আশুরা বিপ্লব-ছয়

আশুরা বিপ্লব-ছয়

আশুরা বিপ্লব-ছয়
মহররমের ১০ তারিখে অর্থাত্‍ পবিত্র আশুরার দিন রাসূল (সাঃ)এর দৌহিত্র এবং আমিরুল মোমেনীন ও হযরত ফাতেমা (সাঃ)এর প্রানাধিক প্রিয় পুত্র ইমাম হুসাইন (আঃ) কারবালার ময়দানে ‍এজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে শাহাদাতবরণ করেন ৷ ইমাম হুসাইন (আঃ) ইয়াজিদের অন্যায় দাবীর প্রতিবাদে সেদিন যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তা বিশ্ববাসীর জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ৷ ইমাম হুসাইনের ত্যাগ ও কুরবানীকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্বের নির্যাতিত মুসলমানরা আজও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে ৷ আর ইমাম হুসাইনের আদর্শকে ধারণ করেই ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে ৷
এ প্রসঙ্গে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনী (রহঃ) বলেছেন, 'আমাদের যা কিছু অর্জন করেছি, তার সবই পবিত্র আশুরা ও শাহাদাতে কারবালা থেকে'-অর্থাত্‍ আমরা যা যা ভাল জিনিস পেয়েছি, নতুন সমাজ গড়েছি, বিশ্বের বুকে নতুন করে মহানবী (সাঃ) আনীত প্রকৃত ইসলামকে পেয়েছি-তার সবই শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন (আঃ) এর শাহাদাত থেকেই পেয়েছি ৷
একথা সবাই জানে যে, ঐতিহাসিক কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ইমাম হুসাইন ও ইয়াজিদের মধ্যে ৷ যুদ্ধের মূল ঘটনা বর্ণনার আগে আমরা এই দুই ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরছি ৷ ইমাম হুসাইন ছিলেন রাসুলের নাতি এবং আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী ও হযরত ফাতিমা (সাঃ আঃ)'র পুত্র ৷ রাসূল (সাঃ) ইমাম হুসাইনকে অত্যন্ত ভালবাসতেন ৷ তিনি বলতেন, 'হুসাইন আমা হতে আর আমি আমি হুসাইন হতে ৷' আবু হুরাইরা বলেছেন, একদিন রাসুল (সাঃ) ইমাম হাসান ও হুসাইনকে কাঁধে বসিয়ে আমাদের দিকে এলেন ৷ এ সময় তিনি সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, যে আমার এই দুই সন্তানকে ভালবাসবে সে আমাকে ভালবাসলো আর যে তাদের সাথে শত্রুতা করবে সে আমার সাথে শত্রুতা করলো ৷ ' নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে, 'যখন আবু সুফিয়ানের পুত্র মুয়াবিয়া এবং মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ ইসলামকে ধ্বংস এবং এর নাম নিশানা মুছে দিতে চাইবে তখন ইমাম হুসাইনের মাধ্যমে ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হবে ৷'
ইমাম হুসাইনের পর এবার আমরা কারবালা যুদ্ধের খলনায়ক- পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরছি ৷ ইয়াজিদ ছিল আমীর মুয়াবিয়ার পুত্র ৷ সে ছিল মদ পানকারী, অত্যাচারী, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠনকারী ও ভোগবিলাসী একজন যুবক৷ মানব চরিত্রের এমন কোন বদগুণ নেই যা ইয়াজিদের মধ্যে ছিল না ৷ মুয়াবিয়া তার অযোগ্য পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী শাসক হিসেবে নিযুক্ত করলেও জনগন তা মেনে নেয় নি ৷ কারণ শয়তানি ও লম্পট আচরণের জন্য জনগন তার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল ৷ যা হোক, জনগণের মতামতকে না মেনে পিতার মৃতু্যর পর ইয়াজিদ মুসলিম জাহানের শাসক হিসেবে নিজেকে ঘোষনা করে ৷ কিন্তু সে জানতো যে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে ইমাম হুসাইনের বায়াত বা আনুগত্য জরুরী ৷ তাই সে ক্ষমতায় বসেই মদীনার গভর্ণর অলিদ ইবনে ওতবাকে হুকুম দেয় যে, ইমাম হুসাইন যেন ইয়াজিদের শাসন মেনে নেয় ৷ আর অস্বীকার করলে যেন তাঁকে হত্যা করা হয়৷
মদীনার গভর্ণর যখন ইমামকে একথা জানালেন তখন ইমাম বললেন',নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাবো ৷ তিনি গভর্ণরকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি আল্লাহর পরিবর্তে কখনো শয়তানের কাছে আত্মসমর্পন করবেন না ৷ ইমামের বলিষ্ঠ বক্তব্য শুনে ইয়াজিদ শক্তি প্রয়োগ করতে শুরু করলো ৷ এ অবস্থায় তিনি বাধ্য হয়ে মক্কায় চলে যান৷ কিন্তু মক্কাতেও উয়াজিদের সড়যন্ত্র থেমে থাকলো না ৷ ইয়াজিদ কাবার পবিত্র প্রাচীরের মধ্যে গোপনে ইমামকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলো ৷ এ সময় কুফা থেকে হাজার হাজার চিঠি আসে ইমামের কাছে৷ তারা ইমামকে কুফা যেতে আবেদন জানায় যেন তারা জালেম ইয়াজিদি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারে৷ অবস্থায় কাবার পবিত্রতা রক্ষা এবং নিরাপত্তার খাতিরে ইমাম তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন ৷ যাত্রা পথে তিনি কখনো ইঙ্গিতে আবার কখনো সরাসরি ঘোষণা দেন,' আমার যাত্রার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইয়াজিদের অনৈসলামী শাসনের প্রতিবাদ করা; অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং মুহাম্মদী ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটানো ৷
সঙ্গী সাথীদের নিয়ে যখন তিনি কারবালায় পৌঁছলেন তখন তার ঘোড়াটি রহস্যজনকভাবে থেমে গেল এবং তা কোনমতেই আর নড়ল না ৷ এ সময় ইমাম বললেন,'এই সেই ভূমি, যা আমাদের জন্য কষ্টের ও নির্যাতনের৷' এরপর ইমাম ঘোড়া থেকে নেমে সেখানে তাঁবু তৈরী করার জন্য তার অনুসারীদের নির্দেশ দিলেন ৷ এদিকে ইয়াজিদের বিশাল বাহিনী কারবালার মরুভূমিতে ইমামের সঙ্গী সাথীদেরকে ঘেরাও করে রাখলো ৷ তারা অত্যনত্ম অমানবিকভাবে ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দিল ৷ ইমামের তাঁবুতে পানির অভাবে হাহাকার পড়ে গেল৷ ইয়াজিদ ফরমান জারি করলো 'হয় তাকে শাসক হিসেবে নেতৃত্ব মেনে নিতে হবে অথবা ইমাম হুসাইনকে মৃত্যুবরন করতে হবে ৷' কিন্তু ইমাম হুসাইন ইয়াজিদের এই অন্যায় হুমকির তোয়াক্কা না করে হাতে যা ছিল তা-ই নিয়ে ইয়াজিদ বাহিনীকে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিলেন ৷ ১০ই মহররম ভোর বেলায় ইয়াজিদের হাজার হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন ঈমানের বলে বলিয়ান এক ক্ষুদ্রবাহিনী ৷ এ দৃশ্যটি বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশের কবি আসাদ বিন হাফিজ তাঁর কারবালা কাহিনী কবিতায়৷ কবি লিখেছেন-
কম বেশী সকলের জানা কাহিনী
মুখোমুখি দুই দল সেনাবাহিনী ৷
একদল সত্যের পতাকাবাহী
আরেক দল দুনিয়ায় চায় বাদশাহী ৷
সত্যের দলনেতা ইমাম হোসেন
বাদশাহী আশা বুকে এজিদ পোষেণ ৷
নবীজির নাতি তিনি, পুত্র আলীর
ফাতেমার নয়নের মনি মহাবীর ৷
ইমাম হোসেন নাম, হাসানের ভাই
তাঁর সাথে এজিদের বাঁধলো লড়াই ৷
মুক্ত কৃপাণ হাতে দুই দল খাড়া
চারদিকে বেজে উঠে কাড়া নাকাড়া ৷
শন শন তীর ছোটে এদিক-ওদিক
ঘোড়ার খুরের আওয়াজ বাজে চারদিক ৷
ফোরাত নদীর কুল কারবালা মাঠ
মানুষের লাশ দিয়ে হ'ল তা ভরাট ৷
এজিদের তাঁবু জুড়ে বাসা বাঁধে ভয়
অবশেষে থামে এই যুদ্ধ প্রলয় ৷
লড়াই থামলে ইমাম তাকিয়ে দেখেন
সাথী হারা তিনি যেন একাকী আছেন ৷
মনের দুঃখে ইমাম হয়ে অসহায়
নিজেকে লুটিয়ে দেন মরু বালুকায় ৷
তখন সেখানে এক পাষন্ড সীমার
এসে নিজ হাতে কাটে ইমামের ঘাড় ৷
ছিন্ন মসত্মক গেঁথে বর্শার আগায়
নরপশু ছুটে চলে এজিদ সভায় ৷
কম বেশী সকলের এই জানা কাহিনী
স্মরণে আস্লে ফেলে দু'চোখের পানি ৷
হাজার বছর আগে মহররম মাসে
ঘটেছিল আজও তবু হৃদয়ে তা ভাসে ৷
পরিশেষে বলতে চাই, ইমাম হুসাইন (আঃ) জালিম ইয়াজিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন যে, কোন শাসক ইসলামের নীতিমালা থেকে দুরে সরে গেলে কিংবা অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করলে তার বিরুদ্ধে নিজের সাধ্যনুযায়ী সংগ্রাম করতে হবে ৷ ইমাম হুসাইন তাঁর নিজের, পরিবার পরিজনের এবং সঙ্গী সাথীদের জীবন উত্সয়র্গ করে ইসলামকে যেভাবে রক্ষা করে গেছেন, তেমনিভাবে বিশ্বের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে সে দৃষ্টানত্ম অনুসরণ করতে হবে ৷ তাহলে ইমাম হুসাইন ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে ৷  সূত্রঃ ইন্টারনেট
 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন