সূরা কাহাফ; আয়াত ১৮-২১

শেষ নবীর আগমনের বহু আগে একদল লোক তাদের ধর্ম ও বিশ্বাসকে রক্ষার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তারা গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েন। তাদের কানে কোনো শব্দ যায়নি বলে তাদের ঘুম ভাঙেনি। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, ঘুমন্ত এসব ঈমানদার ব্যক

সূরা কাহাফ; আয়াত ১৮-২১১ 

সূরা কাহাফের ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন:
وَتَحْسَبُهُمْ أَيْقَاظًا وَهُمْ رُقُودٌ وَنُقَلِّبُهُمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَذَاتَ الشِّمَالِ وَكَلْبُهُمْ بَاسِطٌ ذِرَاعَيْهِ بِالْوَصِيدِ لَوِ اطَّلَعْتَ عَلَيْهِمْ لَوَلَّيْتَ مِنْهُمْ فِرَارًا وَلَمُلِئْتَ مِنْهُمْ رُعْبًا (18)
“তুমি মনে করতে ওরা জাগ্রত, কিন্তু ওরা ছিল ঘুমন্ত। আমি ওদের পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম ডানে ও বামে এবং ওদের (পাহারাদার) কুকুর সামনের পা দু’টি গুহার প্রবেশমুখে মেলে ধরেছিল। ওদের দিকে তাকালে তুমি পেছন ফিরে পালিয়ে যেতে এবং ওদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তে।” (১৮:১৮)

গত পর্বে বলা হয়েছে,শেষ নবীর আগমনের বহু আগে একদল লোক তাদের ধর্ম ও বিশ্বাসকে রক্ষার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তারা গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েন। তাদের কানে কোনো শব্দ যায়নি বলে তাদের ঘুম ভাঙেনি। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, ঘুমন্ত এসব ঈমানদার ব্যক্তির চোখ খোলা ছিল। যদি তাদের কেউ দেখতো তবে তাদের মনে হতো, এসব মানুষ জেগে আছে কিন্তু তারা কানে শোনে না। অর্থাত তাদেরকে দেখে মানুষ ভয়ে দৌড়ে পালাতো। হয়ত ঘুমিয়ে পড়া ব্যক্তিদের জীবন বাঁচানোর জন্যই আল্লাহ এ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

এ আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ বলছেন, আমি গুহাবাসীদের ঘুমন্ত অবস্থায় এ পাশ-ওপাশ ফিরিয়ে দিয়েছি যাতে তাদের শরীরের একটি অংশে ক্ষত সৃষ্টি না হয়। সেই সঙ্গে তাদের সঙ্গে থাকা কুকুরটি গুহার প্রবেশমুখে এমন ভঙ্গিতে বসে বসে ঘুমাতে থাকে যে, ভয়ে কারো পক্ষে গুহার কাছে আসা সম্ভব না হয়। সর্বোপরি আসহাবে কাহাফ বা গুহার অধিবাসীদের জীবন রক্ষার জন্য আল্লাহ সব ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যাতে এসব মানুষ ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকতে পারেন।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে :
এক. আল্লাহ তায়ালা চাইলে একটি পাহাড়ের গুহায় মাকড়সা দিয়ে তার রাসূলকে রক্ষা করতে পারেন এবং আরেকটি গুহায় কুকুরের মাধ্যমে ঈমানদার লোকদের জীবন রক্ষা করেন।
দুই. মানুষের প্রতি মহান আল্লাহর আরেকটি অনুগ্রহ হলো- তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘুমের মধ্যে এপাশ ওপাশ ফিরে শোয়। এর ফলে তাদের শরীর সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।

সূরা কাহাফের ১৯ ও ২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَكَذَلِكَ بَعَثْنَاهُمْ لِيَتَسَاءَلُوا بَيْنَهُمْ قَالَ قَائِلٌ مِنْهُمْ كَمْ لَبِثْتُمْ قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالُوا رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثْتُمْ فَابْعَثُوا أَحَدَكُمْ بِوَرِقِكُمْ هَذِهِ إِلَى الْمَدِينَةِ فَلْيَنْظُرْ أَيُّهَا أَزْكَى طَعَامًا فَلْيَأْتِكُمْ بِرِزْقٍ مِنْهُ وَلْيَتَلَطَّفْ وَلَا يُشْعِرَنَّ بِكُمْ أَحَدًا (19) إِنَّهُمْ إِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ يَرْجُمُوكُمْ أَوْ يُعِيدُوكُمْ فِي مِلَّتِهِمْ وَلَنْ تُفْلِحُوا إِذًا أَبَدًا (20)
“এবং এইভাবেই আমি ওদের (ঘুম থেকে) জাগিয়ে তুললাম, যাতে ওরা পরস্পরের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের একজন বলল- তোমরা কতকাল (এখানে) অবস্থান করেছো? কেউ কেউ বলল, একদিন বা একদিনের কিছু অংশ। আবার কেউ কেউ বলল-তোমরা কতকাল অবস্থান করেছো তা তোমাদের প্রতিপালকই ভালো জানেন। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ নগরে পাঠাও, সে যেন দেখে কোন্‌ খাদ্য উত্তম এবং তা হতে যেন কিছু খাবার কিনে নিয়ে আসে তোমাদের জন্য; সে যেন বুদ্ধি-বিবেচনার সঙ্গে চলে ও কিছুতেই যেন তোমাদের সম্পর্কে কাউকে কিছু না বলে।”(১৮:১৯)
“নিশ্চয়ই যদি তারা তোমাদের বিষয়ে জানতে পারে তবে তোমাদের পাথরাঘাতে হত্যা করবে, অথবা তোমাদের ওদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে এবং সেক্ষেত্রে তোমরা কখনই সাফল্য পাবে না।”(১৮:২০)

এ আয়াতে দীর্ঘ ঘুমের পর জেগে ওঠা গুহাবাসীদের কথোপকথন বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলছেন, যেভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় তাদেরকে মৃত্যুর মতো ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম তেমনিভাবে ঘুম থেকে তাদেরকে আবার জাগিয়ে তুলি। তারা কতক্ষণ হলো গুহায় এসেছে তা নিয়ে পরস্পর ভিন্নমত পোষণ করলো কিন্তু কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেন না। তারা বিষয়টিকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলো। এ অবস্থায় খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের ক্ষুধা লেগে গেল কিন্তু গুহায় তখন কোনো খাবার ছিল না। এ কারণে তারা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে টাকা-পয়সা দিয়ে শহরে পাঠালো হালাল খাবার কিনে আনার জন্য।
শহরে পৌঁছে খাবারের দোকানদারকে টাকা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানদার বহুদিনের পুরণো মুদ্রা দেখে তাকে সন্দেহ করেন। দোকানদার গুহাবাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তা এ কান ও কান হয়ে শেষ পর্যন্ত রাজদরবারে পৌঁছে যায়। এর পরের ঘটনা পরবর্তী আয়াতের বর্ণিত হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :
এক. গুহাবাসীর ঘটনা থেকে যে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায় তা হলো- মৃত্যু পরবর্তী জীবনে সব মানুষকে আবার জীবিত করা আল্লাহর জন্য অতি সহজ। এতে অবিশ্বাস করা উচিত নয়।
দুই. মুমিন ব্যক্তি যেন নিজেকে গোপন কথা সংরক্ষণকারী হিসেবে গড়ে তোলে। শত্রুর মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলম্বন করা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। যদিও শত্রু ক্ষতি করার কোনো চেষ্টাই বাদ রাখবে না।
তিন. ঈমানদার ব্যক্তি সামনে কোনো খাবার পেলেই খেতে শুরু করে না। খাবারটি হালাল কিনা তার খোঁজ-খবর নেয়।

সূরা কাহাফের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَكَذَلِكَ أَعْثَرْنَا عَلَيْهِمْ لِيَعْلَمُوا أَنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَأَنَّ السَّاعَةَ لَا رَيْبَ فِيهَا إِذْ يَتَنَازَعُونَ بَيْنَهُمْ أَمْرَهُمْ فَقَالُوا ابْنُوا عَلَيْهِمْ بُنْيَانًا رَبُّهُمْ أَعْلَمُ بِهِمْ قَالَ الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَى أَمْرِهِمْ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا (21)
“এবং এইভাবে আমি (মানুষকে) ওদের বিষয় জানিয়ে দিলাম, যাতে তারা জানতে পারে যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং কিয়ামতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন তারা তাদের কর্তব্যের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করছিল, তখন অনেকে বলল- তাদের উপর এক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কর, কারণ ওদের প্রতিপালক ওদের বিষয়ে ভালো জানেন। কিন্তু যারা তাদের কাজ সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছিল (এবং তাদের রহস্য জেনে গিয়েছিল), তারা বলল- নিশ্চয়ই আমরা ওদের (কবরের) উপর মসজিদ নির্মাণ করব।”(১৮:২১)

আগের আয়াতে যেমনটি বলেছি, গুহাবাসীর কাছে তিনশ’ বছর আগের স্বর্ণমূদ্রা দেখে শহরের লোকজন গুহায় মানুষের ঘুমিয়ে থাকা সংক্রান্ত ঘটনা বিশ্বাস করতে শুরু করে। হাজার হাজার মানুষ সেই ঐতিহাসিক গুহার দিকে এগিয়ে যায়। তবে গুহাবাসীদের মধ্যে যিনি খাবার কিনতে গিয়েছিলেন, তিনি লোকজনের ছুটে আসার খবর গুহায় পৌঁছে দেয়ার জন্য দ্রুতগতিতে সবার আগে গুহায় পৌঁছে যান। এ অবস্থায় তারা সবাই আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করেন এবং মহান আল্লাহ তাদের আশা পূর্ণ করেন। শহরের মানুষ তাদের কাছে পৌঁছে দেখল গুহাবাসীরা ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু তিনশ’ বছর ঘুমিয়ে থাকার পরও তাদের শরীর বা পোশাকের এতটুকু ক্ষতি হয়নি। এখান থেকে মানুষকে জীবিত করা সংক্রান্ত আল্লাহর অপরিসীম ক্ষমতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

এ অবস্থায় শহরবাসীর একাংশ গুহাবাসীর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ঈমানদারগণ দেখলেন, মৃত্যু পরবর্তী জীবনে মানুষের আবার জীবিত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য এটি একটি জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। তাই তারা বিষয়টিকে মানুষের স্মরণে রাখার ব্যবস্থা করতে গুহাবাসীদের কবরের পাশে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে :
১. অতীত জাতিগুলোর ইতিহাসের নিদর্শনাবলী সংরক্ষণ করা উচিত। এর মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম শিক্ষা লাভ করতে পারে।
২. ওলি-আউলিয়াদের কবর ও মাজাদের উপর মসজিদ নির্মাণ করার রীতি ইসলাম ধর্মে চালু রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। পবিত্র কুরআনেও এ ধরনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকারী বান্দাদের কবরের উপর মসজিদের চেয়ে উত্তম স্মৃতিসৌধ আর হতে পারে না।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন