নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৪২তম পর্ব

ইসলাম ধর্মের আহবান জানাতে গিয়ে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীগণকে ঠাট্রা-বিদ্রুপ থেকে শুরু করে অশেষ লাঞ্ছনা, নির্যাতন এবং এমনকি শাহাদতের মতো সর্বোচচ ত্যাগও স্বীকার করতে হয়েছে৷ আসলে ন্যায়বিচার, সাম্য, সত্য ও মুক্তির আহবান শোষক, নির্যাতক

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৪২তম পর্ব

ইসলাম ধর্মের আহবান জানাতে গিয়ে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীগণকে ঠাট্রা-বিদ্রুপ থেকে শুরু করে অশেষ লাঞ্ছনা, নির্যাতন এবং এমনকি শাহাদতের মতো সর্বোচচ ত্যাগও স্বীকার করতে হয়েছে৷ আসলে ন্যায়বিচার, সাম্য, সত্য ও মুক্তির আহবান শোষক, নির্যাতক ও মানুষের ওপর প্রভুত্বের দাবীদার কায়েমী স্বার্থবাদীদের জন্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হত৷ তাই তাঁরা সত্যের আহবান প্রতিরোধের জন্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে-এটাই স্বাভাবিক৷ নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীরা যদি সত্যের আহবান জানাতে গিয়ে এত ব্যাপক বা অস্বাভাবিক নির্যাতন ও প্রতিরোধের শিকার না হতেন তাহলে সেটাই হতো অস্বাভাবিক ও বিস্ময়ের ব্যাপার৷ সত্যের আহবান যত সুদৃপ্ত ও যত খাঁটি হয়ে থাকে মিথ্যার বা বাতিলের প্রতিরোধ এবং নির্যাতনও তত কঠোর বা নির্মম হয়ে থাকে৷ সত্যের পথকে চেনার ও বোঝার এটাও অন্যতম পন্থা৷ তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সত্যের আহবান জানাতে গিয়ে তিলে তিলে অসহ যন্ত্রণা, নির্যাতন এবং সঙ্গী-সাথী বা পরিবারের ঘনিষ্ঠ সহযোগীর শাহাদতের মতো দূঃসহ পরিস্থিতির মধ্যেও দয়ার অতলান্ত সাগর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বিভ্রান্ত ও বিরুদ্ধবাদী জনতাকে অভিশাপ দেননি৷ বরং তিনি মহান আল্লাহর দরবারে তাদের জন্যে দোয়ার হাত প্রসারিত করে আল্লাহর দরবারে এ প্রার্থনা জানাতেন যে, হে আল্লাহ, এরা বোঝে না, তুমি তাদের সুপথ দেখাও বা বোঝার তৌফিক দান কর৷ তায়েফে ইসলামের আহবান জানাতে গিয়ে পাথর বৃষ্টির শিকার হবার পরও চরম ধৈর্য ধারণ করেছিলেন আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল৷ তাঁর ওপর নির্যাতন এত চরমে উঠেছিল যে ফেরেশতারা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিল, হে আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল! আপনি যদি আদেশ করেন তাহলে এ অবাধ্য জনগণের ওপর পাহাড় চাপিয়ে দিয়ে তাদের ধবংস করে দেব৷ কিন্তু দয়ার অতলান্ত সাগর নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) তাদের অভিশাপ না দিয়ে তাদের মঙ্গল কামনা করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, এরা মুসলমান না হলেও এদের সন্তানরা হয়তো একদিন মুসলমান হবে৷ রাসূলে পাক (সাঃ) জানতেন আল্লাহর ধর্ম এক সময় বিজয়ী হবেই৷ যে মক্কার লোকেরা তাঁর ওপর এত নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছিল মক্কা বিজয়ের সময় তিনি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন৷ আর এই ক্ষমাশীলতা ও মহানুভবতা দেখে দলে দলে মক্কার কাফের ও মুশরিকরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে৷ তাই এটা স্পষ্ট তরবারীর মাধ্যমে নয়, বরং পবিত্র কোরআনের বাণী ও বিশ্বনবী (সাঃ)'র অবিশ্বাস্য মহানুভবতা, বিস্ময়কর সততা, অশেষ খোদাভীরুতা, অভূতপূর্ব চারিত্রিক সৌন্দর্য ও অনুপম আচার-আচরণে আকৃষ্ট হয়েই তৎকালীন আরব ভূখন্ডের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল৷ দুঃখের বিষয় হলো সভ্যতার বিশ্বের উজ্জ্বলতম আদর্শের অধিকারী নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) এই আধুনিক যুগেও এক শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থবাদী ও বিবেকহীন লোকদের বিদ্বেষী প্রচারণা ও অবমাননার শিকার হচেছন৷ চলতি বছরে ইরানের অন্যতম সেরা গ্রন্থ হিসেবে নির্বাচিত বই "নবী-চরিত, বাস্তব যুক্তির লেখক অধ্যাপক ডক্টর মোস্তফা দেলশাদ তেহরানী এ সম্পর্কে বলেছেন, ইন্টারনেট ও কম্পিউটার প্রযুক্তির মতো তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির এই যুগে বিভিন্ন গণমাধ্যম বিশ্ববাসীর কাছে অনেক বাস্তবতা তুলে ধরতে সক্ষম৷ কিন্তু এসব গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রকরা বিশ্ববাসীকে কোনো কোনো বিশেষ বিষয়ে অজ্ঞ রাখতে চান৷ যেমন, এসব গণমাধ্যম ইসলাম ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে সত্যের ব্যাপক বিকৃতি ঘটিয়ে যাচেছ৷ সত্যি বলতে কি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাদের এই যুগে অতীতের চেয়েও বেশী মজলুম বা জুলুমের শিকার হচেছন৷ বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য ও সূত্রের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো ওয়েবসাইট বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র নামে এমনসব অপবাদ রটনা করছে যা পুরোপুরি অবাস্তব৷ এ ধরনের রটনা খুবই যন্ত্রণাদায়ক৷ আধুনিক যুগের মানুষকে এটা যথাযথভাবে বুঝতে হবে যে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র অবমাননা কেবল একজন পবিত্র মানুষের অবমাননা নয়৷ বরং তাঁর অবমাননা মানুষের চিরকাংখিত সব ধরনের মহত্ত, সৌন্দর্য ও সৎগুণাবলীকে পর্যুদস্ত করার সমতুল্য৷ ডক্টর মোস্তফা দেলশাদ তেহরানী আরো বলেছেন, নৈতিকতা ও মানবতার এই সীমাগুলোকে বিপর্যস্ত করার মাধ্যমে নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠার পথই সুগম করা হচেছ৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) গোটা মানবজাতির সম্পদ এবং তিনি মানবজাতির কাছে যা উপহার দিয়েছেন তাও গোটা মানবজাতির সম্পদ৷ তাই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র অবমাননার ব্যাপারে বিশ্বের সমস্ত শিক্ষিত মানুষ ও মুক্তমনা মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত এবং তাদের উচিত এ মহামানবের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য ও পবিত্রতার সীমানা সংরক্ষণ করা এবং তাঁর মহান শিক্ষাগুলোকে ছড়িয়ে দেয়া৷ যদিও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) একটি নির্দিষ্ট স্থানে ও যুগে বসবাস করেছিলেন, কিন্তু তিনি মাটির মানুষ হয়েও স্বর্গীয় সুষমার অধিকারী ছিলেন এবং তিনি ছিলেন স্থান ও কালের গন্ডীর উধের্ব৷ বিশ্বনবী (সাঃ) আজও মানবজাতির পথপ্রদর্শক৷ আর এ জন্যেই পবিত্র কোরআনের সূরা আহজাবে তাঁকে সব মানুষের জন্যে আদর্শ বলা হয়েছে এবং মানুষ যদি তাঁর আদর্শের অনুসারী হয় তাহলেই তারা মুক্তি পাবে৷ ইরাকের বিশিষ্ট অধ্যাপক ও গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম বাক্বের শারীফ আল ক্বোরাইশী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে বলেছেন, রাসূলে পাক (সাঃ) সদাচারণ ও উন্নত নৈতিক গুণাবলীর দিক থেকে নজিরবিহীন, তিনি ছিলেন মহান আল্লাহর নিদর্শন৷ তাঁর ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দৃঢ় ও অদম্য ইচছা-শক্তি৷ ইসলামের প্রাথমিক দিনগুলোতে অজ্ঞতার আঁধারে নিমজ্জিত শক্তিগুলো রাসূলে পাক (সাঃ)'র মোকাবেলায় সমস্ত সামর্থ নিয়ে সংঘবদ্ধ এবং নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল৷ কিন্তু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছিলেন, তোমরা যদি আমার এক হাতে সূর্য এবং অন্য হাতে চাঁদ এনে দাও তাহলেও আমি সত্য ধর্ম প্রচারের এ দায়িত্ব ত্যাগ করবো না৷ এ ধরনের অদম্য ইচছাশক্তি ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞার মাধ্যমেই বিশ্বনবী (সাঃ) ইতিহাসের গতি বদলে দিয়েছিলেন এবং পাপ-পংকিলতা ও লক্ষ্যহীনতায় মগ্ন সমাজকে সৌন্দর্য, কল্যাণ ও প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ জীবনের দিকে পরিচালিত করেন৷ বিখ্যাত অধ্যাপক ও গবেষক ডক্টর রহীমপুর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র প্রতি বিদ্বেষী আচরণ সম্পর্কে বলেছেন, নূরনবী (সাঃ) সম্পর্কে সন্দেহবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বা নেতিবাচক নীতি সেই জাহেলী যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল৷ বিদ্বেষী এই নীতি পরবর্তিতে খৃষ্টান মিশনারীদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় এবং এই ধারা আজও বিভিন্ন পন্থায় ও কলেবরে অব্যাহত রয়েছে৷ সেই যুগে রাসূল (সাঃ)কে অস্বীকার করা হতো৷ আজ তারা বলছে ইসলাম ধর্মের ভাষা সভ্যতা-বর্জিত বা সেকেলে৷ অতীতে তারা বলতো, মুহাম্মাদ (সাঃ) যাদুকর! আজ ইসলাম ও সত্যের বিরোধীরা বলছে, নবীরা ছিলেন ক্যারিজমাটিক তথা জনগণের মধ্যে গভীর প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব এবং তারা সমাজকে সংস্কার করতেন৷ অতীতে তারা রাসূলে খোদা (সাঃ)'র নবুওত ও রেসালাতকে অস্বীকার করতো৷ বর্তমানে তারা প্রতারণামূলক শব্দের আশ্রয় নিয়ে একই অপবাদ দিচেছ৷ নবী-রাসূলগণ ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু বলে তারা ঠিক এখানেই আঘাত করছে৷ ডক্টর রহীমপুর আরো বলেন, নবী-রাসূলগণ মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় সামাজিক, জ্ঞানগত ও নৈতিক বিপ্লবগুলোর উৎস৷ তাই সামাজিক ও চিন্তাগত সমস্ত সাধনা বা প্রচেষ্টা ও সংঘাত নবী-রাসূলগণের আহবানকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে৷ কেউ যদি নবুওতের মূল নীতি বা ধারণাকেই অগ্রাহ্য করতে পারে, কিংবা নবী-রাসূলগণের ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে বিকৃত করে তুলে ধরতে পারে যে তাঁদের বক্তব্য ও আচার-আচরণ মানুষের জন্যে আদর্শস্থানীয় বলে বিবেচিত না হয় তাহলে ধর্ম বলে ভালো কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে না৷ এ অবস্থায় ধর্মের অর্থ হবে অস্পষ্টতা ও কিছু ব্যক্তির খেয়ালীপনা মাত্র এবং ধর্ম হয়ে পড়বে মানুষের জীবনে প্রভাবহীন একটি বিষয়৷ কিন্তু নবী-রাসূলগণ এসেছেন অজ্ঞতা, শির্ক, জুলুম, অবিচার ও অন্যের অধিকার লংঘন প্রতিরোধ করতে এবং মানুষের আচার-আচরণের ধারায় বিপ্লব সৃষ্টি করতে৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ছিলেন নবীগণের মধ্যেও সবচেয়ে কোমল ও দয়াদ্র হৃদয়ের অধিকারী৷ মানব-ইতিহাসে তাঁর মতো পবিত্র ও উদার চিত্তের মানুষ আর কখনও আসেনি এবং ভবিষ্যতেও আসবে না৷
ডক্টর রহীমপুর আরো বলেন, আর এসব কারণেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর সর্বশেষ দূত বা প্রতিনিধি৷ বর্তমান ও ভবিষ্যতেও মানুষের জীবনের সব ধরনের সমস্যা সমাধানের চাবি রয়েছে তাঁরই জীবনাদর্শে৷ তিনি ইতিহাসের সব যুগের জন্যে এবং সব মানুষের জন্যেই রাসূল৷ মানুষের জীবনের সবচেয়ে ক্ষুদ্র বা খুটিনাটি দিক থেকে শুরু করে পরকালীন, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন থেকে তিনি বিচিছন্ন নন৷ নূরনবী (সাঃ) মানবতা, ন্যায়বিচার ও যুক্তির ওপর জোর দিয়ে মানব জাতির জন্যে সবচেয়ে ভালো পথ প্রদর্শন করেছেন৷ মহান আল্লাহর অশেষ শোকর, আমরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ পেয়েছি৷ তিনি ছিলেন এমন একজন মহামানব যিনি মানুষকে ভ্রাতৃত্ব ও দয়া শিখিয়েছেন যে মানুষ ছিল সহিংসতা ও নৃশংসতায় অভ্যস্ত৷ ইসলামের শ্রেষ্ঠতম এই ব্যক্তিত্বের প্রতি রইলো আমাদের অসংখ্য সালাম ও দরুদ৷ পবিত্র কোরআনের ভাষায়- মহান আল্লাহ তাঁকে অনুগ্রহ করেছেন ; ফেরেশতাগণও তাঁর জন্যে অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন৷ হে মুমিন বা বিশ্বাসীগণ! তোমরাও নবীর জন্যে অনুগ্রহ প্রার্থনা কর এবং তাঁকে উত্তমরূপে অভিবাদন কর৷ (সূরা আহজাব-৫৬) (সমাপ্ত )
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন