সূরা হাজ্জ; আয়াত ৬৭-৭১

মক্কার মুশরিকরা বলত, তারা হযরত ইব্রাহিম (আ.)'র অনুসারী। আর মদিনার ইহুদিরা বলত, তারা হযরত মুসা নবী (আ.)'র অনুসারী। তাঁদের ছিল ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় প্রথা ও বিধান। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নতুন শরীয়ত বা বিধান আনেন। মুশরিক ও ইহুদিরা ইসলামের নবী (সা.)'র স

সূরা হাজ্জ; আয়াত ৬৭-৭১


সূরা হাজ্জের 67 নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
لِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا هُمْ نَاسِكُوهُ فَلَا يُنَازِعُنَّكَ فِي الْأَمْرِ وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ إِنَّكَ لَعَلَى هُدًى مُسْتَقِيمٍ (67)
"আমরা প্রত্যেক জাতির জন্য ইবাদতের পদ্ধতি নির্দিষ্ট করেছিলাম,যার ভিত্তিতে তারা কাজ-কর্ম করে। সুতরাং এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে তাদের বিবাদ করা উচিত নয় এবং তুমি (জনগণকে) তোমার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান কর; নিঃসন্দেহে তুমি হেদায়াতের সরল পথেই আছ।" (২২:৬৭)

মক্কার মুশরিকরা বলত, তারা হযরত ইব্রাহিম (আ.)'র অনুসারী। আর মদিনার ইহুদিরা বলত, তারা হযরত মুসা নবী (আ.)'র অনুসারী। তাঁদের ছিল ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় প্রথা ও বিধান। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নতুন শরীয়ত বা বিধান আনেন। মুশরিক ও ইহুদিরা ইসলামের নবী (সা.)'র সঙ্গে তর্ক করার জন্য বলত: তুমি যদি আল্লাহর নবী হয়ে থাক তাহলে কেন নতুন বিধান এনেছ এবং কেন ইব্রাহিম ও মুসার (আ.) পথ ত্যাগ করেছ?
মহান আল্লাহ এর জবাবে পবিত্র কুরআনে বলছেন, সব খোদায়ী ধর্ম ও বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে। তবে যুগের পরিক্রমায় মানুষের অবস্থা ও চাহিদার আলোকে আল্লাহ ধর্মীয় দায়িত্ব পালন ও ইবাদতের ক্ষেত্রে কিছু ভিন্নতা এনেছেন। এইসব ভিন্নতা সত্ত্বেও সব খোদায়ী ধর্মই মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদত ও সরল পথের দিকে আহ্বান জানিয়েছে। আসলে বিভিন্ন খোদায়ী ধর্ম হল একই স্কুলের নানা ক্লাসের মত যা ধাপে ধাপে শিক্ষার্থীকে উন্নতি ও পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেয়।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. এমন কোনো জাতি নেই আল্লাহ যাদের কাছে পথ-প্রদর্শক ও ধর্ম পাঠাননি যাতে তারা সঠিক পন্থায় ইবাদত-বন্দেগি করতে পারে ও সঠিক উপায়ে জীবন যাপন করতে পারে।
২. বিরোধীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক বা বিবাদ যেন আমাদেরকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত না করে কিংবা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে হীনবল ও ক্লান্ত না করে।
৩. নবী-রাসূলরা মানুষের জন্য সরল ও সঠিক পথে চলার ক্ষেত্রে আদর্শ বা দিশারি।

সূরা হাজ্জের 6৮ ও ৬৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِنْ جَادَلُوكَ فَقُلِ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا تَعْمَلُونَ (68) اللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ (69)
"এবং যদি তারা তোমার সঙ্গে বিবাদ করে, তবে বল, ‘তোমরা যা কর সে ব্যাপারে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি জানেন।" (২২:৬৮)
"তোমরা যে বিষয়ে মতবিরোধ করতে কিয়ামত দিবসে আল্লাহ সে বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবেন।" (২২:৬৯)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, নানা ধর্ম বা শরিয়তের কারণ সম্পর্কে তোমার তুলে ধরা যুক্তি-প্রমাণ যদি বিরোধীরা মেনে না নেয় এবং তারা যদি তর্ক ও বিবাদ অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের বল: আল্লাহ তোমাদের কথা ও আচরণ সম্পর্কে পুরোপুরি জানেন এবং তিনি কিয়ামত বা বিচার-দিবসে তোমাদের ও আমাদের মধ্যে মীমাংসা করবেন। তাই যা আমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় ও যেসব ঘটনায় আমাদের কোনো ভূমিকা নেই তা নিয়ে আমাদের সঙ্গে তর্ক-বিবাদ কর না।
এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. কেবল সত্যকে তুলে ধরার জন্য তর্ক-বিতর্ক গ্রহণযোগ্য। কিন্তু বিতর্কের একটি পক্ষ যদি একগুঁয়েমি বা গোঁড়ামি অব্যাহত রাখে তাহলে অবশ্যই তর্ক পরিহার করে তাকে আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত।
২. কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস বা ঈমান কাফিরদের মোকাবেলায় মু'মিন বা বিশ্বাসীদের দেয় আত্মিক প্রশান্তি।

সূরা হাজ্জের ৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ إِنَّ ذَلِكَ فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ (70)
"তুমি কি জান না যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে আল্লাহ তা অবশ্যই জানেন? নিশ্চয়ই এসব এক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে; নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।" (২২:৭০)

মহান আল্লাহ এ আয়াতে সৃষ্টি জগতের একটি মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলছেন, আল্লাহ আকাশমণ্ডল ও জমিনগুলোর স্রস্টা এবং সৃষ্টি জগতের তথা অস্তিত্ব-জগতের কোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয়। মানুষের কথা ও আচরণও এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষের সব ততপরতা তিনি দেখছেন নিখুঁতভাবে। সব কিছুকে ঘিরে আছে মহান আল্লাহর জ্ঞানগত দৃষ্টি। আর এই নির্ভুল জ্ঞানের ভিত্তিতেই মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন মানুষের বিচার করবেন। এ ছাড়াও খোদায়ী এই জ্ঞান লওহে মাহফুজে বা সংরক্ষিত ফলকে রেকর্ড বা সুরক্ষিত হয়ে আছে। এই রেকর্ডের খাতা থেকে কিছুই বাদ পড়ে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু'টি দিক হল:
১. সব সৃষ্টি সম্পর্কেই মহান আল্লাহর জ্ঞান একই ধরনের। জড় পদার্থ ও জীব থেকে শুরু করে সব বিষয়েই আল্লাহর জ্ঞান পরিপূর্ণ।
২. মানুষ যা যা বলে ও যা যা করে তার সবই আল্লাহর বইয়ে নথিবদ্ধ হয়। এখানে কোনো তথ্যই হারিয়ে যাওয়ার বা ভুলবশত বাদ পড়ার সুযোগ নেই।

সূরা হাজ্জের ৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَمَا لَيْسَ لَهُمْ بِهِ عِلْمٌ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ نَصِيرٍ (71)
"তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর উপাসনা করে যার জন্য না আল্লাহ কোন সনদ নাজেল করেছেন, আর না তার ব্যাপারে স্বয়ং তাদের জ্ঞান আছে। বস্তুত অবিচারকদের কোন সাহায্যকারী নেই।" (২২:৭১)

আগের আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)'র সঙ্গে মুশরিকদের বিতর্কের কথা বলা হয়েছে। এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, যারা ইসলামী শরিয়ত নিয়ে তোমার সঙ্গে বিবাদ করছে তারা নিজেই এমনসব চিন্তাধারা ও আচরণের নাগপাশে বন্দী যে সেগুলো বিবেক, যুক্তি ও আল্লাহর বাণীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন, কোনো যুক্তি বা খোদায়ী নির্দেশ ছাড়াই তারা মূর্তি পূজা করছে। আল্লাহ কখনও তাদের মূর্তি পূজার নির্দেশ দেননি, কিংবা তাদেরকে নিজেদের ও আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপাসনা করতেও বলেননি এবং মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও বিবেকও এটা বলে না যে, মূর্তির সামনে বিনম্র ও নতজানু হওয়া উচিত।

নিঃসন্দেহে যারা এ ধরনের অযৌক্তিক কাজ করে যাচ্ছে তারা সর্বাগ্রে নিজের ওপরই জুলুম করছে এবং এ ছাড়াও জুলুম করছে আল্লাহর নবী-রাসূলদের ওপর যারা মানুষকে দেখিয়ে গেছেন সুপথ।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. ইবাদতের পন্থা বা পদ্ধতির ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলাই হল বুদ্ধিবৃত্তিক ও যৌক্তিক পদক্ষেপ। ব্যক্তির অভিরুচি ও পছন্দ অনুযায়ী ইবাদত করতে চাইলে মানুষ সত্য থেকে বিচ্যুত হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে কুসংস্কার।
২. কেবল সামাজিক ক্ষেত্রে নয়, ধর্মীয় ক্ষেত্রেও যে কোনো ধরনের ব্যক্তিগত অভিরুচি চাপিয়ে দেয়া নিজের ওপর এবং ধর্মের ওপর এক ধরনের জুলুম বা অবিচার।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন