মহররমের তাৎপর্য ও মূল্যবোধ

পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজীরবিহীন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ইমাম হোসাইন (আ) ইসলামের সঠিক বার্তাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। নৈতিক , চারিত্র্যিক এবং মানবীয় সকল অসৎ গুণাবলী যাদের ছিল মজ্জাগত , তারা ইসলামী খেলাফতকে পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে ভোগ করতে গিয়ে ইসলা

মহররমের তাৎপর্য ও মূল্যবোধ

পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজীরবিহীন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ইমাম হোসাইন (আ) ইসলামের সঠিক বার্তাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। নৈতিক , চারিত্র্যিক এবং মানবীয় সকল অসৎ গুণাবলী যাদের ছিল মজ্জাগত , তারা ইসলামী খেলাফতকে পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে ভোগ করতে গিয়ে ইসলামের সুমহান আদর্শকেই কলঙ্কিত করতে বসেছিল। ইসলামের নামে এই স্বেচ্ছাচার নবী তণয় ইমাম হোসাইন (আ) কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। উপরন্তু খেলাফতের অধিকার ছিল ইমাম হোসাইন (আ) এর। অথচ উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়ার সাথে ইমাম হাসানের (আ) চুক্তি ভঙ্গ করে মুয়াবিয়া-পুত্র ইয়াযিদ ক্ষমতার আসনে বসেই তার সামনের সবচে বড় চ্যালেঞ্জ ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগে যায়। ইমাম হোসাইন (আ) এই সঙ্কটকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করেন, যাতে বিশ্ববাসী প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অবহিত হবার সুযোগ পায় এবং ইসলামের প্রকৃত বার্তা ধীরে সুস্থে হলেও সবার কাছে পৌঁছে যায়। সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইনের সেই আন্দোলনকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়। কালের অমোঘ পরিক্রমায় দেখা গেছে, ভালো এবং মন্দের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলে এসেছে আদিকাল থেকে। সত্যের পক্ষে কোনো কোনো সংগ্রাম ছিল দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আবার কোনো কোনো সংগ্রাম ছিল অত্যাচারীদের রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে অস্পষ্ট। ইমাম হোসাইন (আ) এর যে আন্দোলন তা ছিল তৎকালীন শাসকবৃন্দের ইসলামবিনাশী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট সংগ্রাম। যদিও সে সময়কার জনগণের কাছে অজ্ঞানতার কারণে তা ছিল রাজনৈতিক মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো অস্পষ্ট। যার ফলে তখন ইসলাম অনুরাগীরাও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলাচলে ভুগেছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আজ ব্যাপক গবেষণা আর ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হয়ে গেছে সবার সামনে। গবেষকরা আজ ইমাম হোসাইনের সেই সংগ্রামের যথার্থতা খুঁজে পেয়েছেন। এতোকাল পর তাঁর আন্দোলনের যথার্থতা খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই অনুমিত হয় যে ইমাম হোসাইনের সেই আন্দোলন কতো সুদূরপ্রসারী ছিল।সমাজ বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের মূল্যবোধগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়। অধ্যাপক মুর্তজা মোতাহহারীর দৃষ্টিতে এসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধটি হলো তাঁর সহজাত সত্যনিষ্ঠা ও অবিচল সততা। আসলে প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব কিছু সহজাত বৈশিষ্ট্য থাকে। ঐ বৈশিষ্ট্যের আলোকেই তাঁর জীবনের সকল কিছু পরিচালিত হয়। ইমাম হোসাইন (আ) এর জীবনের বৈশিষ্ট্যও ছিল এরকম দৃঢ় সততায় সমৃদ্ধ। তার কারণ ইমাম হোসাইনের জীবনের যে মূল্যবোধগুলো ছিল,সেগুলো স্বয়ং রাসূলে খোদার আদর্শ ও শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত।
রাসূলের শিক্ষা মানেই হলো আল-কোরআনের শিক্ষা। আর আল-কোরআনের শিক্ষা হলো অনৈসলামি বা খোদাদ্রোহী শক্তির কাছে মাথানত না করা, শাহাদাৎকামিতা, নিজস্ব আদর্শকে সমুন্নত রাখার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা। হোসাইনী আন্দোলনের মূল্যবোধগুলোকে বিখ্যাত গবেষক অধ্যাপক মুর্তজা মোতাহহারী দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। একটি ক্ষুদ্র, অপরটি বৃহত্তর মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধগুলোই ইমাম হোসাইনের আন্দোলনকে কালজয়ী স্থায়িত্ব বা চিরন্তন ঐশ্বর্য দিয়েছে। এইসব মূল্যবোধ ইমাম হোসাইনের মধ্যে যেমন ছিল তেমনি তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মধ্যেও ছিল। ক্ষুদ্র মূল্যবোধগুলোর মধ্যে একটি হলো তাঁর সুদূরপ্রসারী ও সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী। সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী বলতে রূপকার্থে বলা যায় , ইমাম হোসাইন একটা ইটের মধ্যেও যা স্বাভাবিকভাবেই দেখতে পেতেন অন্যরা তা আয়নাতেও দেখতে পেত না। আমরা এখন সেইযুগের পরিস্থিতি বিশে-ষণ করছি অথচ সেইযুগের মানুষেরা ইমাম হোসাইন ইবনে আলী যেরকম বুঝতেন সেরকম বুঝতো না। শহীদ অধ্যাপক মোতাহ্হারীর মতে হোসাইনী আন্দোলনের পেছনে ছিল একটা গভীর বোধ ও উপলব্ধি। এই বোধই তাঁর আন্দোলনকে মহান করে তুলেছে। এই উপলব্ধিটা হলো উমাইয়া শাসকরা যে খেলাফতির নেপথ্যে ইসলাম-বিরোধী কার্যকলাপ চালাতো, তা জনগণ প্রকাশ্যে দেখতে পেত না, কিন্তু ইমাম হোসাইন তাঁর দৃষ্টি প্রখরতার কারণে দেখতে পেতেন। ইমাম হোসাইন এযিদের ক্ষমতাসীন হবার কথা শুনে বলেছিলেন "নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্যে এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করবো ! হে ইসলাম বিদায় ! যখন উম্মতের জন্যে এযিদের মত ব্যক্তি নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়।" তাঁর এই উক্তি দূরদৃষ্টিরই পরিচায়ক, কেননা অন্যরা ইয়াযিদকে সেভাবে চিনতে পারে নি, যেভাবে চিনতে পেরেছিলেন ইমাম। সমকালীন জনগণের উপলব্ধিগত দুর্বলতা, তাঁদের স্থূলদৃষ্টি , এবং বিস্মৃতি ইমাম হোসাইনের শাহাদাৎলাভের একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ।"
অধ্যাপক মোতাহহারী এ প্রসঙ্গে বলেছেন,"উমাইয়াদের প্রতি জনগণের সমর্থনের একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাদের অজ্ঞতা বা মূর্খতা। ইমাম হোসাইন ইয়াযিদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতেন না। কারণ তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা ছিল এর অনেক উর্ধ্বে । কিন্তু ইয়াযিদের সাথে যে সংঘর্ষ তাঁর বেধেছিল তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিলো ব্যক্তিগত পর্যায়ের অনেক উর্ধ্বে। তাঁর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল সামগ্রিক এবং মৌলিক। বস্তুত তিনি ইয়াযিদের সাথে নয় বরং জুলুম নির্যাতন এবং অজ্ঞানতামূর্খতার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছেন। কেননা ক্বাবা যেয়ারতকালে তিনি আমাদেরকে শিক্ষা ও উপদেশ দিয়ে বলেছেন যে, এই সংগ্রামের লক্ষ্য হলো মূর্খতা এবং গোমরাহী দূর করা। ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের চেহলামের দোয়ায় যেমনটি রয়েছে-হে খোদা ! ইমাম হোসাইন তাঁর হৃদয়ের রক্ত তোমার পথে উৎসর্গ করে দিয়েছেন যাতে তোমার বান্দারা মূর্খতা এবং গোমরাহী থেকে মুক্তি পায়।"
সর্বোপরি বলা যায় জনগণের বিস্মৃতিই ইমাম হোসাইনের শাহাদাত ডেকে এনেছে। কেননা; জনগণ যদি তাদের বিগত পঞ্চাশ-ষাট বছরের ইতিহাসের দিকে তাকাতো, যদি সেই ইতিহাস নিয়ে খানিকটা ভাবতো এবং তাদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতো অর্থাৎ ঐ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতো, তাহলে হয়তো কারবালার ঐ মর্মান্তিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হতো না। দ্বিতীয় যে মূল্যবোধটি ইমাম হোসাইনের মধ্যে ছিল তা হলো বিজয়ের ব্যাপারে দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস। বিজয় একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। সাময়িকভাবে কারবালায় ইমাম হোসাইন এবং তাঁর পরিবার-পরিজন শাহাদাৎ লাভ করেছেন বটে। কিংবা তাঁদের শাহাদাতের ঘটনায় ইয়াযিদের পক্ষে যুদ্ধের ফলাফল গেছে বৈকি ! কিন্তু বৃহত্তর জয় ইমামেরই হয়েছে। ইমাম খোমেনী (রহ) যেমনটি বলেছেন-তলোয়ারের ওপর রক্তের বিজয়। কিংবা মওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর যেমনটি বলেছেন,

কাতলে হোসাইন আসল মে মার্গে ইয়াযিদ হ্যায়
ইসলাম যেন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ
অর্থাৎ
হোসাইনের হত্যা মূলত ইয়াযিদেরই মৃত্যু
ইসলাম জেগে ওঠে প্রতিটি কারবালার পর

এখন কথা হলো এ বিজয় কোন্ ধরনের বিজয়। বিশে-ষকগণ এ বিজয় সম্পর্কে বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কোনো আন্দোলন যদি আদর্শ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভিত্তিক হয় এবং ঐ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে যদি আন্দোলনকারীরা নিশ্চিত হন, তাহলে সেই সংগ্রামে সামরিক বিজয় না হলেও আদর্শিক বিজয় ঘটে। এই বিজয় তাই সাময়িক নয় বরং সুদূরপ্রসারী। তাই যাঁরা আন্দোলন করেন, তাঁরা হয়তো এই বিজয় স্বচক্ষে নাও দেখতে পারেন, তবে তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম কিংবা দূর ভবিষ্যৎ যুগের প্রজন্ম অবশ্যই ঐ আদর্শিক বিজয় লাভ করেন। আর এ ধরনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারীদেরই বিজয় অর্জিত হয়। ইমাম হোসাইনের বিজয় এধরনেরই আদর্শিক বিজয় ছিল। অন্যদিকে যে-কোনো যুগেই কারো ওপর যদি আদর্শিক কোনো দায়িত্ব থাকে, এবং সেই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে গিয়ে যদি বাহ্যত পরাজয়ও পরিলক্ষিত হয়, তাহলে তা বিজয়। ইমাম হোসাইন (আ) যে আন্দোলন করেছেন, তা ছিল আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকারের দাবী অনুযায়ী তাঁর ধর্মীয় ও ঈমানী দায়িত্ব। তিনি মক্কা থেকে কারবালা যাবার পথে বিভিন্ন ভাষণে সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, আমার যাত্রার উদ্দেশ্য হলো কপট উমাইয়া শাসকদের স্বরূপ উন্মাচন করা, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। আল-কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মুহাম্মাদী দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করা ছাড়া আমার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। ইমাম হোসাইন (আ) এর এই আন্দোলনের আরো বহু তাৎপর্য রয়েছে। তিনি ছিলেন রাসূল পরিবারের সদস্য। ফলে তাঁর মর্যাদাও ছিল সর্বোন্নত। তিনি তো অন্য কোনো সাধারণ মানুষের মতো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সংগ্রামী পথ থেকে মৃত্যুর ভয়ে সরে যেতে পারেন না। তাঁর আন্দোলন বিপ্লবতুল্য হওয়াটাই ছিল সমীচীন। তিনি অন্যদের মতো ইসলামের নীতি আদর্শ ক্ষুনড়ব হতে দেখে চুপ করে থাকতে পারেন না। কারবালায় ইমাম হোসাইন মানুষকে এই ব্যক্তিত্ব এবং আত্মসম্মানবোধও শিক্ষা দিয়েছেন ।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তারই পথে আত্মনিবেদনে সর্বাবস্থায় দৃঢ় মনোবল থাকাটাও এই আন্দোলন থেকে শিক্ষণীয় আরেকটি মূল্যবোধ। আত্মত্যাগ, মহানুভবতা, ইসলামী সাম্য এবং আল্লাহর পথে জাগৃতির প্রেরণা প্রভৃতি দিকগুলো এই আন্দোলনের আরো কিছু মহান লক্ষ্য। সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ সংক্রান্ত আল-কোরআন প্রদত্ত মহান দায়িত্ব পালন, সংস্কারকামিতা, মুসলমানদের ইসলামী চেতনাকে চাঙ্গা করা, ইসলামের সার্বজনীনতাকে তুলে ধরা প্রভৃতি হোসাইনী আন্দোলনের বৃহত্তর মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত।
 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন