সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ২২-২৪

সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ২২-২৪

সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ২২-২৪

সূরা বনী ইসরাইলের ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
لَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آَخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُومًا مَخْذُولًا (22)
“আল্লাহর সাথে দ্বিতীয় কাউকে মাবুদে পরিণত কর না৷ অন্যথায় নিন্দিত ও অসহায়-বান্ধব-হারা হয়ে পড়বে৷” (১৭:২২)

ছোট্ট এই আয়াতটিতে পার্থিব এ জীবনের শেরেকির মতো কাজকর্মের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ কাজকের্মে কিংবা আকিদা -বিশ্বাসে যে-কোনো রকমের শেরেকি মানুষের জন্যে লজ্জা এবং বিচিত্র দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা আল্লাহ তায়ালা মুশরিক শ্রেণীর লোকদেরকে তাঁর অনুগ্রহ, রহমত ও দয়াপ্রাপ্তির তালিকা থেকে দূরে রাখেন। এ ধরনের লোকেরা নিশ্চয়ই বিচিত্র সমস্যার মুখে পড়ে যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি হলো হতাশা এবং পেরেশানি। অপরদিকে যেহেতু আল্লাহর সাথে শেরেকি করার কোনো বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ কিংবা যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই সেহেতু তা হয়ে পড়ে তার জন্যে লজ্জাজনক, আর কোনো বিচক্ষণ মানুষই তা গ্রহণ করে না।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. মানুষের সম্মান এবং মর্যাদার বিষয়টি তৌহিদের ছায়াতলে নিহিত। চিন্তায় কিংবা কাজেকর্মে কোনোরকম শেরেকি মানুষের মর্যাদাহানী ও অসম্মানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দুই. ধর্মহীন শিক্ষা বা চিন্তাদর্শের অনুসরণ মানুষকে অচলাবস্থার দিকে ঠিলে দেয়।

সূরা বনী ইসরাইলের ২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا (23)
“তোমার রব ফায়সালা করে দিয়েছেনঃ তোমরা তাঁর ইবাদাত ছাড়া অন্য কারোর ইবাদাত কর না, পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার কর৷ যদি তোমাদের কাছে তাদের কোনো একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে “উহ্‌” পর্যন্তও বল না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিও না বরং তাদের সাথে সম্মান ও মর্যাদার সাথে কথা বল।” (১৭:২৩)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় আল্লাহর সাথে শেরেকি না করার ঘোষণা দেওয়ার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছেঃ স্থান কিংবা কালের সীমা না টেনে সকল কালের জন্যে সকল স্থানের জন্যেই আল্লাহর সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট আদেশ হলো আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পূজা অর্জনা করা যাবে না। এই আদেশের উদ্দেশ্য হলো তৌহিদ যেন জীবনের সকল ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিকভাবে বিরাজ করে। তবে তৌহিদের পর পিতা-মাতার প্রতি সদয় দায়িত্ববান হবার বিষয়টিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। মা-বাবার প্রতি সম্মানজনক আচরণ করাকে তৌহিদে বিশ্বাসের পাশাপাশি এনে এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অবশ্য মা-বাবার প্রতি সদয় আচরণের মানে কিন্তু তাদেরকে দান বা সাহায্য সহযোগিতা করার চেয়েও অনেক বেশি। অনেক বাবা-মায়ের টাকা-পয়সার প্রয়োজন নাও থাকতে পারে কিন্তু তাঁদের যত্ন-আত্তি করা, খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্যে আয়াতের ধারাবাহিকতায় বলা হয়েছেঃ বৃদ্ধ বয়সে সতর্ক থেকো যাতে তাদের সাথে রূঢ় আচরণ না করে বসো, তাঁরা যদি এমন কোনো কিছু চেয়ে বসেন যা পূরণ করা তোমার জন্যে কষ্টকর, তাহলেও বিরক্ত হয়ো না! বরং তাঁদের সাথে কথায় বার্তায়, আচরণে শালীনতা, ভদ্রতা ও সম্মান বজায় রেখ।

যেসব ছেলেমেয়ে মা-বাবার প্রত্যাশা বা চাহিদা পূরণের ব্যাপারে অভিযোগ করত পয়গাম্বর (সা.) তাদরকে বলতেনঃ তুমি এবং তোমার ধন-সম্পদ সবই তোমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছো। সুতরাং তাঁদের প্রত্যাশা পূরণে কোনোরকম কার্পণ্য কর না।

এ আয়াত থেকে আমরা শিখব :
এক. বাবা-মায়ের খেদমত করা বা তাঁদের প্রতি দয়াশীল হওয়া তৌহিদে বিশ্বাসী প্রতিটি মুমিনের প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
দুই. বাবা-মায়ের খেদমতের ব্যাপারে উদার হওয়ার কথাটা তৌহিদ এবং আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশের পাশাপাশি এসেছে। এর রহস্যটা হলো বাবা-মায়ের খেদমত করাকে যেন কেবল একটি মানবিক দায়িত্ব বলেই মনে করা না হয় বরং এটাও ভাবে যে এটা একটা ঐশী দায়িত্ব।

সূরা বনী ইসরাইলের ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا (24)
“আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাক এবং দোয়া করতে থাকো এই বলেঃ হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন৷”(১৭:২৪)

আগের আয়াতে মা-বাবার খেদমত করার ব্যাপারে সামগ্রিক নির্দেশ দেওয়ার পর এবং বৃদ্ধবয়সে তাঁদের খোঁজ-খবর ও যত্ন-আত্তির আদেশ দেওয়ার পর এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ বাবা-মায়ের সাথে ব্যবহার করতে হবে অত্যন্ত ভদ্রতা, নম্রতা এবং বিনয়াবনত শ্রদ্ধার সাথে। সর্বক্ষেত্রে এবং সর্বাবস্থায় তাঁদের কাছে ছোট্ট বা শিশুটির মতো থাকতে হবে। কক্ষনো তাঁদের সাথে আলাপ আলোচনা বা কথাবার্তার সময় আগ বাড়িয়ে কিংবা তাঁদের চেয়ে বেশি বোঝো, বেশি জানো-এ রকম ভাব দেখাবে না। তোমার শৈশবে তাঁরা যেমন তোমাকে আদর যত্ন করে স্নেহ ও দয়ার সাথে বড় করে তুলেছে, তুমিও তাঁদের সাথে বৃদ্ধ বয়সে সেরকম আচরণ কর। সবসময় তাঁদের জন্যে দোয়া কর এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর যেন তাঁদেরকে তাঁর রহমত ও দয়ার অংশীদার হবার সৌভাগ্য দেন। তাঁরা মারা গেলেও একইভাবে দোয়া করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে তাঁদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।

একটি কথা মনে রাখতে হবে, এ আয়াতটি যদিও মা-বাবার ব্যাপারে সরাসরি বলা হয়েছে, তবে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে সমাজের মুরব্বিশ্রেণী, শিক্ষকগণও পিতামাতার অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ তাঁদের ব্যাপারেও পিতামাতার মতোই আচরণ করতে হবে। পবিত্র কুরআনে হযরত ইব্রাহীম (আ.) সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “তোমাদের পিতা ইব্রাহীম”...। এ আয়াতে ইব্রাহীম (আ.) কে তৌহিদে বিশ্বাসী মুসলমানদের পিতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে বিখ্যাত একটি বর্ণনায় এসেছে, নবী কারিম (সা.) বলেছেনঃ “আমি এবং আলী এই উম্মাতের পিতা।”

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলোঃ
এক. সন্তানেরা ধন-সম্পদ কিংবা মর্যাদায় সমাজের যতো উঁচুস্তরেই অধিষ্ঠিত হোক না কেন, মা-বাবার প্রতি বিনয়ী হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই বিনয় হতে হবে সত্যিকারের, বাহ্যিক কিংবা লোকদেখানো নয়।
দুই. সন্তানদের একটি দায়িত্ব হলো মা-বাবার জন্যে দোয়া করা, চাই তাঁরা জীবিত থাকুন অথবা মৃত।
তিন. মানুষের উচিত তাঁদের মুরব্বিদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং তাঁদের সাথে ভালোবাসা ও সদয় আচরণ করা।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন