পারস্য উপসাগরে ঘিরে আবারও উপনিবেশবাদী ব্রিটেন ষড়যন্ত্র

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বাহরাইনে বলেছেন, সামরিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভূমিকা জোরদারের জন্য ব্রিটেন আবারও এ অঞ্চলে ফিরে এসেছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাহরাইনের রাজধানী মানামায় পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের বৈঠকে উপস্

পারস্য উপসাগরে ঘিরে আবারও উপনিবেশবাদী ব্রিটেন ষড়যন্ত্র

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বাহরাইনে বলেছেন, সামরিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভূমিকা জোরদারের জন্য ব্রিটেন আবারও এ অঞ্চলে ফিরে এসেছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাহরাইনের রাজধানী মানামায় পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের বৈঠকে উপস্থিত হয়ে তারা এ কথা বলেন।  

ইরানকে নিয়ে বা ইরানের আশপাশের অঞ্চলকে নিয়ে নানা সময়ে বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক জোট গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়াও সম্পন্ন হয়েছে নানা চুক্তি। যেমন, সাদাবাদ প্যাক্ট, বাগদাদ প্যাক্ট, সেন্টো চুক্তি, আরব লিগ ও পিজিসিসি ইত্যাদি। এইসব চুক্তি ও জোট সব সময়ই ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। 

সেইসব চুক্তি ও জোট এমন সময়ে হয়েছিল যখন বিশ্ব ছিল দুই-মেরুকেন্দ্রীক। সাবেক সোভিয়েত ও মার্কিন ব্লকের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা এবং তাদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ছিল এইসব চুক্তি ও জোটের মূল উদ্দেশ্য। আঞ্চলিক নিরাপত্তার চাহিদা ছিল এসব ক্ষেত্রে গৌণ। এ অঞ্চলের বর্তমান সময়ের পরিস্থিতিও অনেকটা একই রকম। 

বর্তমান সময়েও পশ্চিমা নানা দেশ নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে তাদের অস্ত্র-বাজার ও অস্ত্র-ব্যবসাকে রমরমা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক নানা জোট গঠন ও চুক্তিগুলোর পেছনের মূল চালিকা শক্তিই হল এই অস্ত্র-ব্যবসা। বিশেষ করে সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবের কাছে ব্রিটেনের অস্ত্র রফতানি তিন হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে। ব্রিটেন বর্তমানে অস্ত্র রফতানিকে তার অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যমে পরিণত করেছে। 

সৌদি সরকার ব্রিটেনের ক্লাস্টার বা গুচ্ছ-বোমাসহ নানা অস্ত্র দিয়ে ইয়েমেনে গণহত্যা চালাচ্ছে ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু এ বিষয়টি লন্ডনের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়!  

সম্প্রতি ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ান লিখেছে: ব্রিটেন গত এক দশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। এ সময়ে ব্রিটেন ৯ হাজার ৮০০ কোটি পাউন্ড মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে। গত বছরে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানির ৬৩ শতাংশ চালানই গেছে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে। 

ব্রিটেনের দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টও সম্প্রতি লিখেছে, ব্রিটেনের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সামরিক শিল্প। এ খাত থেকে ব্রিটেন প্রতি বছর আয় করছে প্রায় সাতশ ৭০ কোটি পাউন্ড। 

অন্যদিকে পেন্টাগনের এক তথ্যে বলা হয়েছে, মার্কিন সরকার ২০০৯ সাল থেকে সৌদি সরকারের কাছে ১১৫ বিলিয়ন তথা ১১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে যা নজিরবিহীন। এ সময়ে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে মোট ১১ হাজার ৯৮০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে ওয়াশিংটন।  এইসব চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে বহু বছর লাগবে। বিশেষ করে চুক্তি মোতাবেক সৌদি আরবের কাছে মার্কিন অস্ত্রের চালান পৌঁছবে ২০২০ সাল পর্যন্ত। 

পাশ্চাত্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলোর কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে তিন পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে এ অঞ্চলে পশ্চিমা অস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক জোট ন্যাটোর পক্ষ থেকে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরব লিগ বা পিজিসিসি’র আওতায়। আর তৃতীয় পর্যায়ে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ পশ্চিমা সরকারগুলো দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় অস্ত্র বিক্রি করছে পাশ্চাত্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলোর কাছে। আর এ পর্যায়েই সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। ইরানকে এ অঞ্চলের জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরেই রাজা-বাদশাহদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে এইসব পশ্চিমা অস্ত্র।  

পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বড় হস্তক্ষেপকামী বিজাতীয় শক্তি হিসেবে এখনও সক্রিয় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে দেশটির রয়েছে ১৪ টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি। 

কোনো কোনা বিশ্লেষক বলছেন, ওয়াশিংটন পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে খেলোয়াড়ের ভূমিকা ছেড়ে দিয়ে খেলানোর ভূমিকায় নামছে এবং পরোক্ষভাবে আঞ্চলিক নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ভূমিকা রাখছে। এ অঞ্চলে নিরাপত্তার নতুন সমীকরণ সৃষ্টি তার উদ্দেশ্য। আবার বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, মার্কিন সরকার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তার নতুন কৌশল তুলে ধরছে এবং এরই আলোকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে তার নানা নীতি। আর এ বিষয়টি ব্রিটেনের থেরেসা মে’র ঘোষিত নয়া নীতির সঙ্গে মিলে যায়। এ নীতির আলোকে ওয়াশিংটন ও লন্ডন এ অঞ্চলের নিরাপত্তায় ইসলামী ইরানের কার্যকর ও জোরালো ভূমিকাকে উপেক্ষা করছে। এ ছাড়াও ইরান এবং তার বিপুল সামরিক শক্তিকে এ অঞ্চলের জন্য হুমকি বলে তুলে ধরছে ‌এ দুই শক্তি। মূলত এ নীতির আলোকেই গড়ে তোলা হয়েছে পিজিসিসি বা পারস্য-উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ। 

পিজিসিসি বা পারস্য-উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ গড়ে তোলা হয় ১৯৮৪ সালে ‘আইল্যান্ড শিল্ড’ বা ‘দ্বীপ-বর্ম’ নামের যৌথ প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন সংক্রান্ত চুক্তির আওতায়। দিনকে দিন পশ্চিমা অস্ত্র কেনার মাত্রা বাড়াচ্ছে এই জোট এবং জোটটি মূলত ইসলামী ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টি করার কাজেই জড়িত রয়েছে।   

ইরানের বিরুদ্ধে আরব ঐক্যের ধূয়া তোলা হচ্ছে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে। অথচ রাজা-বাদশাহ শাসিত উপসাগরীয় দেশগুলো অনারব মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারকে এ অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি করার সুযোগ দিয়েছে এবং এসব ঘাঁটি সংস্কার ও সম্প্রসারণের জন্য  নতুন মোড়কে পুরনো নানা অজুহাত ও সাফাই দেয়া হচ্ছে। 

দুই-মেরু-কেন্দ্রিক বিশ্ব-ব্যবস্থার যুগে নিক্সনের ‘দুই-স্তম্ভ’ নীতির আলোকে এক সময় ইরান ও সৌদি সরকার ছিল এ অঞ্চলে পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে মার্কিন সরকারের দুই প্রধান মিত্র তথা মার্কিন স্বার্থ রক্ষার আঞ্চলিক মোড়ল। কিন্তু ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর এ অঞ্চলসহ বিশ্বের বহু সমীকরণ বদলে যায়। 

বর্তমানে সৌদি সরকারের নানা তৎপরতার একমাত্র উদ্দেশ্য হল এ অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্যকে ইরানের দিকে ঝুঁকে পড়তে না দেয়া। সৌদি সরকার এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়ানোর জন্য ব্রিটেনের উপস্থিতিকে ব্যবহার করতে চাইছে। এ অঞ্চলে ব্রিটেনকে আবারও বড় মোড়লের আসন দিতে চায় রিয়াদ যাতে লন্ডন এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি নানা ষড়যন্ত্র পাকানোর সুযোগ পায়। রিয়াদ এখন আর মার্কিন সরকারের ওপর আস্থা রাখে না। সৌদি সরকার ওয়াশিংটন আর লন্ডনের প্রতিপত্তি বাড়ানোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেও ব্যবহার করতে চায়।

কিন্তু আমেরিকার নতুন সরকার তথা ট্রাম্পের নতুন নীতি রিয়াদের অচল-হয়ে পড়া নীতিকে পুরোপুরি অচল করে দিতে পারে। অবশ্য অস্ত্র ব্যবসার প্রলোভন ট্রাম্পও হয়তো এড়াতে পারবেন না। কারণ, বর্তমানে বিশ্ব-বাণিজ্যের প্রায় ১৬ শতাংশই হল অস্ত্র-বাণিজ্য। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের ভারসাম্যকারী শক্তিকেও ব্যবহার করতে পারেন।  

সৌদি সরকার বর্তমানে অস্ত্র কেনার দিক থেকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ক্রেতা। রিয়াদ কেবল গত বছরই ৮ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি অস্ত্র কিনেছে। এতোসব অস্ত্র কিনেও রিয়াদ প্রায় দুই বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েও ইয়েমেনের হুথিদের প্রতিরোধকে রুখতে পারেনি এবং পারেনি ইয়েমেনের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক জোট গড়ে তুলতে। রিয়াদ ইয়েমেন-বিরোধী তার কথিত জোটে এখনও ওমানকে ভেড়াতে পারেনি।  এ অঞ্চলে সৌদি আধিপত্যবাদের মূল শক্তি হল বিজাতীয় পাশ্চাত্যের সঙ্গে তার অশুভ আঁতাত। মূলত এইসব পরিস্থিতির আলোকেই এটা বিচার করতে হবে যে কেনো অর্থনৈতিক সংকটের শিকার বুড়ো উপনিবেশবাদী ব্রিটেন আবারও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ফিরে আসতে চায়।

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন