নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৪তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৪তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৪তম পর্ব

অর্থনৈতিক শোষনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার সুদ প্রথা রহিত করা ছিল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ)'র অন্যতম স্মরণীয় সাফল্য ৷ জাহেলী যুগের আরব সমাজ ছিল সুদ প্রথার অভিশাপে জর্জরিত ৷ সুদ প্রথার ফলে ঋণগ্রহীতাকে ঋণ পরিশোধের সময় অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হয়৷ ফলে ঋণদাতা বা পুঁজিপতিরা আরো সম্পদশালী হতো এবং দরিদ্র ব্যক্তিরা আরো দরিদ্র হতো ৷ এ অবস্থার অবসানের জন্যে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সুদ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেন ৷ সূরা বাকারার ২৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে বিশ্বাসীরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং যদি তোমরা বিশ্বাসী হও, তবে পাওনা থেকে সুদের অংশ বর্জন কর৷
এ আয়াত নাজিল হবার পর রাসূল (সাঃ) জাহেলী যুগের সমস্ত সুদের দাবী পরিহার করতে হবে বলে জানিয়ে দেন৷ অন্যদিকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সুদের পরিবর্তে কারজুল হাসানা বা সুদবিহীন ঋণ প্রথা চালু করেন৷ পবিত্র কোরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে এই প্রথার প্রশংসা করা হয়েছে৷ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ যাতে পুঞ্জিভূত না হয় সেজন্যে বিশ্বনবী (সাঃ) উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ পবিত্র কোরআন দান ও সাদাকার জন্যে ব্যাপক সাওয়াব বা প্রতিদানের কথা ঘোষণা করেছে৷ জাহেলী যুগে আরব দেশের অধিকাংশ ধনী বা অভিজাত শ্রেণীর মানুষ দান খয়রাত বা অর্থ সাহায্য দেয়াকে ক্ষতি বলে মনে করতো৷ অধিকাংশ ধনী ব্যক্তি নিঃস্ব বা গরীবদেরকে চিরকালই গরীব বা নিঃস্ব দেখতে চাইতো৷ তারা মনে করতো অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে পড়লে গরীবরা আর ধনীদের সামনে মাথা নত করবে না৷ একবার একদল ধনী রাসূল (সাঃ)'র কাছে এসে বললোঃ আমরা আপনার ওপর বিশ্বাস বা ঈমান আনতে প্রস্তুত রয়েছি, তবে এ জন্যে দুটি শর্ত রয়েছে৷ প্রথমতঃ নামাজের সময় আমাদের জন্যে রুকু মাফ করা হোক৷ কারণ, নত হওয়াটা আমাদের জন্যে এক ধরনের অবমাননার শামিল৷ দ্বিতীয় শর্ত হলো, আমরা জাকাত দিতে পারবো না৷ কারণ, জাকাত দেয়ার ফলে প্রজারা শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং এর ফলে তারা আর আমাদের আনুগত্য করবে না৷
ইসলাম পূর্ব-যুগে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টণের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক প্রথার প্রচলন ছিল৷ মৃত ব্যক্তির সম্পদ তার বড় পুত্র বা মৃত ব্যক্তির ভাইয়ের হস্তগত হতো৷ বিশ্বনবী (সাঃ) এই বৈষম্যমূলক প্রথা রহিত করেন৷ তিনি মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট ও বৈধ মাত্রায় বন্টণের নিয়ম চালু করেন৷ এভাবে মানবতার অর্থনৈতিক মুক্তিসহ সব ধরনের মুক্তির সর্বোত্তম দিশারী বিশ্বনবী (সাঃ) গুটিকয়েক লোকের হাতে সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠার প্রবণতা প্রতিরোধের আরো এক কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন৷ রাসূলে খোদা (সাঃ) বিভিন্ন ধরনের কল্যাণকর কর প্রথা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে ন্যায্য মাত্রায় বন্টণের নিয়ম চালু করে মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ খোমস, জিজিয়া, খারাজ ও যাকাত ছিল রাষ্ট্রীয় সম্পদের অন্যতম প্রধান উৎস৷ রাসূলে খোদা (সাঃ) এসব কল্যাণকর সম্পদের তত্ত্বাবধান করতেন এবং এসব সম্পদ দরিদ্র লোকদের মধ্যে বন্টণ করতেন৷
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র যুগে মদীনার বাজারের অবস্থা কেমন ছিল? তাহলে শোনা যাক সে সময়কার মদীনার কোনো এক বাজারের ঘটনা৷ জমজমাট ঐ বাজারে হঠাৎ দুই ব্যক্তির তর্কের আওয়াজ যেন বাজারের হৈচৈকে ছাপিয়ে উঠলো৷ পণ্যের মূল্য নিয়ে দর কষাকষি করতে গিয়ে ক্রেতা বিক্রেতাকে ছাড় দেয়ার আহবান জানাচিছল৷ অন্যদিকে বিক্রেতাও ছাড় দিতে রাজী হচিছল না৷ এ অবস্থায় বিশ্বনবী (সাঃ) ঐ বাজারে আসলে সেই দুই ব্যক্তি নীরব হয়ে যায়৷ তাদের একজন রাসূল (সাঃ)কে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! এই বিক্রেতাকে ন্যায়কামী হতে বলুন এবং পণ্যের বেশী দাম নিতে নিষেধ করুন৷ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা নিজ নিজ সম্পদের মালিক৷ আমি আশা করি শেষ বিচার বা কিয়ামতের দিনে আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবো যে সেদিন আমি যেন তোমাদের কারো ওপর অবিচারকারী হিসেবে সাব্যস্ত না হই৷ এর পর ন্যায় বিচারের প্রতিচছবি বিশ্বনবী (সাঃ) আকাশের দিকে হাত তুলে এ প্রার্থণা করলেন যে, (ইকো)
হে আল্লাহ তার ওপর রহমত বা অনুগ্রহ নাজিল করুন যে কেনা-বেচার সময় দয়াশীল হয় এবং দান ও বিচার-বিবেচনার ক্ষেত্রে কঠোর না হয়৷
বিশ্বনবী (সাঃ)'র এ আলোকোজ্জ্বল বাণী ঐ দুই ব্যক্তির ওপর গভীর প্রভাব ফেললো৷ তারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে ও রাসূল (সাঃ)'র দোয়ায় বর্ণিত রহমতের অধিকারী হবার জন্যে একে অপরের সাথে আপোস করলো৷
বিশ্বনবী (সাঃ)'র কাছে যখন সুরা তালাকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াত নাজিল হয়, তখন একদল মুসলমান কাজ কর্ম ছেড়ে দিয়ে সারাক্ষণ ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল হয়ে পড়ে৷ এ দুই আয়াতের অংশ বিশেষে বলা হয়েছিল, যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার পথ করে দিবেন, তাকে এমন উৎস থেকে জীবিকা দান করবেন যা তার ধারণাতীত ৷
যখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) দেখলেন, একদল লোক কাজ কর্ম ছেড়ে দিয়েছে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে জীবিকা পাবার আশায় কেবল ইবাদতে মশগুল হয়েছে, তখন তিনি মর্মাহত হলেন৷ বিশ্বনবী (সাঃ) বললেন, যারাই কাজ কর্ম ছেড়ে দেয়ার পথ গ্রহণ করেছে, তাদের ইবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না৷ কাজ করা এবং উপার্জন করা তোমাদের জন্যে জরুরী ৷ কাজ ও চেষ্টার খোদায়ী নেয়ামতের মাধ্যমে তোমরা আল্লাহর সাহায্য চাও৷"
সবশেষে অর্থনীতি বা জীবন ও জীবিকা সম্পর্কিত বিষয়ে বিশ্বনবী (সাঃ)'র কয়েকটি বাণী শুনিয়ে আজকের এ আলোচনা শেষ করবো৷ তিনি বলেছেনঃ
**সবচেয়ে অনুমোদনযোগ্য খাবার হলো তা যা কোনো ব্যক্তি নিজের প্রচেষ্টা বা কাজের মাধ্যমে অর্জন করে খেয়ে থাকে৷
**জিহাদ বলতে মহান আল্লাহর পথে সবসময় শুধু তরবারি ব্যবহার করাকেই বোঝায় না৷ জিহাদ বলতে জীবন নির্বাহের, বাবা-মা ও সন্তানের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেয়াকেও বোঝায়৷"
** যে দুনিয়ার ব্যাপারে উদাসীন, সে পরকালের ব্যাপারে আরো বেশী উদাসীন হয়৷ সেরা বা শ্রেষ্ঠ মুসলমান তারাই যারা ইহকাল ও পরকাল উভয় জগত থেকেই উপকৃত হয়৷ "
** জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে সুবিবেচক বা সংযমী তথা মধ্যপন্থী হও৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন