নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩০ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩০ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩০ তম পর্ব

রাসূলে খোদা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মানবজাতির জন্যে চিরকাঙ্ক্ষিত বা শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র-ব্যবস্থার এক অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন৷ তাঁর প্রবর্তিত আদর্শ রাষ্ট্রের দিক বা বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল অভূতপূর্ব৷ তাঁরই প্রতিষ্ঠিত এ রাষ্ট্রে বিশ্বনবী (সাঃ) কখনও পদ, খ্যাতি ও ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করেন নি৷ রাষ্ট্রের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার এবং সব জাতি ও গোত্রের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর লক্ষ্য৷ তিনি চেয়েছিলেন এমন এক রাষ্ট্র কায়েম করতে যেখানে মানুষ এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব বা এবাদত করবে না ও মহান আল্লাহর মহত্ত্ব কিংবা প্রশংসাসহ কোনো ক্ষেত্রেই কাউকে তাঁর শরীক করবে না৷
ইসলামের প্রথম দিকের একজন মুমিন রাসূলে খোদা (সাঃ)'র কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আমায় সহায়তা করুন৷ রাসূল (সাঃ) বললেন, কি ব্যাপার? ঐ মুমিন বললেন, মদীনায় ব্যবসা করতে-আসা একদল বনিক আমার সন্তানদের সাথে চলাফেরা করে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে ফেলেছে৷ আমি বহু চেষ্টা করেও তাদেরকে ইসলাম ধর্মের দিকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছি৷ আপনি তাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার নির্দেশ দিন৷ সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পবিত্র চোখ দুটিতে দুশ্চিন্তার সামান্য রেশও দেখা গেল না৷ তিনি অত্যন্ত শান্ত ও নম্রভাবে বললেন, ুশান্ত হও৷ তুমি কি জাননা আমাদের ধর্ম গ্রহণে জোরজবরদস্তির কোনো সুযোগ নেই? ইসলাম ধর্ম মুক্তির ও বিভ্রান্তির পথ কি তা স্পষ্ট করে দিয়েছে৷ যারা মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এনেছে তারাই শক্ত রশি আকড়ে ধরেছে৷" এভাবে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী বিশ্বনবী (সাঃ) বাস্তবে দেখিয়ে গেছেন, ইসলাম যুক্তি ও বিবেকের ধর্ম, অন্ধ-বিশ্বাস বা জোরজবরদস্তির ধর্ম নয়৷
মহানবী (সাঃ) তাঁর প্রবর্তিত রাষ্ট্রে আইনের শাসন ও জন-শৃঙখলাকে এত গভীরভাবে কায়েম করেছিলেন যে তাঁর ওফাতের পরও ইসলাম ধর্ম বিস্তৃত হতে থাকে এবং মুসলমানদের গৌরবময় বিজয় অব্যাহত থাকে৷ এভাবেই ইসলাম বিশ্বের বুকে স্থায়ীত্ব অর্জন করে৷ আর এই ইসলামী জাহানের সব কিছুর মূল বিষয় বা ভিত্তি ছিল বিশ্বাস তথা ঈমান, মানব-প্রেম বা ভালবাসা এবং সচেতনভাবে মত বা পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা৷ ইসলামের আবির্ভাব ও বিস্তৃতির ফলে বিভিন্ন জাতি ও গোত্র নিজ অবস্থান বা মর্যাদা হারিয়ে ফেলার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে৷ রাসূল (সাঃ) প্রবর্তিত মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে বিভিন্ন গোত্র বা জাতির অধিকার ও তাদের জাতির মর্যাদা নির্ধারণের কথা উঠেছিল৷ বিশ্বনবী (সাঃ) মদীনার সব জাতি ও গোত্রের সাথে চুক্তি বা সমঝোতায় এ বিষয়টি স্পষ্ট করেন এবং মদীনার সব জাতি ও গোত্র নিয়ে একটি মাত্র উম্মাহ বা নতুন জাতি গঠন করেন৷ এভাবে একক বা অভিন্ন জাতি গঠিত হওয়ায় জাতি বা গোত্রগুলোর সমস্ত দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের অবসান ঘটে৷
বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের সাথে বিশ্বনবী (সাঃ)'র সমঝোতা বা চুক্তিপত্রের সূচনাতেই লেখা হয়েছিলঃ বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম ৷ অর্থাৎ পরম করুণাময় ও অনন্ত দাতা মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি৷ মুহাম্মদের পক্ষ থেকে এই লিখিত চুক্তি করা হয়েছে কুরাইশ ও মদীনার মুমিন ও মুসলমান এবং তাদের সাথে জড়িত বা তাদের অনুসারী সবার জন্যে৷ আর এই সবাই-ই একটি মাত্র জাতি বা একক উম্মাহর অংশ ৷" বনি নায্‌যার ও বনি আউফ নামের দুটি ইহুদি গোত্র এবং বনি সায়েদেহ, বনি হারেস ও অন্য আরো কয়েকটি গোত্রকে এই মহাচুক্তিতে এক জাতি হিসেবে ধরা হয়েছিল৷ ঐতিহাসিক ও নজিরবিহীন ঐ মহাচুক্তিতে বলা হয়েছিল যে এই এক জাতির মধ্যে মুসলমান ও ইহুদিরা নিজ নিজ ধর্মে বহাল থাকবে৷ মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে সবাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ছিল এবং কেউই ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করেনি ৷ বিশ্বনবী (সাঃ) নিজে এই নতুন জাতির সমস্ত গোত্রের অধিকার রক্ষার জন্যে নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করতেন৷
বিশ্বনবী (সাঃ)'র যুগের অনেক লিখিত দলিল ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে৷ এসবের মধ্যে রয়েছে চুক্তিপত্র, বিভিন্ন গোত্রের প্রধানের কাছ ইসলামের আহবান সংক্রান্ত চিঠি, রাষ্ট্রীয় ফরমান প্রভৃতি৷ এসব দলীলপত্র থেকে রাসূল (সাঃ)'র যুগের রাজনৈতিক চরিত্রের চিত্র পুরোপুরি ফুটে উঠে৷ বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ও আইনগত বিষয়েও বিশ্বনবী (সাঃ)র সঠিক বা নির্ভুল অবস্থানগুলো এসব দলীল পত্র থেকে ফুটে উঠেছে৷ অন্য কথায় এটা বলা যায় যে বিশ্বনবী (সাঃ)ই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ও এমনকি পরাজিত গোত্রগুলোরও অধিকার রক্ষার জন্যে সচেষ্ট এবং তিনি জনস্বার্থকে সব কিছুর চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন৷ বিশ্বনবী (সাঃ) হেজাজ ও ইয়েমেনের সীমান্তে অবস্থিত নাজরানের ৭০ টি গ্রামের খৃষ্টান সম্প্রদায়ের সাথে যে চুক্তি করেছিলেন তা তাঁর ন্যায় বিচারের এক স্পষ্ট নিদর্শন৷ এ চুক্তি অনুযায়ী রাসূল (সাঃ) নাজরানের অধিবাসীদের জান ও মালের নিরাপত্তার জামিনদার হয়েছিলেন এবং তিনি তাদের মানবীয় মর্যাদা ও স্বাধীনতাকে সম্মান করতেন৷
নাজরানের খৃষ্টান প্রতিনিধি দল বিশ্বনবী (সাঃ)'র সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল৷ বিশ্বনবী (সাঃ)'র নবুওত যে সত্য তা ঐ প্রতিনিধিদলের কাছে প্রমাণিত হবার পর তারা বিতর্ক বন্ধ করে দেয় এবং তারা নিজের ফলমূল, সোনা-রুপা ও দাস-দাসী রাসূল (সাঃ)'র কাছে অর্পণ করে৷ কিন্তু তাদের সাথে বিশ্বনবী (সাঃ)'র সম্পাদিত চুক্তির প্রথম অনুচেছদে দেখা গেছে, রাসূল (সাঃ) ঐসব সোনা-রুপা, দাস-দাসী ও ফল-মূল তাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং শুধু সামান্য কিছু কর আরোপ করেছিলেন৷ এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ঐতিহাসিক ও গবেষকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে৷ চুক্তির এক অংশে লেখা আছে, নাজরানের খৃষ্টানদের যেসব পন্য ও অস্ত্র সামগ্রী ইসলামী সেনাদের কাছে আমানত হিসেবে জমা রাখা হয়েছে, সেসবের যদি কোনো ক্ষতি হয় বা সেগুলো বিনষ্ট বা ধবংস হয়ে যায়, তাহলে রাসূলে খোদা (সাঃ)'র প্রতিনিধির মাধ্যমে ঐসব জিনিষের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে বলে বিশ্বনবী (সাঃ) অঙ্গীকার করেছেন৷
একইসাথে ইসলামের নবী (সাঃ) নাজরানের খৃষ্টানদের জীবন ও তাদের বিধান বা ধর্ম রক্ষার অঙ্গীকার করেন৷ এভাবে তিনি নাজরানের খৃষ্টানদের জীবন ও ধর্মকে আল্লাহর আশ্রয় ও চুক্তি এবং রাসূলে খোদার অঙ্গীকারের আওতায় এনে তাদের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন৷ বিশ্বনবী (সাঃ) খৃষ্টানদের কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব দিতেন এবং খৃষ্টান ধর্ম যাজকদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, কোনো পাদ্রী বা খ্রীস্টান ধর্ম যাজককে তার পদ থেকে সরানো হবে না৷
প্রত্যেক দেশের নাগরিকই বেঁচে থাকার অধিকার রাখে ৷ বিশ্বনবী (সাঃ) নাজরানের খৃষ্টানদের বেঁচে থাকার অধিকার ও তাদের জীবনের নিরাপত্তার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, নাজরানের খৃষ্টানদেরকে নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে না ও তাদের কাছ থেকে একটি দেরহামও নেয়া হবে না, তাদের দেশকে পদদলিত বা পদভারে জর্জরিত করা হবে না এবং সেখানে সেনাও মোতায়েন করা হবেনা ৷
অবশ্য ইতিহাসে দেখা যায় কোনো কোনো গোত্র বিশ্বনবী (সাঃ)'র সাথে চুক্তি করার পর তা লংঘন করেছিল৷ এই গোত্রগুলো বদর ও ওহদের যুদ্ধের সময় বিশ্বনবী (সাঃ)'র শত্রুদের সাথে সহযোগীতা করে চুক্তি লংঘন করে৷ তাই রাসূলে খোদা(সাঃ)ও এই গোত্রগুলোকে মদীনা থেকে বের করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন৷
ইরানের শিরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মোঃ মাহদী জাফরী বলেছেন, বিশ্বনবী (সাঃ)'র চুক্তিগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে সেগুলো মুসলিম বিশ্বের অধিকার সংক্রান্ত বিধান প্রনয়নের সমৃদ্ধ উৎস এবং বর্তমান বিশ্বের আন্তর্জাতিক আইন সংস্কারেরও মানদন্ড হতে পারে৷ ডঃ মাহদী জাফরী আরো বলেছেন, মহানবী (সাঃ) ইহুদি গোত্রগুলোসহ অন্যান্য গোত্রের সাথে সংঘাতে লিপ্ত না হবার জন্যে চুক্তি স্বাক্ষর করায় বিভিন্ন গোত্র বা গোষ্ঠী পরস্পর শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করতে পেরেছে৷ এসব চুক্তি ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে প্রতিরক্ষামূলক জোট গঠনের সমতুল্য৷ এইসব চুক্তিতে কথা ছিল কোনো সংখ্যালঘু গোত্র যদি হামলার সম্মুখীন হয় তাহলে মুসলমানরা তার সাহায্য করতে এবং মুসলমানরা যদি আক্রান্ত হয় তাহলে সংখ্যালঘু অমুসলিমরা মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে৷ আসলে বিশ্বনবী (সাঃ) এসব চুক্তির মাধ্যমে খৃষ্টান ও ইহুদিদের নাগরিক-অধিকারগুলো সংরক্ষণ করেছেন এবং তাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রের সাহায্যের আওতাভুক্ত করেছেন৷ এই চুক্তিগুলোর আওতায় মদীনার বিভিন্ন গোত্র নিজ দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি স্বাধীন ছিল৷ অবশ্য শুধু এসব গোত্রের মধ্যে প্রচলতি কোনো কোনো সাধারণ রীতি- যেমন, প্রকাশ্যে মদপান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমানরা খোমস ও যাকাত এবং ইহুদিরা জিজিয়া কর দিত৷ জিজিয়া কর নামের বার্ষিক কর অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের যাকাত ও খোমসের চেয়েও কম হতো৷ ধর্মযাজক, ৬০ বছর ও তদূধর্ব বয়সের ব্যক্তি, অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক বালিকা এবং দরিদ্ররা ছিল করের আওতামুক্ত৷ " এভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর উন্নত মূল্যবোধ ও রুচিবোধের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে এমন এক আদর্শ রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত পেশ করেছিলেন যেখানে নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার সমাজের সংখ্যালঘুসহ সবার জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ তাই বলা যায় বিশ্বনবী (সাঃ) আকাশতুল্য উদারতা ও স্বর্গীয় মহত্ত্ব দিয়ে মানুষের অন্তরের অন্তস্থলে ভালবাসার স্থায়ী আসন পেয়েছেন৷ আর এটাই যুগে যুগে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে খুব দ্রুত গতিতে ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে পড়ার মূল রহস্য৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন