সূরা কাহাফ; আয়াত ১০২-১০৬

সূরা কাহাফ; আয়াত ১০২-১০৬

সূরা কাহাফ; আয়াত ১০২-১০৬

সূরা কাহাফের ১০২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
أَفَحَسِبَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنْ يَتَّخِذُوا عِبَادِي مِنْ دُونِي أَوْلِيَاءَ إِنَّا أَعْتَدْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَافِرِينَ نُزُلًا (102)
“যারা অবিশ্বাস করেছে তারা কি মনে করে যে, তারা আমাকে ছেড়ে আমার বান্দাদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে? নিশ্চয় আমরা অবিশ্বাসীদের আতিথেয়তার জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছি।” (১৮:১০২)

কাফের ও দোযখীদের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতে তারই ধারাবাহিকতায় বলা হচ্ছে, যারা সত্যকে গোপন রাখে এবং সত্যকে দেখতে ও শুনতে প্রস্তুত নয়, তারা আল্লাহর পরিবর্তে আল্লাহর দাসদের কাছে আশ্রয় নিয়ে কি সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবে, কিংবা সমস্যাগুলো থেকে মুক্ত হতে পারবে? যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তারা কোন্ যুক্তিতে আল্লাহর সৃষ্টিকে উপাস্য বানিয়েছে এবং তাদের কাছে প্রার্থনা করছে? তারা সেদিন কতই না অনুশোচনা করবে যেদিন দেখবে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো নির্ভরযোগ্য আশ্রয়-স্থল নেই।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. কাফেরদের কাছে আল্লাহ ও কিয়ামতকে অস্বীকার করার জন্য কোনো যুক্তি বা সঠিক দলিল-প্রমাণ নেই। তারা কেবল কল্পনা ও অনুমানের ভিত্তিতেই এ পথ বেছে নিয়েছে।
২. কেবল আল্লাহকে অস্বীকার করার অর্থই কুফরি নয়, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কর্তৃত্ব মেনে নেয়াটাও এক ধরনের কুফরি। কারণ, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই তাঁর সমকক্ষ বা সমতুল্য নয়।

সূরা কাহাফের ১০৩ ও ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا (103) الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا (104)
“তুমি বল, আমি কি তোমাদের এ খবর দেব যে কারা কাজে-কর্মে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত?” (১৮:১০৩)
“তারা ঐ সব লোক যাদের পার্থিব জীবনের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, অথচ তারা এ (ভুল) ধারণা করে যে, নিশ্চয়ই তারা উত্তম কাজ করছে।” (১৮:১০৪)

এ আয়াতে সেইসব মানুষের দিকে ইশারা করা হয়েছে যারা কল্পনা ও অনুমানের ভিত্তিতে ভাবে যে দুনিয়ার জীবনে তারা যে কাজগুলো করছে সেগুলো ছিল পছন্দনীয় ও ভাল কাজ। এই শ্রেণীর মানুষ ইহুদি-খ্রিস্টানদের মত আহলে কিতাবও হতে পারে, কিংবা মুসলমানও হতে পারে। এরা এমন শ্রেণীর মানুষ যারা কুসংস্কার ও কুপ্রথার অনুসারী এবং আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কারো কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে।

বিভ্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের কাজকে ভাল কাজ মনে করা ও সেগুলোকে মুক্তি আর সৌভাগ্যের পাথেয় বলে মনে করা খুবই বিপজ্জনক বিষয়। কিন্তু যখন অলীক কল্পনার ধোঁয়াশা কেটে গিয়ে তাদের কাছে সত্য স্পষ্ট হবে তখন তারা বুঝতে পারবে যে কি অসচেতন ও অহংকারীই না তারা ছিল এবং তাদের সব প্রচেষ্টাই পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়েছে! এটা স্পষ্ট তারা খুব বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছে। কারণ, তারা দুনিয়ার সুখ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে এবং পরকালীন চিরন্তন সুখ ও বেহেশত থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। তাই এ আয়াতে মানুষকে এ ধরনের অযৌক্তিক কল্পনা ও বাস্তবতার ব্যাপারে এমন গভীর অসচেতনতার মারাত্মক বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে এবং তাদেরকে আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি, বিবেক ও কুরআনের পরিবর্তে কল্পনার আশ্রয় নিতে নিষেধ করা হচ্ছে।

এ দুই আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:
১. ব্যাপক কাজ ও প্রচেষ্টা মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না। বরং মুক্তির জন্য যা দরকার তা হল সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া এবং সত বা পুণ্যময় কাজ করার ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মত খোদায়ী লক্ষ্য বা নিয়ত থাকতে হবে।
২. আমাদের উচিত কল্পনাপ্রবণ হওয়া পরিবর্তে বাস্তববাদী ও সত্যদর্শী হওয়া। নিজের হিসেব-নিকেশের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়, কারণ, এই হিসেব-নিকেশ বাস্তব-ভিত্তিক নাও হতে পারে।

সূরা কাহাফের ১০৫ ও ১০৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآَيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا (105) ذَلِكَ جَزَاؤُهُمْ جَهَنَّمُ بِمَا كَفَرُوا وَاتَّخَذُوا آَيَاتِي وَرُسُلِي هُزُوًا (106)
“তারা হল ঐসব লোক যারা তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনগুলো ও তাঁর সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছে; ফলে তাদের কাজগুলো বিনষ্ট হয়ে গেছে; সুতরাং কিয়ামত দিবসে আমরা তাদের জন্য পাল্লা স্থাপন করব না।” (১৮:১০৫)
“জাহান্নামই হবে তাদের প্রতিফল, যেহেতু তারা অবিশ্বাস করেছিল এবং আমার নিদর্শনাগুলো ও আমার রাসূলদের পরিহাসের বিষয়বস্তু করেছিল।” (১৮:১০৬)

এ দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, যাদের চিন্তা-ভাবনা ও কাজকর্ম বা আমলের মধ্যে সমস্যা রয়েছে, বিশেষ করে যাদের জীবনের শেষের দিকে কাজ ও চিন্তাভাবনায় কুফরি থাকবে দোযখ হবে তাদের পরিণতি। কারণ, তাদের নিজেদের কাছে নিজ কাজ সুন্দর মনে হলেও পরকালে তাদের কাজের কোনো মূল্য থাকবে না। খোদাদ্রোহীতা ও সত্যকে অস্বীকার মানুষের সব কাজকে বরবাদ করে দেয়। তাই সতকর্মশীলদেরকেও এ ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। একজন মানুষ সারা জীবন মনিবের খেদমত করা সত্ত্বেও যদি কর্মজীবনের শেষের দিকে মনিবকে গালি দেয় তাহলে যেমন মনিব তার ওপর অসন্তুষ্ট হবেন ও তাকে কোনো পারিশ্রমিক বা পুরস্কার দেবেন না তেমনি সতকর্মশীল ব্যক্তিও যদি ঈমান নিয়ে মরতে না পারেন তাহলে তার সব ভাল কাজই ব্যর্থ হবে।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. কাজের বাহ্যিক দিকের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত নয়। কোনো কোনো কাজ আমাদের বাহ্যিক দৃষ্টিতে খুবই বড় ও সুন্দর মনে হতে পারে, অথচ বাস্তবে সেসব কাজ মূল্যহীন ও অন্তঃসারশূন্য।
২.যেসব অবিশ্বাসী বা কাফের আল্লাহকে অস্বীকার করে এবং খোদায়ী নিদর্শন, আল্লাহর বাণী ও নবী-রাসূলকে উপহাস করে তাদের সব ভাল কাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের সৌভাগ্য ও চূড়ান্ত পরিণতি নির্ভর করে ইহকালীন জীবনে তার সর্বশেষ কাজগুলোর ওপর।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন