আশুরার পূর্ব রাত

আজ আশুরার পূর্ব রাত । যেন মহাপ্রলয়ের পূর্ব রাত । কারবালা প্রান্তরের বাতাসেও আজ শোকের পূর্বাভাস । বোবা পশুরাও টের পেয়ে গেছে তাদের মধ্যেও অস্বাভাবিক অস্থিরতা । আজ আকাশের তারাগুলোর কোন ঝিকিমিকি নেই, নিস্প্রভ । তাদের মধ্যেও মেঘের আড়ালে লুকাবার প্রচেষ্টা । ফোর

আশুরার পূর্ব রাত
আজ আশুরার পূর্ব রাত । যেন মহাপ্রলয়ের পূর্ব রাত । কারবালা প্রান্তরের বাতাসেও আজ শোকের পূর্বাভাস । বোবা পশুরাও টের পেয়ে গেছে তাদের মধ্যেও অস্বাভাবিক অস্থিরতা । আজ আকাশের তারাগুলোর কোন ঝিকিমিকি নেই, নিস্প্রভ । তাদের মধ্যেও মেঘের আড়ালে লুকাবার প্রচেষ্টা । ফোরাত নদীর পানির প্রবাহ আজ বারবার থমকে দাড়াচ্ছে । বোবা পরিবেশ আর পশুগুলোর বুক ফাটা আর্তনাদে কি যেন বলতে চাইছে । কিন্তু হায় ! আমরা তাদের ভাষা বুঝি না । শুধু বাতাসের দীর্ঘশ্বাস আমাদের কানে এসে বাজছে । হ্যাঁ , আগামীকাল রাসুলের কলিজার টুকরো খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমার নয়নমনি ইমাম হোসেন ( আঃ ) শহীদ হবেন । নবীজী যে গলদেশে চুম্বন করেছেন সেখানে ছুরি চালানো হবে ; যে দেহে তিনি তার অসংখ্য পবিত্র চুম্বনের পরশ বুলিয়েছেন সেই মোবারক দেহের উপর দিয়ে দশটি ঘোড়া দাবড়ানো হবে । হায় কারবালা ! হায় হোসেন ! আগামীকাল সারা বিশ্ব শোকে দুলে উঠবে । স্বয়ং রাসুল এই শোকের স্বত্বাধিকারী । সাত আসমানের ফেরেশতারাও শোকের পোষাক পড়েছেন । ইমাম হোসেন (আঃ) এর বোন জয়নাবের কান্নায় ফেরেশতাদের অশ্রু র বাঁধ ভেঙ্গে গেছে । তাদের ব্যাথা ভরা আহাজারীতে খোদার আরশ আজ কেঁপে উঠেছে । খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমাও অশ্রু সজল চোখে শরীক হয়েছেন এ মাতমে । কারবালার উষর প্রান্তরে নবী পরিবারের সদস্যদেরকে এজিদের সৈন্যরা পরিবেষ্টন করে রাখার নয় দিন অতিক্রান্ত হয়েছে । এ নয়দিন ইমাম হোসেন (আঃ) এজিদের বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বহু নসিহত করেন । তারা যে জঘণ্য পাপ করতে উদ্যত হয়েছে তিনি সে সম্পর্কে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেন । এজিদ নিযুক্ত কুফার শাসনকর্তা উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদ ক্রমেই শঙ্কিত হয়ে ওঠে । সে ওমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে কারবালায় হাজার হাজার সৈন্য প্রেরণ করতে থাকে । এই সৈন্য সংখ্যা অচিরেই বিশ হাজার ছাড়িয়ে যায় । ইমাম হোসেন (আঃ) তারপরও হাল ছাড়েন না । তার অন্তর যে দয়ায় আপ্লুত। তিনি যে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত, নবীজীর দৌহিত্র তার দেহে প্রকৃত বীর হযরত আলীর রক্ত প্রবাহিত । তিনি শেষ মুহুর্তে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় শত্রু সেনাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা কি আমাকে চেন না ? তোমরা কি জাননা যে আমার নানা ছিলেন রাসুলে খোদা (সঃ) ? তোমরা কি জান আমার পিতা আলী বিন আবু তালিব ? তোমরা কি জাননা আমার মা হযরত ফাতেমা জাহরা (সাঃ) হলেন মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) এর কন্যা ? তোমরা কি জান আমার নানী ছিলেন ইসলাম গ্রহণকরী প্রথম মহিলা হযরত খাদিজা ( রাঃ ) ? তোমরা কি জান না যে সাইয়্যেদুস শোহাদা হযরত হামজা (রাঃ) ছিলেন আমার পিতার চাচা ? তোমরা কি জান না হযরত জাফর তাইয়াব (রাঃ) ছিলেন আমার চাচা ? তোমরা কি জানো রাসুলে খোদার পবিত্র তরবারী আমার হাতে রয়েছে ? তোমরা কি জান আমার মাথার এ পাগড়িটি মহানবী (সঃ) এর । তোমাদের কি জানা নেই আমার পিতা হযরত আলী ( আঃ ) প্রথম ব্যাক্তি যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং জ্ঞান ও ধৈর্যের ক্ষেত্রে অতুলনীয় ? আমার রক্ত তোমরা কি করে হালাল মনে করেছো , অথচ আমার বাবা হাউজে কাউসারের পানি পান করাবেন । কিয়ামতের দিন হামদের পতাকা তারই হাতে থাকবে । পাপে যখন মানুষের অন্তর সম্পূর্ণ কলুষিত হয়ে যায় তখন কোন নূরই তাদেরকে হেদায়েত করতে পারে না । ইমাম হোসেন (আঃ) এর এই বলিষ্ঠ ও আবেগময়ী ভাষণেও এজিদের বিভ্রান্ত সৈনিকদের মনে কোন পরিবর্তন এলো না । ইবনে জিয়াদ যুদ্ধ শুরুর জন্য তার সেনাপতি ইবনে সাদকে চরম পত্র দিল । হয় আমিরুল মোমেনিন হিসেবে এজিদের আনুগত্য স্বীকার করতে হবে নতুবা মৃত্যু । এছাড়া আর কোন পথ ইমামের সামনে খোলা রইল না । ইমাম এজিদের আনুগত্যের পরিবর্তে আল্লাহর আনুগত্যকেই বেছে নিলেন । কারণ তিনি নিজেই দোয়া করতেন, হে আল্লাহ ! " যতদিন পর্যন্ত আমি তোমার আনুগত্য করি অনুসরণ করি, ততদিন আমার হায়াত বাড়িয়ে দিও । আর যদি তা শয়তানের চারণভূমিতে পরিণত হয় তাহলে আমাকে তোমার কাছে তুলে নিও।" ইমাম হোসেন (আঃ) এর জীবনের সবচেয়ে বড় আশংকা ছিল শাহাদত । কারণ, রাসুলে খোদা স্বয়ং বলেছেন, শাহাদাত হচ্ছে সবচেয়ে বড় পূণ্য । ইমাম হোসেন (আঃ) এর মনে পড়ে গেল তার মহান পিতা ও শিক্ষক হযরত আলী (আঃ) এর কথা । ১৯ শে রমজান ভোর বেলায় দুশমন তার মাথায় আঘাত করলে তার কন্ঠ থেকে প্রথম যে কথাটি নিঃসৃত হয়েছিল , সেটি হলো কাবার প্রভুর কসম আমি কামিয়াব হয়েছি । শাহাদতের আগে তার পিতার মর্মভেদী কথাগুলো বার বার ঘুরে ঘুরে তার মনে হচ্ছিল । তিনি বলেছিলেন খোদার কসম , অনাকাঙ্খিত কিছুই ঘটেনি । ইমাম হোসেন (আঃ) এর মনে পড়ে গেল তার নানাজীর কথা । তিনি আধ্যাত্মিক জগতে তার উচ্চ মর্যাদার সুসংবাদ তাকে দিয়েছিলেন । এসব ভাবতে ভাবতে তার ক্লান্ত অবসনড়ব চোখে তন্দ্রা চলে এলো । স্বপেড়ব দেখলেন নানাজান রাসুালে খোদাকে, পিতা হযরত আলীকে, স্নেহময়ী মা ফাতেমাকে, আর ভাই ইমাম হাসানকে । তারা বললেন হে হোসেন ! তুমি আগামীকালই আমাদের সাথে মিলিত হবে । এর পরপরই তার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল । ইমাম হোসেন (আঃ) তার বোন বিবি জয়নাবকে স্বপ্নের কথা খুলে বললেন । ভাইয়ের নিশ্চিত শাহাদাতের কথা শুনে বোনের মন কি আর মানে ? জয়নাব ( সাঃ) চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন । ইমাম তাকে সান্তনা দিলেন । ইমাম হোসেন (আঃ) পরদিনের মহা কোরবানির জন্য প্রস্তুত হলেন । এই কোরবানি হবে সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য । এতে তিল পরিমান খাদ থাকতে পারবে না । কারণ আগামীকাল যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবেন তাদের প্রতিটি রক্ত বিন্দু শত সহস্র রক্ত বিন্দুতে নয় বরং লক্ষ-কোটি রক্ত বিন্দুতে পরিণত হয়ে সমাজদেহে সঞ্চালিত হবে । শহীদের খুন রক্তশূণ্যতায় আক্রান্ত সমাজদেহে নতুন রক্ত প্রবাহ দান করে । তাদের ব্যক্তিত্ব ও স্মৃতি যুগযুগ ধরে মানুষকে মুক্তির প্রেরণা যোগায় । তাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও চেতনা দান করে । শহীদরা কেয়ামত পর্যন্ত অমর থাকবেন এবং শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাদেরকে এমন জৌলুসসহ হাজির করবেন যে স্বর্গীয় বাহনে উপবিষ্ট নবী রাসূলরাও তাদেরকে সম্মান দেখানোর জন্য নীচে অবতরণ করবেন । তাই ইমাম তার কাফেলার মধ্যে যাদের নিয়্যতে বিন্দু পরিমান গোলমাল আছে তাদের কাছ থেকে মুক্ত হতে চাইলেন । তিনি সবাইকে একস্থানে সমবেত করলেন এবং শাহাদাতের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ভাষণ দিলেন । তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, "আমি আমার সঙ্গী সাথীদের চেয়ে কোন সাথীকে অধিক নেককার এবং আমার আহলে বাইতের চেয়ে কোন পরিবারকে অধিক উত্তম মনে করি না । মহান আল্লাহ তোমাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিন।" ভয়াবহ আশুরার পূর্বাভাস নিয়ে ঘনিয়ে এলো অন্ধকার । ধৈর্য্যর মূর্ত প্রতীক ইমাম হোসেন (আঃ) সকলকে কাছে ডাকলেন । বললেন, ভায়েরা আমার! জেনে রাখো আজকের এই রাত হবে তোমাদের শেষ রাত । আমার সাথে থাকলে তোমরা কেউ রেহাই পাবে না । আগামীকালই আমাকে ও আমার পরিবার পরিজনকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হবে । এমনকি আমার দুধের বাচ্চাকেও এরা রেহাই দেবে না । ভাইসব, "তোমরা ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারো । আমার হাতে তোমরা যে বায়াত করেছো, তা আমি ফিরিয়ে নিলাম । তোমরা এখন মুক্ত । আমার জন্যে শুধূ শুধু তোমরা কেন প্রাণ দেবে ? শত্রুরা শুধু আমাকে চায়, তোমাদেরকে নয় । এখন আন্ধকার রাত । যার ইচ্ছা চলে যাও , কেউ দেখতে পাবে না ।" ইমাম ভাষণ শেষ করে তার ভাই আব্বাসকে প্রদীপ নিভিয়ে দিতে বললেন । যখন অন্ধকার হয়ে এল তখন ইমামের সাথে আসা অনেক লোক সঙ্গোপনে ইমাম বাহিনী ত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল। সবাই পার্থিব লাভের আশায় মক্কা থেকে ইমামের সাথে যোগ দিয়েছিল । যখন আলো জালানো হল তখন দেখা গেল মুষ্টিমেয় কিছু লোক মাত্র রয়ে গেছেন । এদের সংখ্যা একশো জনেরও কম । আত্মত্যাগের আদর্শে বলীয়ান বিশুদ্ধ অন্তরের এই মর্দে মোমিনদের দিকে তাকিয়ে ইমামের প্রশান্ত মুখটা উজ্জল দ্বীপ্তিমান হয়ে উঠল । মহাকালের মহাত্যাগের জন্যে এরকম বিশুদ্ধ হৃদয়গুলোই তার প্রয়োজন ছিল । তবুও তিনি তার সাথীদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেন গেলে না ? এ প্রশ্ন শুনে আহলে বাইতের সদস্যরা বলে উঠলেন, একি বলছেন হযরত ! আমরা আপনাকে একা ফেলে কিভাবে চলে যাবো ? লোকের কাছে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবো ? আমরা কি বলব মহানবী (সঃ) এর সন্তানকে আমরা একা ফেলে চলে এসেছি । তা কখনো হবে না । নিজের জীবন দিয়ে দেব তবুও আপনাকে ছেড়ে যাব না । আপনার সাথে থেকে শহীদ হব । মুসলিম বিন আউসাজা দাঁড়িয়ে বললেন, প্রিয় ইমাম একি বলছেন আপনি । আপনাকে দুশমনদের হাতে ফেলে রেখে পালিয়ে যাবো ? খোদা আপনার পরে যেন আমাদের জীবিত না রাখেন । আমরা যুদ্ধ করবো । গায়ে শক্তি থাকা পর্যন্ত দুশমনের গায়ে তলোয়ার চালাবো, বর্শা চালবো । ওগুলো ভেঙ্গে গেলে পাথর মেরে মেরে যুদ্ধ করবো । সাঈদ বিন আবদুল্লাহ হানাফী বললেন, প্রিয় ইমাম ! খোদার কসম আপনাকে রেখে আমরা কোথাও যাবোনা । আপনার জন্যে যদি নিহত হই এবং জীবন্ত দগ্ধ হই এবং তা যদি ৭০ বারও হয় তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না । আপনি মরে যাবেন আর আমরা বেচে থাকব এ কি করে হয় ! যুহাইর ইবনে কাইন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হে মহানবীর প্রিয় সন্তান, আপনি ও আপনার পরিবারকে রক্ষার জন্যে আমাকে যদি হাজারবারও মেরে ফেলা হয় তাহলেও আমি আপনাকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করব । এভাবে ইমামের বিভিন্ন সঙ্গী সাথী ইমামকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন , নিজেদের আন্তরিকতা প্রকাশ করতে লাগলেন । সঙ্গী সাথীদের এরকম দৃঢ়তা দেখে ইমামের চেহারা মোবারক এক অভূতপূর্ব প্রফুল্লায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল । তিনি মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন । ইমাম হোসেন (আঃ)এর ভাষনের পর সবাই ছত্রভংগ হয়ে মশগুল হলেন এবাদতে । কেউ সেজদায়, কেউ নামাজে, কেউ মুনাজাতে । কারবালার প্রান্তর সিক্ত হয়ে উঠল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহীদদের অশ্রুতে । দুনিয়ার সব ফেরেশতা যোগ দিলেন তাদের এই প্রার্থনায় ।  সূত্রঃ ইন্টারনেট
 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন