নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৩ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৩ তম পর্ব

 

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২৩ তম পর্ব


"কে আহমাদ ?
বিশ্বের নূর , নক্ষত্রের আলোর উত্সা
চাঁদ-সূর্য,গ্রহ-তারা সকল কিছুই
সেজদাবনত হয়ে আলোকিত তাঁরই আলোয়৷"

সুপ্রিয় পাঠক! আজ আমরা রাসূলের ( সা ) স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন সম্পর্কে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো ৷
ফ্রান্সের বিশিষ্ট দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী মিশেল ফুকোর মতে,যুগে যুগে শক্তিশালী ও দক্ষ দলগুলো সবসময়ই অন্যদের সাথে যুদ্ধ করে করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও আত্মপরিচয় অর্জন করেছে৷ তারা অন্যদেরকে অবাঞ্ছিত ও নিন্দনীয় গুণাবলীর সিম্বল বা প্রতীক বলে মনে করতো এবং নিজেদেরকে মনে করতো পরিপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শস্থানীয়৷ ফিলিস্তিনী দার্শনিক এডওয়ার্ড সাইদও ফুকোর দৃষ্টিভঙ্গির মতোই নিজস্ব মতামত দিয়ে বলেছেন রেনেসাঁসের পর পাশ্চাত্য অন্ধকার ও মূর্খতার প্রতীক হিসেবে মনে করে প্রাচ্যকে, আর পক্ষান্তরে নিজেদেরকে মনে করে তার বিপরীত৷ এই বিপরীত পরিচয়ের সুবাদে নিজেরা এক ধরনের পরিচয় অর্জন করে৷
এই চিন্তাবিদদের মতে শক্তিশালী দলগুলো দুর্বলদেরকে অবজ্ঞা করার মধ্য দিয়ে চেষ্টা করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে৷ তবে এই বিষয়টি নবী-রাসূলদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইসলামের নবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়৷ হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) যখন নবুয়্যতি লাভ করেন,তখন তিনি নিজস্ব মর্যাদা ও বড়োত্বের কারণে অন্যদেরকে মোটেই অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টি কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেন নি ৷ এ কারণেই তিনি অতি দ্রুত মহান ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন৷ এটা ছিল রাসূলের গণসংযোগ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা পদ্ধতি৷ তিনি ধনী-গরীব,সাদা-কালো,দুর্বল-সবল নির্বিশেষে সবার সাথেই সমানভাবে মিশতেন এবং সবাইকে সমানভাবে গ্রহণ করতেন ৷ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পরেও তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন অন্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ৷ সেইসাথে প্রাণসঞ্চারী আল্লাহর মহান বার্তা তাদের দেহমনকে যেন উজ্জীবিত করে তোলে,সেই প্রচেষ্টাও চালাতেন৷ এইসব গুণাবলীর কারণেই নবীজী অন্যদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন৷
রাসুলে খোদার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং পরিপাট্যও মানুষকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করতো৷ বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে,আল্লাহ সৌন্দর্য পছন্দ করেন৷ নবীজী তাই আল্লাহর চমত্কাৃর সব নিয়ামতকে প্রদর্শন করানোর জন্যে মানুষকে বিশ্বের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট করাতে চেয়েছেন৷ তিনি সমাজের পছন্দনীয় একটি ঐতিহ্য 'বাহ্যিক সাজসজ্জা'কে একটা উত্তম গুণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায় বলে মত দিলেন৷ ইসলাম হচ্ছে একটা পরিচ্ছন্নত বা পবিত্রতার ধর্ম৷ এই ধর্ম ইসলামের অনুসারীদের সুসংবাদ দিচ্ছে যে,বেহেশতে যারা যাবে তারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন৷ রাসূল ( সা ) পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন৷ তিনি বলেছেনঃ 'যে-কোনোভাবেই হোক,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা উচিত৷ কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরিচ্ছন্নতার ভিত্তির ওপর ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন৷'
রাসূলে খোদা ( সা ) ছোটোবেলা থেকেই মক্কা শহরের শিশুদের বিপরীতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি ছিলেন৷ তিনি কৈশোর এবং যৌবনে চুলগুলোকে সুন্দরভাবে আঁচড়িয়ে রাখতেন৷ নবুয়্যতি লাভ করার পরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তাঁর সুনাম ছিল৷ জামাকাপড়ে তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন নিয়মিত৷ ঘরের মধ্যে এক বাটি পানিকে তিনি আয়না হিসেবে ব্যবহার করতেন৷ ঐ পানির আয়নাতেই তিনি চেহারা দেখতেন৷ একদিন নবীজীর ঘরে এক ব্যক্তি এলেন তাঁর সাথে দেখা করতে৷ তো যখন নবীজী ঐ দর্শনাথীর্র সাথে দেখা করতে আসবেন তখন তিনি বড়ো একটা পানির পাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে চেহারা এবং চুলগুলোকে সুন্দর করে আঁচড়ে নিলেন৷ হযরত আয়েশা ( সা ) আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,'ঐ লোকটার সাথে দেখা করার জন্যে এভাবে সাজগোজ করলেন কেন?' মুহাম্মাদ ( সা ) তাঁর কথার জবাবে বললেন,'যখন কোনো মুসলমান তাঁর কোনো ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যায়,তখন সেজেগুজে যাওয়াকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পছন্দ করেন৷'
মানুষের প্রতি রাসূলে খোদার যেসব বাণী বা নির্দেশনা ছিল, সেগুলোর সবই ছিল সুস্থ সুন্দর জীবনযাপনের স্বার্থে৷ ইবনে আব্বাস বলেছেন,'রাসূল ( সা ) এমন দৃঢ়তা ও আনন্দের সাথে পথ চলতেন যে,তাঁর মধ্যে কোনোরকম অসুস্থতা বা আলস্য পরিলক্ষিত হতো না৷' তিনি অত্যন্ত সাদামাটা এবং অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন , তারপরও যখন সফরে যেতেন তখন চিরুনি, আতর এবং সুরমাদানী সাথে নিয়ে যেতেন৷ প্রতিদিন বেশ কয়েকবার দাঁত মাজতেন৷ অন্যদেরকেও অজু করার আগে দাঁত মাজতে উত্সাাহিত করতেন৷ তিনি বলেছেন,'জিব্রাঈল ( আ ) আমাকে মেসওয়াক করা অর্থাত্‍ দাঁত মাজার ব্যাপারে এতো বেশি বেশি বলেছেন যে,মনে হয়েছিল মেসওয়াক করাটা হয়তো ওয়াজিবই করে দেওয়া হতে পারে৷' ইমাম সাদেক ( আ ) বলেছেন,'রাসূলের একটা মেশ্কদানী ছিল,ওজু করার পরপরই তিনি ঐ মেশ্কদানী হাতে নিতেন এবং সুগন্ধি মাখতেন৷ এ কারণেই তিনি যখন ঘর থেকে বের হতেন সারারাস্তা সুগন্ধিতে মৌ মৌ করতো৷ সুগন্ধির ব্যাপারে নবীজীর আগ্রহ এতোবেশি ছিল যে, ইতিহাসবিদগণ বলেন,তাঁর খাওয়া খরচের চেয়ে আতরের খরচ ছিল বেশি৷'
পোশাক তথা জামা-কাপড়ের পছন্দনীয় ডিজাইনের ব্যাপারে মানুষের চিরন্তন একটা কৌতূহল রয়েছে৷ সেইসাথে জামার রং , কাপড়ের ধরন , এবং কাপড়ের স্টাইল প্রভৃতি দেখে মানুষ পোশাক পছন্দ করে যাতে দেখতে সুন্দর লাগে৷ কিন্তু রাসূলে খোদা ( সা ) অত্যন্ত সাদামাটা পোশাক পরতেন৷ যদিও সবসময় নতুন জামা তাঁর গায়ে ছিল না,তারপরও সর্বাবস্থায় সেগুলো ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন৷ তিনি জামা পরার সময় সর্বদাই বলতেন-'আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই,তিনি আমাকে জামা-কাপড় পরিয়েছেন যাতে আমার সৌন্দর্য রক্ষিত হয়৷'
নবীজীর সঙ্গী-সাথী এবং আশেপাশের লোকজন রাসূলের পূত-পবিত্রতা এবং সুস্থ সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন দেখে ভীষণ উত্ফুোল্ল হতো,উদ্বুদ্ধ হতো ৷ গরমের সময় রাসূলে খোদা ( সা ) তাঁর জামাগুলোকে পাতিলের ভেতর গরম পানিতে ফুটিয়ে নিয়ে ধুয়ে নিতেন ৷ তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকেও বলতেন তারা যেন তাদের জামা-কাপড় পরিষ্কার করে রাখে ৷ রাসূল ( সা ) সাদা এবং সবুজ জামা পরতে পছন্দ করতেন ৷ তিনি বলতেন উজ্জ্বল রং দূষণকে সহজেই পরিস্ফুটিত করে৷ নবীজীর দৃষ্টিতে পরিচ্ছন্নতা হলো একটি মৌলিক বিষয়৷ কেবল ব্যক্তিগত সুস্থতার জন্যেই নয় বরং সামষ্টিক সুস্থতার জন্যেও পরিচ্ছন্নতা খুব জরুরী৷ একদিন নবীজী দেখতে পেলেন এক লোক মসজিদের এক কোণের কিছুটা জায়গা ময়লা করে ফেলেছে ৷ তিনি অনতিবিলম্বে জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেললেন ৷
রাসূলে খোদা কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যের কথাই বলতেন না, বরং তিনি জনগণকে চেহারার সৌন্দর্যের পাশাপাশি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের কথাও বলতেন ৷ তিনি চাইতেন মানুষ যেন তাকওয়া-পরহেজগারীর সৌন্দর্য দিয়ে নিজেদের ভেতরটা অলংকৃত করে৷ এভাবে তিনি নৈতিকতা ও সামগ্রিক শৃঙ্খলা বিধানের মাধ্যমে মদীনার ছোট্ট একটি সমাজে একটা শৃঙ্খলাবোধ , একটা সৌন্দর্যবোধ চালু করেন৷ নবীজীর একজন বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর বলেছেন , 'আমি নবীজীর চেয়ে দয়ালু , সহযোগী , বীরত্বপূর্ণ , বুদ্ধিদীপ্ত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর কোনো ব্যক্তিকে দেখি নি৷'
অমুসলিম চিন্তাবিদরাও নজীরবিহীন এই ব্যক্তিত্বের গুণাবলীগুলো পর্যালোচনা করেছেন৷ ব্রিটিশ চিন্তাবিদ জন ডিউন পোর্ট বলেছেন-পবিত্রতা এবং সৌন্দর্যের দিক থেকে মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী৷ তিনি যখন কথা বলতে শুরু করতেন , তখন শ্রোতা বা শ্রোতাবৃন্দ তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়ে যেতেন , সবাই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতো৷ তাঁর বাচনভঙ্গী , তাঁর মৃদু হাসিমুখ ,তাঁর অসম্ভব দুরীদর্শী বক্তব্যে সবাইকে বিমোহিত হয়ে যেত৷ তিনি যেমন চিন্তার দিক থেকে ছিলেন প্রাগ্রসর তেমনি ছিলেন বাস্তব কাজ-কর্মেও শক্তিমত্তার অধিকারী৷
ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক দেইসুনও বলেছেন , হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) এর বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং চারিত্র্যিক সৌন্দর্য এতোটাই দৃষ্টিগ্রাহ্য ছিল যে,তিনি যখন কাউকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন,তখন তাঁর ব্যবহার কিংবা নৈতিকতার ব্যাপারে কারো মনেই কোনোরকম প্রশ্ন জাগতো না৷ তিনি যেমন ছিলেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তেমনি ছিলেন সত্‍ এবং সলাজ৷ কোনো বিষয় যদি তাঁর পছন্দ না হতো,তাহলে তা তাঁর চেহারা মোবারকে ফুটে উঠতো৷ তাঁর সাহাবীগণ নবীজীর চেহারা দেখেই তা বুঝতে পারতেন৷ সবসময় মৃদুহাস্য ছিলেন৷ সেজেগুজে থাকতেন৷ কেউ আমন্ত্রণ জানালে কবুল করতেন ,আবার কেউ কোনো কিছু উপহার দিলেও গ্রহণ করতেন৷ সত্যের মানদণ্ডে তিনি সবাইকে সমান চোখে দেখতেন৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন