ত্রীকেদিয়েছেন খাতুনে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ শিরস্ত্রাণ পুত্রদ্বয়কে দিলেনবেহেশতের যুবনেতার সম্মান
এসবইতোমার প্রতি আল্লাহর পরম প্রতিদান।আল্লাহ যাঁকে এ্যাতো সম্মানে ভূষিত করলেন, তিনি যে সবসময় সত্যের ওপরই অটল থাকবেন, তাতে আর সন্দেহ কী! কিন্তু কালের ঘোলাজলে বিচক্ষণ মাছ শিকারীরা তাঁর ওপর যেসব রাজনৈতিক কূটচাল চেলে সাময়িক স্বার্থ চরিতার্থ করেছিল, তাদের কৃতকর্ম আজ অপ উপসর্গযোগে কলঙ্কিত। মুলজামের পুত্র আব্দুর রাহমানের তরবারী হযরত আলীকে শাহাদাতের সুরা পান করিয়েছে। কিন্তু তাঁর শাহাদাত যে তাঁকে মৃত নয় বরং চিরঞ্জীব করে তুলেছে তাতে কী আজ আর কোনো সন্দেহ আছে ! পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠতম মৃত্যু হলো শাহাদাতের মৃত্যু। যাঁরা শহীদ হন তাঁরা মৃত্যুকে ভয় করেন না, বরং এটাই যে তাঁদের উপযুক্ত প্রাপ্তি তা জেনে স্বাভাবিক থাকেন। কারণ তাঁরা জানেন এই শাহাদাতের পথ বেয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ত্বরান্বিত হবে। যতোটা সময় এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা যায় , ততোটা সময় আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান জানানোকেই তাঁরা তাঁদের অভীষ্ট বলে মনে করেন। হযরত আলী তাই তাঁর শাহাদাতের মুখেও জনমানুষের সৌভাগ্য ও কল্যাণ চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। ফজরের নামায আদায়রত হযরত আলীর মাথায় ইবনে মূলযাম যখন তার তরবারী বসিয়ে দিয়েছিল, তখন হযরত আলী মুখ থেকে যে শব্দকটি বেরিয়েছিল, তা ছিল-فزت و ربي الكعبه অর্থাৎ কাবার রবের শপথ আমি সফলকাম হলাম। এটা যে একজন শাহাদাতপিয়াসীর উক্তি তা সুস্পষ্টই বোঝা যায়। যাই হোক তরবারীর আঘাতে আহত অবস্থায় আলীকে (আ.) ঘরে নিয়ে আসার পর যতোটা সময় তিনি জীবিত ছিলেন ততোক্ষণ তিনি মানুষের কল্যাণ চিন্তাতেই মগ্ন ছিলেন।রক্ত দিয়ে লিখেছো তুমি মানুষের কল্যাণ
নামাযকেকরো দ্বীনের অনিবার্যখিলান কোরআনকেকরো জীবনের কর্মসূচি আর
অনাথকেকরোনা হেলা কিংবা জিহাদকে পরিহার।হযরত আলী (আ) এর মহত্বের কথা কী আর বলবো। তিনি নিজেই বলেছেন-মানুষের আচরণ হচ্ছে তার বিশ্বস্ততার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষী। তাঁর এই উক্তিটিকে যদি তাঁর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তের আচরণগুলো দিয়েও বিচার করা যায়, তাহলেও তাঁর মহত্বের পরিচয় পাওয়া যাবে। তিনি বলেছেন, ক্ষমাশীলতার অভাব হচ্ছে মানুষের মধ্যকার সবচেয়ে নিকৃষ্ট বা কুৎসিৎতম দোষ। আর নিকৃষ্টতম পাপ হচ্ছে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে তাড়াহুড়া করা। তাঁর এইসব বাণী যদি তাঁর নিজের জীবনের ঘটনা দিয়ে বিচার করা যায়, তাহলে দেখা যাবে তিনি কেবল বক্তাই নন বরং বক্তব্যকে নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠাকারীও। যুদ্ধের ময়দানে তাঁর মুখে পরাজিত প্রতিপক্ষ থু থু ছিটিয়ে দেওয়ার জবাবে তিনি যে আচরণ করেছিলেন তা তাঁর মহত্বের বাস্তব নমুনা। তিনি যে ব্যক্তিগত ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ছেন না, প্রতিপক্ষকে আঘাত করছেন না, বরং আল্লাহর দ্বীনের স্বার্থেই যে তাঁর জেহাদ, তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন। এমনকি যখন তাঁর মাথায় ইবনে মূলযেম তরবারী দিয়ে আঘাত করেছিল, তখনও তিনি প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপারে কোনোরকম দ্রুততার আশ্রয় নিলেন না। কিংবা কাউকে বিক্ষুব্ধও করলেন না। কালের পরিক্রমায় আজ মোলযেমদের বিরুদ্ধে লক্ষ-কোটি আলীর হাত উদ্ধত হয়েছে। এটাই কি প্রতিশোধ নয় !তোমার মহত্বের গাথায় শব্দভাণ্ডারও সীমিত তুমিতো নাজাফ আশরাফে আছো সমাহিত
সত্যেরখোঁজে আমরা যে তোমার কাছে ঋণী তোমার হন্তারাই আজ বহন করছে যাবতীয় গ্লানী।বায়তুলমালের হেফাজতের ব্যাপারে তিনি যে কী পরিমাণ সতর্ক ছিলেন , তা তাঁর ভাই আকীলের অর্থ চাওয়ার জবাব থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি তাঁর নিজের ভাইকে বলে দিয়েছেন যে বায়তুলমালের টাকা তাঁর নয়, রাষ্ট্রের, জনগণের। এখান থেকে কাউকে কোনো কিছু বিলানো তাঁর এখতিয়ারভুক্ত নয়। তিনি এগুলোর মালিক নন, বরং সংরক্ষণকারী বা তত্ত্বাবধানকারী। তাঁর একনিষ্ঠ খোদায়ীপ্রেম বা আধ্যাত্মিকতার কারণেই তিনি এতোটা স্বচ্ছতা অর্জন করতে পেরেছিলেন।এরকম ন্যায়বান খলীফা ছিলেন হযরত আলী (আ.)। তাঁর শাহাদাতবার্ষিকীতে আসুন আমরা তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের জীবনকে ধন্য করি। তাঁর উপদেশকে আমাদের জীবনে লালন-পালন করে আমরা আমাদের জীবনকে সুশৃঙ্খল ও সুসজ্জিত করি। তাঁর আধ্যাত্মিকতার অনুসরণ করে আমরা খোদার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করি। রাসূল (সাঃ) ঘুমানোর সময় যে চাদরটি পরতেন, ঐ চাদরটিকে কিসা (كساء) বলা হতো। তো একদিন রাসূল (সা.) সেই চাদরটি দিয়ে হযরত আলী (আঃ), হযরত ফাতেমাতুয্যাহরা সালামুল্লাহ আলাইহা এবং হাসান ও হোসাইন (আঃ) কে একত্রে আবৃত করে একটা দোয়া পড়লেন। কিসা দিয়ে তাঁর পরিজনদেরকে আবৃত করার কারণে তাঁদেরকে আহলুল কিসা ও (اهل الكساء) বলা হয়। রাসূলের এই দোয়া পাঠের সময় আল-কোরআনের এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিলো।( انما يريد الله ليذهب عنكم الرجس اهل البيت ويطهركم تطهيرا- )অর্থাৎ-হে নবীর পরিবার ! আল্লাহ তোমাদেরকে সর্বপ্রকার কলুষমুক্ত করে পরিপূর্ণভাবে পবিত্র করতে চান।কোরআনের এই আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, আহলে কিসা বা নবীজীর পরিজনরা আল্লাহর ইচ্ছাতেই ছিলেন নিষ্পাপ বা অন্যায়ের উর্ধ্বে। ফলে তাঁরা পাপ বা কোনোরকম অন্যায় করতে পারেন না। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আজ এই দাবীর সত্যতা প্রমাণিত হয় সহজেই। হযরত আলীর (আঃ) খেলাফতকালে রাজনৈতিক যে উত্তাল প্রবাহ ছিল, তখন আলী (আঃ) যে সঠিক পথেই ছিলেন এবং সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন , তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। অনেক অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে হয়তো সাময়িকভাবে তাঁর সিদ্ধান্তকে ভুল বলে মনে হয়েছিল। কেবল মনেই হয়নি বরং অনেকে তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরুপ প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছিল। খারেজিদের উৎপত্তি ঘটেছিল এভাবেই। অথচ আলী (আ.) যে গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন এবং তিনি যে কোনোরকমের ভুল সিদ্ধান্ত নেন নি, কালের অমোঘ পরিক্রমায় আজ সে সত্য সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। আজ আলী (আ.) আমাদের গর্ব। তাঁর মেধা, তাঁর প্রজ্ঞা আমাদের পাথেয়। তাঁর আধ্যাত্মিকতা আমাদের আত্মিক পরিশুদ্ধির আধার। তাঁর জ্ঞান আমাদের পথ চলার সঠিক দিক-নির্দেশক। তাঁর বংশধারা রাসূলের অকৃত্রিম আদর্শ গ্রহণ ও তার প্রচার প্রসারের প্রামাণ্য দলীল এবং সর্বজনগ্রাহ্য মাধ্যম। রাসূল যেমনটি আমাদেরকে যাবতীয় বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করতে বলে গিয়েছিলেন Ñআমি তোমাদের জন্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, একটি হলো আল-কোরআন এবং অপরটি হলো আমার পরিজন বা আহলে বাইত। ফলে আইলে বাইতের অন্যতম মহান পুরুষ হযরত আলী (আঃ) যে মুসলিম উম্মাহকে বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করতেই পদক্ষেপ নেবেন, তাতে সন্দেহ করার কোনো অবকাশই নেই। আমাদের অদূরদর্শিতার কারণে আমরা হয়তো তাঁর আদর্শ ও কর্মপ্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ভুল করি। তুলনা করে বলা যেতে পারে যে, চাঁদের গায়ে দাগ আছে বলে অনেকে মনে করে, অথচ তার জ্যোৎস্নায় কোনোরকম দাগ নেই , তা যে-কেউই বুঝতে পারেন। আমরা হযরত আলীর (আঃ) কর্মজীবন, আধ্যাত্মিকতা ও আদর্শের নিষ্কলুষ জ্যোৎস্নায় স্নান করে নিজেদের সমগ্র জীবনকে সমৃদ্ধ করে তুলবো- এটাই হোক তাঁর শাহাদাৎবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আমাদের যথার্থ প্রত্যাশা। বিগত বেড়াজালে আটকে পড়া মানুষ
তোমারহাতে তুলে দিলো হাল , তুমি ইতস্তত,বাধ্য আলোরক্ষীণরেখা মিথ্যার মেঘে লুকোবে জেনেও অবশেষেউত্তাল সমুদ্রেদিলে মহাকালের পাড়ি। সময়েরঘূর্ণি মেনে নিয়ে অমর হয়ে গেলে তুমি মৃত্যুরমাঝেও বেঁচে থাকে সত্যের বেলাভূমি তোমারপ্রতি নিরন্তর অন্যায়ে বঞ্চিত হলো পৃথিবী বঞ্চনারআঁধারে দিশেহারা মানুষ হারিয়ে সকল পথ তোমারদিকে বাড়ালোতাদের বিনত প্রার্থনার হাত মিথ্যার ঘূর্ণিপাক থেকে তুমি তাদের বাঁচাতে গিয়ে মাথায়তুলে নিলে যাবতীয় জঞ্জাল , তবু তুমি স্থির।জঞ্জাল-জটিলতাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হযরত আলী (আঃ) সত্যের ওপর সদা প্রতিষ্ঠিত থেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সত্যের বিদ্যমান রূপটাই তখন জনগণের সামনে সংশয়িত প্রশ্ন তুলে ধরেছিল। বিগত খেলাফতকালে যখন কোনো জটিলতা দেখা দিত , তখন হযরত আলী (আঃ) এর শরণাপন্ন হতে দেখা যেত। এরকম বহু উদাহরণ ইতিহাস জুড়ে বিদ্যমান। তারো আগে স্বয়ং রাসূল (সাঃ) বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আলীকেই কাছে টেনে দায়িত্ব দিয়েছেন। হোদায়বিয়ার সন্ধির সময় শান্তিচুক্তির খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব রাসূল হযরত আলীকেই দিয়েছিলেন। নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে মুবাহিলার সময় খ্রিস্টানদের কাছে মুবাহিলার শর্তাবলী পৌঁছে দেওয়ার জন্যে রাসূল আলীকেই আদেশ দিয়েছিলেন। সূরা তওবার অংশবিশেষ মক্কার কোরাইশদেরকে পড়ে শোনানোর দায়িত্বও রাসূল হযরত আলীকেই দিয়েছিলেন। হযরত আলী (আঃ) রাজস্ব প্রথার উদ্ভাবক ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম ভূমিরাজস্ব প্রথা প্রবর্তন করে ভূমির ওপর চাষীদের অধিকার নিশ্চিত করেন। অসম্ভব মেধাবী ছিলেন হযরত আলী (আঃ)। এরকম বিচিত্র রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হযরত আলী (আঃ) তাঁর খেলাফতকালে বিচিত্র জটিল পরিস্থিতিতে কোরআন, রাসূলের নির্দেশনা এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাহায্যে সকল সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছেন। এতে কায়েমি স্বার্থবাদী কিংবা তাদের অনুসারীদের অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়। যার ফলে তাঁকে অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। তবু তিনি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন নি। কোরআন, রাসূলের অনুসরণ থেকে তিনি বিন্দুমাত্র নড়েন নি। যার ফলে শাহাদাতের পেয়ালা পান করতে হয়েছিল তাঁকে। সত্যের দুধারী পথে তুমি অটল , তোমার বুকে কোরআন,
সামনেরাসূলের পবিত্রপদচিহ্ন , আরমনে জ্বলজ্বলে স্মৃতি।
তোমারজ্ঞানের দরোজা পেরোয়নি মিথ্যার কোন বর্ণমালা
সর্বদাছিল এইদ্বারে সত্যের আহ্বান।
তুষেরআগুণের মতো ছাই ঢাকা সত্যের প্রতিটি কণা
পৃথিবীতেআজ সীমাহীন দীপ্তিমান
যারাতোমার চারদিকে ছড়িয়েছে বিচিত্র তুষের ছাই
কালেরবুকে সত্যকে রেখে অতলে হারালো তারাই।*হযরত আলী (আঃ) ছিলেন অসম্ভব মহানুভব ব্যক্তিত্ব। যে ব্যক্তির তরবারীর আঘাতে তিনি শহীদ হয়েছিলেন তার নাম ছিল আব্দুর রাহমান ইবনে মুলযেম। উনিশে রমযানে তাঁকে আঘাত করা হয়েছিল , আর একুশে রমযানে তিনি শাহাদাৎ লাভ করেন। এই মধ্যবর্তী সময়টাতে তিনি ইচ্ছে করলেই এর প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা নেন নি। কারণ প্রতিশোধের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে তিনি সবসময় দূরে থেকেছেন। তাই তিনি তরবারীর আঘাত খেয়েও অপেক্ষা করেছেন এবং মুলযেমের যথার্থ যতœ নেওয়া হচ্ছে কিনা ; বা তার খাবার-দাবারের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা; প্রভৃতি বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন। শহীদ হবার আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন-"আমি যদি মারা যাই, তাহলে মুলযেম আমাকে যেভাবে তরবারি দিয়ে একটিমাত্র আঘাত করেছে , ঠিক সেভাবে তাকেও একটিমাত্র আঘাত করবে , এর বেশি নয়। সিফফীনের যুদ্ধে শত্র"-সেনাদেরকে নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ তাঁর ছিল,কিন্তু তিনি তা করেন নি। যুদ্ধের মাঠে শত্র" যখন তাঁর মুখে থু থু নিক্ষেপ করেছিল, তখন তিনি ঐ শত্র"কে তৎক্ষণাৎ আর মারলেন না। শত্র" যখন তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, তোমার থু থু নিক্ষেপের ঘটনায় আমার মনে ব্যক্তিগত প্রতিশোধস্পৃহা জেগে থাকতেও পারতো। আর আমি তো তোমাকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাবশত মারতে পারি না। এই ছিল হযরত আলী (আঃ) এর মহানুভবতা, বিচক্ষণতা ও ভুলে উর্ধ্বে অবস্থান করার কিছু নিদর্শন। অথচ তাঁকে অনেকেই চিনতে বা বুঝতে ভুল করেছেন বা এখনো করছেন। আর এমনটা যে হতেই পারে, সে ব্যাপারে রাসূল (সা) নিজেই বলে গেছেন। তিনি বলেছেন, "আল্লাহ এবং আমি ছাড়া আর কেউ আলীকে চেনে না।" আবার অন্যত্র বলেছেন-"আল্লাহ এবং আলী ছাড়া আর কেউ আমাকে চেনে না।" এ থেকে অনুমিত হয় যে হযরত আলী (আঃ) কে মূল্যায়নের ক্ষমতা সবার নেই। আবার রাসূলকে জানার এবং বোঝার ক্ষেত্রে সবচে যোগ্যতম এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি হলেন হযরত আলী (আঃ)। তাঁকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন-তোমরা যদি আদমের জ্ঞান, নূহের ধার্মিকতা, ইব্রাহিমের অনুরক্তি, মূসার সম্ভ্রম, এবং ঈসার সেবা ও মিতাচার দেখতে চাও, তাহলে আলীর উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকাও।হযরত আলী (আঃ) এর জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার তুলনা মেলা ভার। তিনি ছিলেন আরবি ব্যাকরণের জনক। ভাষার প্রাঞ্জলতা ও অলঙ্কারপূর্ণতার দিক থেকে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। কেবল ভাষাই নয় চিন্তা এবং উদ্ভাবনী শক্তির দিক থেকে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল কালাতিক্রমি। তিনি কুফার মসজিদের মিম্বারসহ বিভিন্ন স্থানে যেসব মূল্যবান ভাষণ দিয়েছেন, সেগুলো নাহজুল বালাগাহ নামে সংকলিত হয়েছে। মহামূল্যবান এই গ্রন্থটি তাঁর পাণ্ডিত্যের আংশিক নমুনামাত্র। তাঁর মেধা, তাঁর জ্ঞানের কথা প্রবাদতুল্য। পাঠক! এবার আমরা হযরত আলী (আঃ) এর বিখ্যাত কিছু বাণী তুলে ধরছি। তিনি বলেছেন- কপটতাপূর্ণলোকদের সম্পর্কে সতর্ক হও কেননা তারা ভুল পথে পরিচালিত , তারা বিভ্রান্ত। তারা লোকদেরকে এবং নেতাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করে। তাদের অন্তর রুগ্ন তবে চেহারা পবিত্র।হিংসা মানুষের দৈহিক উন্নতির অন্তরায়।মানুষের নির্বুদ্ধিতার জন্যে সে অন্য লোকের ছিদ্রান্বেষণ করে এবং নিজের মধ্যে লুকানো দোষকে উপেক্ষা করে।অহমিকা হলো অনেকগুলো রোগের সমষ্টি।এমন সব লোকদের সাহচর্য পরিহার কর, যারা অন্যের দোষত্র"টি খুঁজে বেড়ায়, কারণ তাদের সাথীরাও তাদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।অহমিকা হলো অনেকগুলো রোগের সমষ্টি।তোমার ভাইয়ের প্রতি ভালো কাজ করার মাধ্যমে তাকে তিরস্কার কর। আর তাকে অনুগ্রহ প্রদান করার মাধ্যমে তার খারাপ মনোভাবকে সরিয়ে দাও।ঘাতকের তরবারী শেষ পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে ইসলাম ও মুসলমানদের যাবতীয় সমস্যা সমাধানকারী এক চলন্ত অভিধানকে। কী সফল জীবন! পবিত্র কাবা অর্থাৎ আল্লাহর ঘরে জন্মগ্রহণ করবার বিরল সৌভাগ্য পেয়েছেন যিনি, তিনিই আবার আল্লাহর ঘরে নামায আদায়রত অবস্থায় ঘাতকের তরবারীর আঘাতে আহত হয়ে শহীদ হন। আর শহীদদের ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা হলো-"এবং যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলোনা, বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা বুঝতে পার না।" হে প্রভু! তাঁর উপর শান্তিবর্ষণ কর
দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব বলেছেন, আলী ইবনে আবি তালিবের মতো আরেকজনকে গর্ভে ধারণ ও প্রসব করার ক্ষমতা নারীকূলের কারো নেই, আলী না থাকলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত। ঐতিহাসিক ওসবর্ন হযরত আলী (আঃ)'র সামগ্রীক উন্নত চরিত্র ও উদার বা মহানুভবতার কথা বিশ্লেষণ করে তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মার অধিকারী মানুষ বলে মন্তব্য করেছেন। ঐতিহাসিক মাসুদীর মতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পর তাঁর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি মাত্রায় একমাত্র হযরত আলী (আঃ) মধ্যেই দেখা গেছে। এবারে হযরত আলী (আঃ)'র প্রবাদতুল্য কয়েকটি বাণী তুলে ধরছিঃ*বাহ্যিক অলংকার ও পোশাক-পরিচ্ছদ সৌন্দর্য নয়, সৌন্দর্য হল-জ্ঞান ও সভ্যতা। যার পিতা-মাতা মারা গেছে সে এতীম নয়, প্রকৃত এতীম সে যার মধ্যে জ্ঞান ও বিবেক নেই। *সত্যকে আঁকড়ে ধর, যদি তাতে তোমার ক্ষতিও হয় এবং মিথ্যাকে বর্জন কর যদি মিথ্যা দিয়ে তোমার লাভও হয়। আর এটাই হল ঈমান।
হযরত আলী (আঃ) জীবনের প্রথম থেকে সব সময়ই সবার সাথে ন্যায় আচরণ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন সুশৃঙ্খল ও সব দিকে ভারসাম্যপূর্ণ বা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তি। মনুষ্যত্বের প্রতিটি সদগুণ তাঁর মধ্যে ছিল। হযরত আলী (আঃ) ছিলেন একাধারে একজন আরেফ বা আধ্যাত্মিক গুঢ় রহস্য আয়ত্তকারী সাধক, সমাজের নেতা, আত্মসত্তা বিসর্জনকারী ব্যক্তি ও একজন শ্রেষ্ঠ মুজাহিদ, বিচারক ও শ্রমিক এবং একজন শ্রেষ্ঠ বক্তা ও লেখক। আর এইসব গুণাবলী নিয়ে তিনি ছিলেন পূর্ণতার সকল অর্থে একজন পূর্ণাঙ্গ মানব। এই পূর্ণাঙ্গ মানবের জীবনাদর্শ হোক আমাদের চলার পথের পাথেয় এবং ঈমানকে প্রদীপ্ত ও উজ্জীবীত করার মাধ্যম। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী-(আঃ) এর শাহাদত দিবসে মহান আল্লাহর কাছে এটাই আমাদের একান্ত প্রার্থনা। (সূত্র: তেহরান বাংলা বেতার)
 
 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন