নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩২তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩২তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩২তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) তাঁর অসাধারণ গুণাবলী, চরিত্র-মাধুর্য ও সততার মাধ্যমে জনগণের ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু ও ইসলামী সমাজের মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছিলেন৷ তাঁর যেসব মহতী গুণ ইতিহাসে চিরবিস্ময়ের আকর হয়ে আছে সেসবের মধ্যে অন্যতম হলো পরস্পর বিচিছন্ন ও মারমুখো জাতি বা গোত্রগুলোকে এক অভিন্ন সত্তায় সীসা-ঢালা-প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ করা৷ বিশ্বনবী (সাঃ)'র অলৌকিক চরিত্র মাধূর্যের পরশ-পাথরের ছোঁয়ায় জাতিগত বৈষম্য, বংশীয় বা গোত্রীয় আধিপত্যকামিতা ও উগ্র জাতীয়তার সমস্যা বিলুপ্ত হয়ে মুসলিম সমাজের সর্বত্র ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের অটুট বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল৷ বিশ্বনবী (সাঃ) এটা জানতেন যে প্রত্যেক জাতির শক্তিমত্তা ও অগ্রগতি সে জাতির সংহতি ও ঐক্যের ওপর নির্ভরশীল৷
আরবের জাহেলী সমাজে কোনো রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধান না থাকায় তারা ছিল অনৈক্য ও বিভেদে অভ্যস্ত৷ এ অবস্থায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বিভিন্ন লিখিত চুক্তির মাধ্যমে মদীনার গোত্রগুলোর মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলেন৷ আকাবার অঙ্গীকার বা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তিনি বিভিন্ন গ্রুপ বা গোত্রের প্রতি বলেছিলেন, নিজেদের মধ্য থেকে ১২ ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করুন যাতে তারা নিজ নিজ গোত্রের মধ্যে সংঘটিত ঘটনার ব্যাপারে দায়িত্বশীল ও তত্ত্বাবধায়ক হতে পারেন৷ " রাসূল (সাঃ)'র এ পদক্ষেপ জনগণকে এত খুশী করেছিল যে যখন ঐ গোত্রগুলোর প্রতিনিধিদল আকাবার কাছে রাসূল (সাঃ) কে দেখতে ও তাঁর বক্তব্য শুনতে পায় তখন তারা বলেছিল যে, আল্লাহ হয়তো আপনার মাধ্যমেই আমাদের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও পরস্পরের বিবাদের মীমাংসা করবেন৷"
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনার জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব , সহমর্মিতা ও প্রীতির বন্ধন ফুলের সুরভির মতো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ তাঁর কথা ও বাণী সবখানেই মধুময় অমিয় সুধার মতো মানুষের অন্তরে স্থান করে নিত৷ তিনি বলেছেন, সংঘবদ্ধতার মধ্যেই রয়েছে রহমত এবং বিচিছন্নতার মধ্যে রয়েছে শাস্তি বা যাতনা৷ বিশ্বনবী (সাঃ) আরো বলেছেন, মুমিনদের পারস্পরিক সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা এক অভিন্ন দেহের মতো৷ এ দেহের কোনো এক অংশে ব্যাথা জাগলে শরীরের অন্য অংশেও তা অনুভুত হয়৷
মহানবী (সাঃ) একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ ও একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র-ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে সব মুসলমানকে মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ তিনি প্রথমে এ জন্যে এক সভার আয়োজন করেন৷ ঐ সভায় তিনি তিনশ মুহাজির ও আনসারকে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেন৷ তাঁরা এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে সত্যের পথে একে অপরকে সাহায্য করবেন এবং এমনকি মৃত্যুর পরও তাঁরা পরস্পরের সম্পদের উত্তরাধিকারী হবেন৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁদের প্রত্যেকের হাতকে অন্য এক মুসলিম ভাইয়ের হাতের ওপর ন্যস্ত করেন৷তবে হযরত আলী (আঃ) সঙ্গী বা যুগলবিহীন থেকে যান৷ এ অবস্থায় হযরত আলী (আঃ) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, সবাইতো ভাই পেয়ে গেল, আমাকে তো কারো সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করলেন না৷ রাসূল (সাঃ) বললেন, মহান আল্লাহর শপথ ! তুমি আমার ভাই, আমার স্থলাভিষিক্ত ও আমার পরামর্শদাতা৷ তোমার সাথে আমার সম্পর্ক হারুন ও মূসার সম্পর্কের মতো, তবে পার্থক্য হল আমার পরে কোনো নবী আসবেন না৷
নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) তাঁর দূরদৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে ও ঘটনায় মুসলিম সমাজের মদ্যে বিভেদ ও অনৈক্যের বীজ বা অংকুরগুলো বিনষ্ট করে দিতেন৷ ওহদ যুদ্ধের সময় এক মুসলিম যুবক শত্রুদের সাথে লড়াই করার সময় কবিতা আবৃত্তি করে বলছিলেন, মাথা পেতে নাও এ আঘাত তরবারির এ আঘাত আরব যুবকের বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ঐ মুসলিম যুবককে বললেন, বল, আমি আনসার যুবকদের অন্যতম৷ এভাবে বিশ্ব মানবতার নবী (সাঃ) যুদ্ধের ময়দানেও গোত্রবাদ তথা জাতিভেদ বা জাতিপূজার ধারণা প্রতিহত করতেন এবং খোদাভীতি ও সৎকর্মকেই শ্রেষ্ঠত্ব বা গৌরবের মানদন্ড মনে করতেন৷
ইসলাম ধর্ম গোটা আরবে ছড়িয়ে পড়লে আবু আমের নামের এক ইহুদির গাত্রদাহ অসহনীয় হয়ে ওঠে৷ সে ইসলামের বিস্তারে বাধা সৃষ্টি এবং ইসলামী ঐক্যে ফাটল ধরানোর দূরাশা নিয়ে আওস ও খাজরাজ গোত্রের মোনাফেকদের সাথে আন্তরিক সহযোগিতা শুরু করে৷ সে এক চিঠিতে তার মোনাফেক বন্ধুদের কাছে লিখেছিল, কোবা গ্রামে মুসলমানদের মসজিদের পাশে আরেকটি মসজিদ নির্মাণ কর এবং নামাজের সময় এই নতুন মসজিদে সমবেত হও যাতে মুসলমানদের নৈতিক মনোবল হ্রাস পায়৷ এই মসজিদে ফরজ এবাদত-বন্দেগীর অজুহাতে ইসলামকে পরাজিত করার ব্যাপারে শলা-পরামর্শ করবে৷
বিশ্বনবী (সাঃ) তাবুক সফরের উদ্দেশ্যে রওনা হলে মোনাফেকদের প্রতিনিধিদল তাঁর কাছে এসে বললো, বৃষ্টিভেজা রাতে বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিরা ঘর থেকে কোবা মসজিদে পৌঁছতে সক্ষম নন৷ তাই মহল্লার ভেতরেই মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দিবেন কি? রাসূল (সাঃ) বেশ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেন এবং কিছুই বললেন না৷ তারা আবারও এ বিষয়ে মহানবী(সাঃ)'র মত জানতে চাইলে তিনি সফর থেকে ফিরে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান৷ কিন্তু মোনাফেকরা রাসূল (সাঃ)'র অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে মসজিদের নামে ইসলাম বিরোধী তৎপরতার ঐ আস্তানা গড়ে তোলে৷ বিশ্বনবী (সাঃ) সফর থেকে ফিরে আসলে মোনাফেকরা তাঁর কাছে ধর্ণা দিয়ে বলে যে আল্লাহর রাসূল(সাঃ) যেন সেখানে কয়েক রাকাত নামাজ পড়ে তথাকথিত ঐ মসজিদ উদ্বোধন করেন৷ এ অবস্থায় আল্লাহ ওহী নাজিল করে ঐ আস্তানাকে মসজিদে জেরার বা ক্ষতিকারক মসজিদ নামে অভিহিত করে শত্রুদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন৷ সুরা তওবার ১০৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ংভী
যারা মুসলমানদের ক্ষতি সাধন, সত্য প্রত্যাখ্যান, বিশ্বাসীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং অতীতে আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, তারাই নিজের গোপন ঘাঁটি হিসেবে এ মসজিদ নির্মাণ করেছে৷ অবশ্য তারা শপথ করে বলবে যে আমরা সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এ মসজিদ নির্মাণ করেছি, কিন্তু আল্লাহ স্বাক্ষ্য দিচেছন যে, ওরা মিথ্যাবাদী৷
এ আয়াত নাজিল হবার পর নূরনবী (সাঃ) তথাকথিত ঐ মসজিদ বা মোনাফেকদের আস্তানাটি ধবংস করে দেন৷ জেরার মসজিদ ধবংসের ফলে মুসলিম সমাজে রাজনৈতিক অনৈক্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল৷ এ ছাড়াও মুসলমানদের ঐক্য ধরে রাখার জন্যে বিশ্বনবী (সাঃ) বিভিন্ন ধরনের শির্ক ও মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে চিন্তাগত বা ধর্মীয় সংলাপ ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন৷ তিনি একত্ববাদ বা এক আল্লাহর এবাদতকে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)'র ধর্ম বা দ্বীনে হানিফ হিসেবে অভিহিত করেন এবং তৌহিদ বা একত্ববাদের চেতনাকে সমাজে বিস্তৃত করেন৷ একদিকে নূরনবী (সাঃ)'র প্রচেষ্টা ও অন্যদিকে পবিত্র কোরআনের সুন্দর বাণী মানুষের মধ্যে ঐক্যের চেতনা জোরদার করেছে৷ বিশ্বনবী (সাঃ)'র আকর্ষণীয় আচার ব্যবহার মুসলমানদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করতো এবং অমুসলমানরাও তাতে প্রভাবিত হত৷
একবার যাইদ নামের এক ইহুদি পন্ডিত রাসূল (সাঃ)'র কাছ থেকে কিছু পাওনা আদায় করার জন্যে তাঁর জামা ধরে অত্যন্ত রুক্ষভাবে বললো, তোমরা আবদুল মোত্তালেবের সন্তানরা ঋণ শোধ করতে দেরী করে থাক৷ বিশ্বনবী (সাঃ)'র একজন সাহাবী অত্যন্ত উচ্চ স্বরে ঐ ইহুদি পন্ডিতের এ আচরণের প্রতিবাদ জানায়৷ কিন্তু রাসূল(সাঃ) মুচকি হেসে বললেন, আমার আর তার অন্য কোনো কথা বা আচরণ৷ আমাকে বল যে, আমি যেন সুবিবেচক হই, আর তাকে বল, কোমল আচরণের মাধ্যমে পাওনা দাবী কর৷ এরপর তিনি ইহুদি পন্ডিতকে বললেন, চুক্তি অনুযায়ী এখনও তোমার পাওনা ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে তিন দিন সময় বাকী আছে৷ এরপর রাসূল (সাঃ) তাঁর সাহাবীকে বললেন, তার পাওনা ফিরিয়ে দাও, যেহেতু সে তার পাওনা আদায়ের ব্যাপারে চিন্তিত ছিল সে জন্যে পাওনার চেয়েও তাকে কিছু বেশী দিয়ে দাও৷ মহানবী (সাঃ)'র এ রকম উন্নত ও পরিমার্জিত আচরণের ফলে ঐ ইহুদি পন্ডিত মুসলমান হয়ে যান৷
ঐক্য সৃষ্টি জগতের জন্যে অপরিহার্য ও অমূল্য এক সম্পদ৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) পবিত্র কোরআনের বাণীর আলোকে মুসলমানদেরকে আল্লাহর দাসত্বের মাধ্যমে খোদায়ী রশি দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরার দাওয়াত দিতেন৷ আর মুসলমানরাও বিশ্বনবী (সাঃ)'র উপদেশ অনুযায়ী কাজ করে কয়েক শতকের মধ্যেই জ্ঞান, সভ্যতা ও অগ্রগতির পতাকাবাহী হয়েছিল৷ আসলে নূরনবী (সাঃ)'র নিজেই যুগে যুগে মুসলমানদের জন্যে ঐক্যের মাধ্যম হয়ে আছেন৷ বর্তমানেও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সমস্ত মুসলমানের জন্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও ঐক্যের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে বিরাজ করছেন৷ মহান আল্লাহ নূরনবী ও তাঁর পবিত্র বংশধারার ওপর অশেষ দরুদ ও শান্তি বর্ষিত করুন৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন