কুদস দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে

বিগত ৩৫ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী কুদস দিবস পালিত হয়ে আসছে৷ ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (রহ.) এ দিবস পালনের আহবান জানিয়েছিলেন৷ ফিলিস্তিন ও পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদার ইহুদিবাদীদের হাত থেকে মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল আকসা মসজিদকে মূক্ত করার

কুদস দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে

বিগত ৩৫ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী কুদস দিবস পালিত হয়ে আসছে৷ ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (রহ.) এ দিবস পালনের আহবান জানিয়েছিলেন৷ ফিলিস্তিন ও পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদার ইহুদিবাদীদের হাত থেকে মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল আকসা মসজিদকে মূক্ত করার জন্যে মুসলমানদের জাগিয়ে তোলাই এ দিবসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য৷ এ ছাড়াও মজলুম ফিলিস্তিনী জাতির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ইহুদিবাদী শাসন, শোষণ, নিপীড়ন ও তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটানো এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনী জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও এ দিবসের আরেকটি বড় লক্ষ্য৷ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদি ও খৃষ্টান ধর্মের পোশাকধারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নব্য ক্রুসেড মোকাবেলার জন্যে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম বা প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যেও এ দিবস কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে৷

কেননা বিশ্বব্যাপী সত্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যেও কুদস দিবস পালন করা জরুরী৷ কারণ,বায়তুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন হচেছ রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা- এই গুরুত্বপূর্ণ তিন মহাদেশের প্রবেশ দ্বার৷ তাই এ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি যদি সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রধান তিন মহাদেশের ওপর কর্তৃত্ব করা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্যে সহজ হবে৷

বায়তুল মোকাদ্দস শহর নির্মিত হয়েছিল হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র মাধ্যমে কাবা শরীফ নির্মাণের ১১০০ বছর পর তথা হযরত ঈসা (আ.)’র জন্মের ৯৭০ বছর আগে৷ তাই ইব্রাহীম (আ,)’র বংশধর হযরত দাউদ (আ.)’র মাধ্যমে নির্মিত আল আকসা মসজিদ তৌহিদপন্থীদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়৷ হযরত মূসা (আ.)’র জীবদ্দশাতেই ইহুদিরা তৌহিদবাদ বা আল্লাহর একত্বের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে মূর্তিপূজা শুরু করেছিল এবং আল্লাহর শাস্তি হিসেবে তারা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল৷ এরপর ইহুদিরা অনেক নবীকে হত্যা করেছিল৷ ইহুদিবাদীরা দাবী করে যে বায়তুল মোকাদ্দসে হযরত সোলায়মান (আ.)’র তৈরি ইবাদত ঘরটি রয়েছে ৷ অথচ খৃষ্টপূর্ব ৭০ সালেই রোমান সেনারা সেটি ধবংস করে দিয়েছিল এবং বর্তমান আল আকসা মসজিদ থেকে তার অবস্থান ছিল অনেক দূরে৷ ফিলিস্তিন রোমানদের কর্তৃত্ব থাকার সময়ে সে অঞ্চলের জনগণের মুক্তিদাতা হিসেবে হযরত ঈসা (আ.)’র জন্ম হয়৷ কিন্তু তৎকালীন ইহুদি পুরোহিতরা বায়তুল মোকাদ্দাসের ইবাদত ঘরে হযরত ঈসার যাতায়াতে ক্ষুব্ধ হয়েছিল৷ কারণ, তিনি জনগণের কাছে একত্ববাদী শিক্ষা প্রচার করতেন৷ ক্রুদ্ধ ও পথভ্রষ্ট ইহুদি পুরোহিতরা রোমান শাসককে হযরত ঈসার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে এবং তাঁকে ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করে৷ মহান আল্লাহ হযরত ঈসা (আ.)-কে রক্ষা করেন এবং তাঁকে এখন পর্যন্ত গায়েবী বা অদৃশ্য অবস্থায় জীবীত রেখেছেন৷ কিন্তু খৃষ্টানরা মনে করে হযরত ঈসা ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে মারা যান৷ আর এ জন্যে তারা ইহুদিদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়৷

হযরত ঈসা (আ.) অদৃশ্য হবার পর খৃষ্টীয় ৭০ সনে রোমানদের হামলায় বিপর্যস্ত ইহুদিরা আশ্রয়হীন ও শরণার্থীতে পরিণত হয়৷ খৃষ্টীয় তৃতীয় শতকে রোম সম্রাট কনষ্টানটিন নিজে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং এ সময় তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী বেথেল হামে ঈসার মাজার থাকায়, এবং এ শহরটি তাঁর জন্ম
স্থান হওয়ায় বায়তুল মোকাদ্দস খৃষ্টানদের কেন্দ্রীয় শহর হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে৷

খৃষ্টীয় ১৩৫সন থেকে ৫০০ সন পর্যন্ত বায়তুল মোকাদ্দসে হাতে গোনা অল্প ক’জন ইহুদি বসবাস করতো৷ এরপর মসজিদুল আকসা ছিল বিশ্বনবী (সা.)’র নবুওতের প্রথম চৌদ্দ বছর পর্যন্ত মুসলমানদের প্রথম কেবলা৷ ইহুদিদের কেবলার দিকে মুখ করে মুসলমানরা নামাজ আদায় করতো বলে ইহুদিরা মুসলমানদের উপহাস করতো৷ শেষ নবী (সা.) কেন ইহুদি বংশে জন্ম নিলেন না এটাই ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে ইহুদিদের ক্ষোভের একটা বড় কারণ! এ অবস্থায় হিজরতের দ্বিতীয় বছরে আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানরা পবিত্র কাবাকে নামাজের কেবলায় পরিণত করে৷ ১৫ হিজরীতে বায়তুল মোকাদ্দস মুসলমানদের হস্তগত হয়৷ পরবর্তিতে এ শহরের বেশীর ভাগ বাসিন্দাই ছিলেন আরব মুসলমান৷ আর তাঁদেরই বংশধর হলেন আজকের ফিলিস্তিনী মুসলমান৷

এরপর খৃষ্টীয় ১০৯৫ সালে ইউরোপীয়রা বায়তুল মোকাদ্দস দখলের জন্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করে৷ প্রায় দু’শ বছর পর্যন্ত ইউরোপীয় খৃষ্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাত আটটি ক্রুসেড যুদ্ধ পরিচালনা করে৷ সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর হাতে ক্রুসেডাররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল৷ আইয়ুবী বংশের পর মামলুক এবং এরপর উসমানী খেলাফতের আয়ত্বে ছিল বায়তুল মোকাদ্দস৷ ওসমানী শাসনাধীন তুরস্ক প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজিত হলে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ফিলিস্তিন বৃটেনের দখলে চলে আসে৷ এ সময় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র পঞ্চাশ হাজার৷ এ সংখ্যা ছিল ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার মাত্র সাত শতাংশ৷ এরপর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহিরাগত ইহুদিদেরকে কিভাবে ছলে বলে কৌশলে ফিলিস্তিনে জড়ো করে এবং ফিলিস্তিনীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও গণহত্যা চালিয়ে সেখানে জোর করে ইসরাইল নামের একটি অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা সবারই জানা৷ ইতিহাসের পরিহাস হলো যে খৃষ্টানরা দাবী করে থাকে তাদের ধর্মের প্রবর্তক হযরত ঈসা (আ.)-‘কে কুচক্রি ইহুদি পুরোহিতরাই হত্যা করেছিল বা হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল, পরবর্তীকালে তাদেরই উত্তরসূরি ইহুদিবাদীদেরকে খৃষ্টান নামধারী সাম্রাজ্যবাদীরাই ফিলিস্তিনে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিল ৷ এ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে আমরা বলতে পারি যে, প্রকৃত ইহুদি ও প্রকৃত খৃষ্টানরা বায়তুল মোকাদ্দস শহরকে তাদের জন্যে পবিত্র শহর বলে দাবী করতে পারে, কিন্তু তারা এটা বলতে পারে না যে এ শহর বা গোটা ফিলিস্তিন একমাত্র তাদেরই অধিকারে থাকবে৷ বিশেষ করে, ইহুদিরা সব সময় ফিলিস্তিনে সংখ্যালঘু ছিল এবং ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তথা খৃষ্টানদের চেয়েও তাদের সংখ্যা কম হওয়ায় তারা এ শহর বা অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্বের দাবী করার কোনো অধিকারই রাখে না৷ অন্যদিকে, কয়েক হাজার বছর ধরে ফিলিস্তিনে বসবাসরত সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি হিসেবে ফিলিস্তিনীরাই এ অঞ্চলের প্রকৃত আদিবাসী হিসেবে পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাসহ গোটা ফিলিস্তিনের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠার অধিকার রাখেন৷ এ ছাড়াও মুসলমানদের জন্যে কাবা ঘর ও মহানবীর রওজা মোবারকের পর আল আকসা মসজিদ সবচেয়ে পবিত্রতম ধর্মীয় স্থান৷ পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে , পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর দাসকে তাঁর নিদর্শন দেখাবার জন্য রাতে সফর করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম বা কাবাঘর থেকে মসজিদুল আকসায়, যার সীমাকে আমি সৌভাগ্যযুক্ত করেছি, যেন আমি তাকে কতিপয় নিদর্শন প্রদর্শন করি৷ তিনি তো সব শোনেন, সব দেখেন৷ পবিত্র কোরানের এ আয়াত অনুযায়ী বায়তুল মোকাদ্দাস শহরে অবস্থিত আল কুদস বা আল আকসা মসজিদ ছিল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র মেরাজ গমন বা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ ও উধর্বলোক ভ্রমণের দ্বিতীয় স্থান৷
তাই বায়তুল মোকাদ্দসকে সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হওয়া ধর্মীয় দিক থেকেও প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য৷
ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ইমাম খোমেনী (রহ.)’র বিপ্লবী আহবান ফিলিস্তিনীদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে৷ ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনীরা খালি হাতে শুধু পাথর নিয়ে পরমাণূ শক্তিধর ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু করে৷ দখলদার ইসরাইল গাজ্বা ও পশ্চিম তীরের সীমীত এলাকায় ফিলিস্তিনীদের স্বায়ত্তশাসন দিয়ে এ বিক্ষোভের আগুন নেভানোর চেষ্টা করে৷ কিন্তু নামমাত্র স্বায়ত্ত্বশাসনে ফিলিস্তিনের জনগণ সন্তুষ্ট হয়নি, তাঁরা এখনও প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার জন্যে গণ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে৷ এ অবস্থায় ইসরাইল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে
বাধ্য হয়েছে৷ এর আগে ইরানের মুসলিম জাতির মতো একই ধরনের ঈমানী শক্তির বলে বলিয়ান লেবাননের মুসলিম যোদ্ধারা সাম্রাজ্যবাদীদের সর্বাত্মক সমর্থনপুষ্ট ইহুদিবাদী ইসরাইলকে লেবানন থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়৷ মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হলেই যে মধ্যপ্রাচ্যের বিষাক্ত ক্যান্সার ইসরাইলকে পরাজিত করা সম্ভব তা মরহুম ইমাম খোমেনী তাঁর বিভিন্ন ভাষণে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন৷ তিনি বলেছিলেন, আরব দেশগুলোর জনগণ যদি এক বালতি করেও পানি ঢালতো, তাহলে ইসরাইল ভেসে যেতো৷ তিনি তাঁর এক ভাষণে কুদস দিবসের করণীয় কাজ সম্পর্কে
বলেছেন, বিশ্ব কুদস দিবসে জাতিসমূহের কর্তব্য হচেছ বিক্ষোভ মিছিল ও সভা-সমাবেশের আয়োজন করে নিজ নিজ সরকারগুলোর কাছে শক্তভাবে এ দাবী জানানো যাতে তারা অস্ত্র শক্তি ও তেল অস্ত্র নিয়ে আমেরিকা এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে৷ যদি তা না করে তবে চাপ প্রয়োগ, ধর্মঘট পালন ও হুমকি প্রদর্শন করে তাদেরকে সে কাজে বাধ্য করতে হবে৷ কারণ, ইহুদিবাদী ইসরাইল সমগ্র আরব বিশ্ব, এমনকি মক্কা ও মদীনা শরীফকেও দখলের হুমকি দিচেছ৷ আজ বিশ্বের মানুষের কাছে এটা স্পষ্ট সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, ইসরাইল ও তাদের ইউরোপীয় এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী সহযোগীরাই বিশ্বে যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও অশান্তি সৃষ্টির প্রধান হোতা হিসেবে সক্রিয়৷ এটা স্পষ্ট যে ইহুদিবাদী দখলদারদের নাগপাশ থেকে ফিলিস্তিন ও আল আকসাকে মুক্ত না করা পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়৷ তাই আমাদের উচিত কুদস মুক্তির জন্যে সংগ্রামরত ফিলিস্তিনী ভাইবোনদেরকে এবং অন্যান্য সংগ্রামীদেরকে নৈতিক সমর্থনসহ সব ধরনের সাহায্য করা ও সমর্থন দেয়া৷

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন