হজরত মুসলিম ইবনে আকিলের শাহাদত

৬০ হিজরীর নয়ই জিলহজ্ব আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র ভাতিজা ও ইমাম হোসাইন (আ.)’র চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম ইবনে আকিল (রা.) কুফায় শাহাদত বরণ করেন। তার লোম হর্ষক বেদনা বিধুর শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আপনাদের প্রতি রইলো আন্তরিক শোক ও সমবেদনা

হজরত মুসলিম ইবনে আকিলের শাহাদত

 ৬০ হিজরীর নয়ই জিলহজ্ব আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র ভাতিজা ও ইমাম হোসাইন (আ.)’র চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম ইবনে আকিল (রা.) কুফায় শাহাদত বরণ করেন। তার লোম হর্ষক বেদনা বিধুর শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আপনাদের প্রতি রইলো আন্তরিক শোক ও সমবেদনা

মুআবিয়া হিজরী ৬০ সালের রজব মাসে মারা যায় মৃত্যুকালে সে ইমাম হোসেন (আ.)এর সাথে কৃত সন্ধি ভঙ্গ করে স্বীয়পুত্র নরাধম ইয়াজিদকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা নিযুক্ত করে। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি জানায়।

কুফাবাসীরা হযরত হোসাইন (আ.) এর মক্কা আগমন এবং ইয়াজিদের হাতে বাইআত গ্রহণে তার অস্বীকৃতির খবর জানত। এ খবর পেয়েই তারা সুলাইমান ইবনে সা’দ খাজায়ীর ঘরে সমবেত হয় । সমাবেশে সুলাইমান ইবনে সা’দ দাড়িয়ে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন । বক্তব্য শেষে তিনি বলেন ওহে আলীর অনুসারীরা! তোমরা সবাই শুনেছ যে,মুআবিয়া মরে গেছে এবং নিজের হিসাব কিতাবের জন্য আল্লাহর দরবারে পৌছে গেছে । তার কৃতকর্মের ফল সে পাবে । তার ছেলে ইয়াজিদ ক্ষমতায় বসেছে । আপনারা আরো জানেন যে,হোসাইন ইবনে আলী (আ.) তার সাথে বিরোধিতা করেছেন এবং তিনি উমাইয়ার জালিম ও খোদাদ্রোহীদের দূরাচার থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন । তোমরা তার পিতার অনুসারী । হোসাইন (আ.) আজ তোমাদের সমর্থন ও সহযোগিতার মুখাপেক্ষী । যদি এ ব্যপারে নিশ্চিত হও যে,তাকে সাহায্য করবে এবং তার দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে,তাহলে লিখিত আকারে নিজের প্রস্তুতির কথা তাকে জানিয়ে দাও । যদি ভয় পাও এবং আশংকা কর যে,তোমাদের মধ্যে গাফলতি ও দুর্বলতা প্রকাশ পাবে,তাহলেও তাকে জানিয়ে দাও,তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও । তাকে ধোকা দিও না ।

এরপর সে একটি পত্র লিখে পাঠিয়ে দিল। দুইদিন অপেক্ষার পর আর একদল লোককে প্রায় ১৫টি চিঠি নিয়ে হযরত  ইমাম হোসাইন (আ.) এর কাছে পাঠিয়ে দিল । ঐ সব চিঠির প্রত্যেকটিতে দুই কি তিন বা চার জনের স্বাক্ষর ছিল । কিন্তু হোসাইন (আ.) এত সব চিঠিপত্র পাওয়ার পরও নীরব রইলেন তাদের কোন পত্রের উত্তর দিলেন না । এমন কি মাত্র এক দিনেই ৩০০ টি চিঠি এসে তার হাতে পৌছে । এরপরও পর্যায়ক্রমে একের পর এক চিঠি আসছিল । তার চিঠি ১২হাজার ছাড়িয়ে যায় । সর্বশেষ যে চিঠিখানা তার হাতে এসে পৌছে তা ছিল হানি ইবনে হানি ছবিয়ী এবং সায়ীদ ইবনে আব্দুল্লাহ হানাফীর । তারা উভয়ে ছিল কুফার অধিবাসী। চিঠি পাওয়ার পর পত্র বাহক দু’জনের কাছে হোসাইন ইবনে আলী (আ.) জিজ্ঞেস করেন –এ চিঠিগুলো কে কে লিখেছে । তারা বলল,হে আল্লাহর রাসুলের সন্তান! পত্রের লেখকরা হলেন-শাব্স ইবনে রাবায়ী,হাজার ইবনে আবজার,ইয়াজিদ ইবনে হারেছ,ইয়াজিদ ইবনে রোয়াম,উরওয়া ইবনে কাইছ,আমর ইবনে হাজ্জাজ এবং মুহাম্মদ ইবনে ওমর ইবনে আতারেদ ।

এরুপ পরিস্থিতিতে হোসাইন ইবনে আলী (আ.)একদিন কাবাঘরের পাশে গিয়ে রুকন ও মাকামে ইব্রাহীমের মাঝখানে দাড়িয়ে দু’রাকত নামায আদায় এবং মহান আল্লাহর দরবারে পরিস্থিতির কল্যাণকর পরিণতির জন্য দোয়া করেন । অতপর মুসলিম ইবনে আকিলকে ডেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন ।

এরপর ইমাম হোসাইন (আ.) কুফাবাসীর চিঠির জবাব লিখে মুসলিম ইবনে আকিলের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। জবাবী পত্রে তাদের আমন্ত্রণ কবুলের ওয়াদা দিয়ে লেখা ছিল- আমি আমার চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিলকে তোমাদের কাছে পাঠালাম যাতে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করে ।

মুসলিম ইমামের পত্র নিয়ে কুফায় আসেন । কুফাবাসী হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ও মুসলিম ইবনে আকিলকে পেয়ে আনন্দিত হল ।তাকে মুখতার ইবনে আবী ওবায়দা সাকাফীর বাড়িতে থাকতে দিলেন । অনুসারীরা দলে দলে মুসলিম ইবনে আকিলের সাথে সাক্ষাত করতে আসতে লাগল। প্রত্যেক দল আসার সাথে সাথে মুসলিম ইমামের পত্র পড়ে শুনাতে থাকেন । আনন্দে দর্শনার্থীদের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল এবং তার হাতে বাইআত গ্রহণ করছিল । দেখতে দেখতে আঠারশো লোক তার হাতে বাইআত গ্রহণ করে ।

আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিম বাহেলী,এমারা ইবনে ওয়ালীদ এবং ওমর ইবনে সাআদ ইয়াজিদের কাছে এক পত্র পাঠিয়ে মুসলিম ইবনে আকিলের আগমন সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন । ঐ পত্রে নোমান ইবনে বশীরকে কুফার গভর্ণরের পদ থেকে সরিয়ে ইবনে যিয়াদকে নিয়োগ দানের করে । ঐ পত্রে মুসলিম ও হোসাইনের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিবরণ দেয় । পত্রে কড়া নির্দেশ প্রদান করে যে,মুসলিমকে গ্রেফতার ও হত্যা কর। ইবনে যিয়াদ চিঠি পাওয়ার পর কুফা গমনের উদ্দেশ্যে তৈরী হয়ে যায় ।

মুসলিম ইবনে আকিল এ সংবাদ শুনে ভয় পেলেন । হয়তো ইবনে যিয়াদ তার কুফা অবস্থানের সংবাদ জেনে ফেলতে পারে । এমনকি তার অনিষ্ট সাধন করতে পারে এজন্যে তিনি মুখতারের ঘর থেকে এসে হানি ইবনে উরওয়ার ঘরে আশ্রয় নেন । হানি ইবনে উরওয়া তাকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিলেন । মুসলিম ইবনে আকিলকে আশ্রয়দেয়ার অপরাধে ইবনে যিয়াদ হানি ইবনে উরওয়কে নির্মমভাবে হত্যা করে।

হানির নিহত হওয়ার সংবাদ মুসলিম ইবনে আকিলের কাছে পৌছালে যত লোক তার হাতে বাইআত করেছিল,তাদের সহ তিনি ইবনে যিয়াদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য বের হন । ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ এ সময় দারুল ইমারায় আশ্রয় নেয় এবং প্রাসাদের ভীতরে ঢোকার সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেয় । তার দলীয় লোকেরা মুসলিমের সঙ্গী সাথীদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় । আর যারা যিয়াদের সাথে দারুল ইমারার (প্রাসাদ) ভেতরে ছিল তারা মুসলিমের বাহিনীকে সিরিয়া থেকে সৈন্য বাহিনী আসার হুমকি দিচ্ছিল । ঐ দিন এভাবেই কেটে গেল এবং রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এল । কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের মিথ্যা প্রলোভনে প্রতারিত হয়ে  বেশির ভাগ মানুষই ইমামের প্রতিনিধিকে (মুসলিমকে) ত্যাগ করেন। মুসলিমের সঙ্গী সাথীরা ধীরে ধীরে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল । পরস্পর বলাবলি করতে লাগল আমরা কেন গোলযোগ আর বিশৃংখলার আগুন জ্বালাচ্ছি । আমাদের তো উচিৎ ঘরে বসে থাকা আর মুসলিম ও ইবনে যিয়াদের ব্যাপারে নিজেকে না জড়ানো । আল্লাহই তাদের মধ্যে সমাধান করে দিবেন । এভাবে সবাই চলে গেল শেষ পর্যন্ত ১০ জন লোক ছাড়া আর কেউই মুসলিমের সাথে রইল না । এবার তিনি মসজিদে এসে মাগরিবের নামাজ পড়লেন,নামাজের পর দেখলেন ঐ দশ জনও সেখানে নেই । তিনি অত্যন্ত অসহায়ভাবে মসজিদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন । অলিগলির পথ চলতে চলতে তিনি ‘তাওয়া’ নাম্নী এক মহিলার ঘরে এসে পানি চাইলেন । মহিলা পানি দিলে তা তিনি পান করলেন এবং মুসলিমকে আশ্রয় দিলেন । কিন্তু তার ছেলে গিয়ে ইবনে যিয়াদকে ব্যপারটা জানিয়ে দিল । ইবনে যিয়াদ মুহাম্মদ ইবনে আশআসকে একদল লোক সহ মুসলিমকে গ্রেফতারের জন্য পাঠাল । মুসলিম তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলেন এবং তাদের সাথে একাই যুদ্ধে লিপ্ত হলেন ও তাদের বেশ কিছু লোককে হত্যা করলেন । আশআস চিৎকার দিয়ে বলল – হে মুসলিম আমরা তোমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছি । মুসলিম বললেন- ধোকাবাজ,ফাসেক লোকদের নিরাপত্তা দেয়ার কোন দাম নেই । যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে মুসলিমের ঢাল ও তরবারী ভেঙ্গে যাওয়ায় তার মনোবল কিছুটা দূর্বল হয়ে যায় (এত গুলো মানুষের সাথে একাই তাও আবার ভাঙ্গা ঢাল ও তরবারী নিয়ে ) ইতি মধ্যে এক ব্যক্তি পিছন থেকে তীরের সাহায্যে আঘাত করলে তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে যান । তখন তাকে বন্দী করে ইবনে যিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় ।

ইবনে যিয়াদ বকর ইবনে হামারানকে দারুল ইমারার ছাদের উপর মুসলিমকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার নির্দেশ দিল । মুসলিম যাওয়ার সময় তাছবীহ পাঠ করছিলেন এবং আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্র্রার্থনা করছিলেন । ছাদের উপর পৌছা পর্যন্ত তিনি রাসূল (সা.) এর উপর দরুদ পাঠ করতে থাকলেন ।

তার মাথা দেহ থেকে আলাদ হয়ে গেল । তার হত্যাকারী অত্যন্ত ভীত বিহ্বলভাবে ছাদ থেকে নেমে আসল । ইবনে যিয়াদ জিজ্ঞেস করল তোমার কি হল । বলল হে আমীর যখন তাকে হত্যা করছিলাম তখন কুৎসিত কাল চেহারা এক লোক দেখলাম যে আমার মুখোমুখি দাড়িয়ে দাতে নিজের আঙ্গুল কামড়াচ্ছে । তাকে দেখে এত ভয় পেয়েছি যে জীবনে কোন কিছুতেই এত ভয় পাইনি । যিয়াদ বলল মণে হয় মুসলিমকে হত্যা করাতে তোমার মণে ভয় ধরে গেছে ।

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন