সূরা হাজ্জ; আয়াত ৭-১১

সূরা হাজ্জ; আয়াত ৭-১১

সূরা হাজ্জ; আয়াত ৭-১১


সূরা হাজ্জের ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَأَنَّ السَّاعَةَ آَتِيَةٌ لَا رَيْبَ فِيهَا وَأَنَّ اللَّهَ يَبْعَثُ مَنْ فِي الْقُبُورِ (7)
"এবং নির্ধারিত সময় বা কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, এতে কোন সন্দেহ নেই এবং সমাধিস্থ মৃতদের আল্লাহ অবশ্যই পুনরুত্থিত করবেন।" (২২:৭)

আগের পর্বে সূরা হাজ্জের প্রাথমিক কয়েকটি আয়াতের তাফসির করা হয়েছে। এইসব আয়াতে কিয়ামত বা পুনরুত্থানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, বৃষ্টির মাধ্যমে মৃত ও শুষ্ক ভূমিতে যিনি সবুজ গাছ বা ফসল ফলান এবং যিনি মাটি থেকে বীর্য সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি করেছেন তিনি অর্থাত অসীম শক্তিধর আল্লাহ কি মানুষের মৃত্যুর পর তাদের পুনরায় সৃষ্টি করতে পারবে না? আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, কিয়ামত বা পুনরুত্থান যে ঘটবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এই খোদায়ী বার্তার প্রতি ঈমান আনা উচিত। তোমাদের জানা উচিত যে, কবরই তোমাদের শেষ ঠিকানা নয়। বরং একটি নির্দিষ্ট সময় পর কবর থেকে আবার জীবিত করে তোলা হবে মানুষকে এবং তাদেরকে সমবেত করা হবে হাশরের ময়দানে ভাল ও মন্দ কাজের হিসাব তুলে ধরার জন্য। এরপর থাকবে জাহান্নামের শাস্তি অথবা বেহেশতবাসী হওয়ার পালা।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. যিনি কোনো কিছু একবার সৃষ্টি করতে পারেন তিনি আবারও সেই সত্তা বা অস্তিত্বকে সৃষ্টি করতে সক্ষম। তাই এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
২. মানুষের পুনরুত্থান শারীরিকভাবেই ঘটবে। মহান আল্লাহ মাটির কাছে যে আমানত রেখেছেন তা আবারও মাটি থেকে বেরিয়ে আসবে।

সূরা হাজ্জের ৮ থেকে ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُنِيرٍ (8) ثَانِيَ عِطْفِهِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ لَهُ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَنُذِيقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَذَابَ الْحَرِيقِ (9) ذَلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ يَدَاكَ وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ (10)
"মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছে যারা জ্ঞান,পথনির্দেশ ও দীপ্তিমান গ্রন্থ ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে।" (২২:৮)
"সে দাম্ভিকতাবশত পার্শ্ব ফিরিয়েই রয়েছে যাতে (অন্যদেরও) আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করতে পারে। তার জন্য ইহলোকে রয়েছে লাঞ্ছনা বা অসম্মান এবং কিয়ামত দিবসে তাকে দগ্ধকারী শাস্তি আস্বাদ করাব।" (২২:৯)
"(এবং তাকে বলা হবে,) এ তোমার কৃতকর্মের প্রতিফল, নিশ্চয় আল্লাহ বান্দাদের প্রতি কখনও অবিচার করেন না।" (২২:১০)

এই আয়াতে আবারও ধর্ম, কিয়ামত বা পুনরুত্থান ও স্রষ্টা সম্পর্কে ইসলাম বিরোধী মহলের নানা তর্ক-বিবাদ সম্পর্কে কথা বলেছেন মহান আল্লাহ। তিনি বলছেন: এক শ্রেণীর মানুষ কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি বা দলিল-প্রমাণ ছাড়াই দম্ভ বা অহমিকা দেখানোর জন্য মুমিনদের সঙ্গে তর্ক করে। তারা মানুষকে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করে ভুল পথে নিয়ে যেতে চায়।

ইসলামী সংস্কৃতিতে সত্যকে স্পষ্ট করার জন্য বিতর্ক বা সংলাপকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। তাই মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.)-কে বলছেন: বিরোধীদেরকে ধর্মের দিকে আহ্বানের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা বা হেকমাত, সতর্ককরণ ও বিতর্কের মত পদ্ধতিগুলোকে বৈধ পন্থা হিসেবেই ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এটা স্পষ্ট, যে কোনো বিতর্ক অবশ্যই যুক্তি ও প্রমাণ-ভিত্তিক হতে হবে এবং এইসব যুক্তি-প্রমাণও হতে হবে উভয়পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য ঠিক যেভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক নানা যুক্তি ও নির্ভরযোগ্য ধর্মীয় বর্ণনা বা টেক্সট সব পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য।

এ ছাড়াও এই আয়াতে মহান আল্লাহ সেইসব বিতর্ককারীকে ইহকাল ও পরকালে কঠোর শাস্তি দেবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন যারা সত্যকে তুলে ধরতে বা সত্য অনুসন্ধানের জন্য নয়, বরং মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিতর্ক বা বিবাদ করে। মহান আল্লাহ বলছেন: আমি তাদেরকে ইহকালে কলঙ্কিত করব এবং লাঞ্ছনা ও অবমাননার শিকার করব। আর পরকালে তাদের জন্য জাহান্নামের আগুন তো আছেই।

এই আয়াতগুলোর শিক্ষা হল :
১. ধর্ম বিষয়ে বিতর্ক ততক্ষণই ভাল বা কল্যাণকর যতক্ষণ তা হবে জ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক, বিদ্বেষ ও অহংকার-ভিত্তিক নয়।
২. নিঃসন্দেহে খোদায়ী শাস্তিগুলোর জন্য মানুষের অপছন্দনীয় আচরণই দায়ী। যুক্তিহীন দাম্ভিকতার শাস্তি হল লাঞ্ছনা ও কলঙ্ক।

সূরা হাজ্জের ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انْقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ (11)
"মানুষের মধ্যে এমনও আছে যারা কেবল মৌখিকভাবে (পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে ও শর্তসাপেক্ষে সন্দেহ আর দোদুল্যমান মন নিয়ে ) আল্লাহর উপাসনা করে, যদি (ধর্মের মাধ্যমে) সে কোন কল্যাণ (তথা পদ বা সম্পদ) পায় তবে তার হৃদয় প্রশান্ত হয়। আর যদি (ধর্মের কারণে) কোন বিপদ (যেমন, রোগ বা দারিদ্র) তাকে স্পর্শ করে, তবে সে তার মুখ ফিরিয়ে নেয় (অর্থাত কুফুরিতে লিপ্ত হয়); এরা ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত এবং এটাই তো সুস্পষ্ট ক্ষতি।" (২২:১১)

এই আয়াতে দুর্বল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তিদের অবস্থা তুলে ধরে আল্লাহ বলছেন: এই শ্রেণীর মানুষ ঈমানের এত প্রান্তসীমায় রয়েছে যে তারা যে কোনো সময় কুফরির অতল গহ্বরে পড়ে যেতে পারে। কারণ, ঈমান তাদের মনের গভীরে স্থান পায়নি। তারা শুধু মৌখিকভাবে ইসলামের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তাই এরা যতক্ষণ সুখে শান্তিতে থাকে কেবল ততক্ষণ আল্লাহর প্রশংসা করে ও নামাজ আদায় করে। কিন্তু যখন সামান্যতম কোনো বিপদ বা কষ্ট তাদের স্পর্শ করে তখন তারা খোদাদ্রোহী কথাবার্তা বলে ও আল্লাহর বিরুদ্ধে নানা নালিশ করতে থাকে।
অন্য কথায় এদের ধর্ম হল তাদের দুনিয়াবি স্বার্থের অনুগামী। দুনিয়ার স্বার্থ বজায় থাকলে এরা দ্বীনদার ও ধর্মের পক্ষে থাকে। কিন্তু দুনিয়ার স্বার্থ না থাকলে তারা ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথচ প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির বিষয় বা পার্থিব লাভ বা ক্ষতির বিষয় খোদায়ী পরীক্ষা মাত্র। এই পার্থিব জীবন মানুষের পরীক্ষার স্থল মাত্র।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. আমরা যেন আমাদের ঈমান নিয়ে বড়াই না করি। কারণ, আমরা কি নিশ্চিত যে কঠিন বিপদ ও সংকট আসলে আমাদের আচরণ মুমিনদের মতই থাকবে?
২. মানুষের পার্থিব জীবনের নানা সংকট ও বিপদ হল পরীক্ষার মাধ্যম। আমরা যদি ধৈর্য ধারণ করি তাহলে পুরস্কার পাব। আর আমরা যদি বিপদের মুখে খোদাদ্রোহীতা বা কুফুরিতে লিপ্ত হই তাহলে আল্লাহর ক্রোধ ও শাস্তি আমাদের ওপর নেমে আসবে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন