নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২২ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২২ তম পর্ব

নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ২২ তম পর্ব

সত্যিকার নবী-রাসূলদের চেনার একটা উৎকৃষ্ট উপায় হলো তাঁদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা করা। ইসলামের অগ্রগতির একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণই হলো নবীজীর বন্ধুত্বপূর্ণ বক্তব্য আর তাঁর চারিত্র্যিক অসাধারণ গুণাবলী। পবিত্র কোরআনে রাসূলে খোদার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সম্পর্কে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে ‘খুলুকিন আজীম' বা সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী,মেহেরবান,‘রাউফ' বা ‘উসওয়াতুন হাসানাহ' অর্থাৎ সবচে সুন্দর আদর্শের অধিকারী বলে ঘোষণা করেছেন। সূরা আল-ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
"তারপর আল্লাহর করুণার ফলেই তুমি তাদের প্রতি কোমল হয়েছিলে। আর যদি তুমি রুক্ষ ও কঠোর-হৃদয় হতে তবে নিঃসন্দেহে তারা তোমার চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। অতএব তাদের অপরাধ মার্জনা করো,আর তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আর তাদের সঙ্গে কাজেকর্মে পরামর্শ করো। আর যখন সংকল্প গ্রহণ করেছো তখন আল্লাহর ওপর নির্ভর করো। নিঃসন্দেহে আল্লাহ নির্ভরশীলদের ভালোবাসেন।"
এ আয়াত থেকে অনুমান করা যায় যে , চারিত্র্যিক সততা ও মাধুর্য আল্লাহর একটা বিশেষ অনুগ্রহ। শক্ত বা কঠিন হৃদয়ের মানুষেরা জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারে না কিংবা তাদের হেদায়াত করার ক্ষেত্রে সফলকাম হয় না। মানুষের সাথে সদয় আচরণ করা নেতৃত্বের আসন দৃঢ় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রাসূলে কারীম ( সা ) মানুষের সাথে বন্ধুত্বকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর সর্বোত্তম কাজ বলে মনে করতেন। তিনি বলেছেন,‘মানুষের সাথে যে ব্যক্তির মেলামেশা বেশি,সে-ই সবার চেয়ে বুদ্ধিমান।' নবীজীর দৃষ্টিতে উত্তম চরিত্র হলো এমন একটা পুঁজির মতো,যার কোনো সময় কিংবা স্থানগত সীমাবদ্ধতা নেই। সর্বাবস্থায় অন্যদের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা যায়। রাসূল ( সা ) যখন মুশরিকদেরকে সত্য দ্বীন তথা ইসলামের দিকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন,তখন তিনি তাদেরকে বললেন ‘আমি তোমাদের জন্য রহমত হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছি। যে-ই অন্যদের প্রতি সদয় হবে,আল্লাহও তার প্রতি সদয় হবেন।' নবীজী ছিলেন মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। মানুষের দুঃখ-কষ্টকে নিজের দুঃখ-কষ্ট বলে মনে করতেন। মানুষের কষ্টে তিনি ব্যথিত হতেন। নবীজীর এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সূরা তাওবার ১২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘এখন তো তোমাদের কাছে একজন রাসূল এসেছেন তোমাদেরই মধ্য থেকে , তাঁর পক্ষে এটি দুঃসহ যা তোমাদের কষ্ট দেয়,তোমাদের জন্যে তিনি পরম কল্যাণকামী,বিশ্বাসীদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র,বিশেষ কৃপাময়।'
নবীজী সম্পর্কে হযরত আলী ( আ ) এর অত্যন- মেধাবী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তিনি বলেন , তাঁকেই দক্ষ ডাক্তার বলা হয় , যিনি সহৃদয় মহানুভবতার সাথে নিজেই রোগীদের কাছে চলে যান। যদিও স্বাভাবিক নিয়ম হলো কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে অসুস্থ বলে মনে করেন ,তখন তিনি নিজেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। হযরত আলী ( আ ) এ সম্পর্কে বলেন : ‘নবীজী হলেন এমন এক ডাক্তার , যিনি রোগীদের চিকিৎসার জন্যে তাদের খুঁজে বেড়াতেন। তাঁর নিরাময়কামী দাওয়া অন্ধ-বধিরদের সুস্থতার জন্যে ছিল সদাপ্রস্তুত। এখানে অন্ধ বলতে বোঝানো হচ্ছে তাদেরকে যারা সত্যকে উপলব্ধি করতো না , দেখেও না দেখার ভান করতো,আর বধির বলতে বোঝানো হচ্ছে তাদেরকে যারা সত্যের বার্তাকে কানে তুলতো না।'
কোনো সমাজের সাংস্কৃতিক কুসংস্কার,বোধ ও বিশ্বাসগত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কেউ যখন সংস্কারকাজ চালান , তখন তাঁর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে বিচিত্র রকমের অভিযোগ ও অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। এখন সংস্কারক যদি ঐসব অন্যায় অভিযোগের জবাব দিতে যান তাহলে তিনি কঠিন বাধার সম্মুখিন হয়ে পড়বেন। তাই যথার্থ কাজ হলো অশোভন কোনো পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে সন্ধিচুক্তি স্থাপন করা , অথবা তা এড়িয়ে যাওয়া কিংবা প্রতিপক্ষকে পরিত্যাগ করা। কোরআনেও এ ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে পরামর্শ দিয়েছেন যাতে মুশরিকদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও পদক্ষেপ সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো না হয়। মুশরিকরা অনেক সময় নবীজীকে বিরক্ত করার জন্যে মসজিদুল হারামে বসে কোরআনের আয়াতকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের সুরে আবৃত্তি করতো।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তখন নবীজীকে বলেছেন তাদের কথায়-কাজে কর্ণপাত না করে তাদেরকে পরিত্যাগ করতে। সূরা আরাফের ১৯৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলের কর্মপন্থা নির্ধারনের তিনটি উপায় বাতলে দিয়েছেন। এ্যাক , ক্ষমাশীল এবং সদয় হওয়া। দুই , মানুষকে ন্যায়ের পথে আহ্বান জানানো। এবং তিন ,অশিক্ষিত মূর্খদের মোকাবেলায় ধৈর্য ধারণ করা এবং তাদের আচরণ উপেক্ষা করে চলা।
বলাবাহুল্য , রাসূলের এই কর্মকৌশল বিশেষ করে তাঁর এই নম্রতা ও চারিত্র্যিক সৌন্দর্যের কারণে বহু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। বিরোধীদের অন্যায় ও অসম্মানজনক আচরণ তিনি এড়িয়ে যেতেন। তবে কেউ যদি আল্লাহর ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করতো কিংবা আল্লাহর বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করতো,তাহলে তিনি ছাড়তেন না। ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনোরকম আপোষ বা শৈথিল্য প্রদর্শন করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন,ন্যায়-নীতির প্রতিষ্ঠাই হলো সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি। নবীজীবনের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো তাঁর চারিত্র্যিক সারল্য ও আচরণগত সহজতার কারণে ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা কিংবা আধ্যাত্মিক মহিমা বিন্দুমাত্রও হ্রাস পায় নি।
রাসূলে খোদার সাথে জনগণের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাঁর স্বাভাবিক বিনয় ও ভদ্রতা। তাঁর সৌজন্যবোধ এবং বিনয় এতো বেশি ছিল যে তিনি কী ফকির আর কী ধনী-সবার সাথেই তিনি সমানভাবে সদয় ও বিনয়ী আচরণ করতেন। তিনি এমনকি বাচ্চাদের সামনে গিয়ে তাদেরকে সালাম দিতেন। তিনি যে মজলিসেই যেতেন অন্যদেরকে তাঁর সামনে উঠে দাঁড়াতে অনুমতি দিতেন না। তাঁর এই বদান্যতা সম্পর্কে হযরত আলী ( আ ) বলেছেন-"অন্যদের সাথে রাসূলে খোদার ব্যবহার ছিল নম্র, সহাস্য এবং প্রশান্ত। কেউ তাঁর কাছ থেকে নিরাশ হতো না। নবীজী তিনটি জিনিস ত্যাগ করেছিলেন। এক , কথাবার্তা বলার সময় বিতর্ক বা ঝগড়া করা, দুই , বাচালতা এবং তিন , যে কাজের সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই সেকাজে হস্তক্ষেপ করা।"
রাসূলের ( সা ) বাস্তব জীবনে তাঁর চারিত্র্যিক সৌন্দর্যের হাজার হাজার উদাহরণ দেখতে পাওয়া যাবে। এগুলো যেন তাঁর চারিত্র্যিক সৌন্দর্য-সাগরের এক-একটি বিন্দু। আলোচনার এ পর্যায়ে তাঁর জীবনের সুন্দর একটি গল্প শোনা যাক।
হিজরী নবম সালে উদ্ধত তেই গোত্র যখন মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পন করলো তখন এই গোত্রের সুপরিচিতদের একজন হাতেম তাঈয়ের পুত্র ওদাই সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার বোন সেফানাকে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে আসা হয়। একদিন এই সেফানা রাসূলের কাছে আবেদন জানালেন,‘হে মুহাম্মাদ! আমার পিতা হাতেম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমার অভিভাবক বলতে এখন আমার ভাই ওদাই। সেও এখন পলাতক। যদি সমীচীন মনে কর ,তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও। আমার মহামান্য পিতা দাসদের মুক্ত করতেন , প্রতিবেশীদের খোঁজ-খবর নিতেন , বিপদ-আপদে মানুষদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন এবং সুস্পষ্টভাবে সালাম দিতেন।'
নবীজী সেফানাকে বললেন,তুমি তোমার পিতার ব্যাপারে যেসব গুণাবলীর কথা বলেছো, সেগুলো সত্যিকারের মুমিনদের গুণাবলী। তোমার বাবা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমরা তাঁর ব্যাপারে সদয় হতাম। তারপর তিনি সেফানাকে তার বাবার চারিত্র্যক গুণাবলীর খাতিরে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কেবল তাই নয় , সেফানাকে নতুন জামা-কাপড় দেওয়ার আদেশ দিলেন এবং সিরিয়া পর্যন্ত তার যাতায়াত খরচ তাকে দিয়ে দিতে বললেন। তারপর নবীজী সেফানাকে কয়েকজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাথে সিরিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন।
ওদাই ইবনে হাতেম বললো-আমার বোনকে দেখলাম যথাযথ মর্যাদার সাথে সিরিয়ায় ফিরে এলো। আমি যেহেতু তাকে একা ফেলে রেখে পালিয়ে এসেছিলাম সেজন্যে সে আমাকে র্ভৎসনা করলো। কয়েকদিন পর আমার ঐ বুদ্ধিমতী বোনটাকে জিজ্ঞেস করলাম,ঐ লোকটাকে অর্থাৎ ইসলামের নবীকে কেমন দেখেছিস ? সেফানা বললো,খোদার শপথ ! লোকটাকে আমার অসম্ভব মর্যাদাবান বলে মনে হয়েছে। তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাটাই শ্রেয়। তাহলে মনে হবে যেন সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ এক বিশ্বের সাথে তোমার আত্মীয়তা ঘটেছে। ওদাই আরো বলেন , এর কিছুদিন পর মদীনায় গেলাম। পয়গাম্বরকে দেখার কৌতূহল হলো। তিনি মসজিদে ছিলেন। তাঁর কাছে গেলাম। সালাম দিলাম। তিনি প্রশান্তচিত্তে আমার সালামের জবাব দিলেন। পরিচয় দিলাম। তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। বাসায় যাবার পথে এক দরিদ্র বৃদ্ধাকে দেখতে পেলাম। সে কিছু বলতে চাইলো।
নবীজী সেখানে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ালেন ,বৃদ্ধার অভাব-অভিযোগের কথা শুনলেন এবং সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দিলেন। আমি মনে মনে বললাম , এই ব্যক্তি কিছুতেই বাদশাহ হতে পারে না। কারণ রাজা-বাদশাহদের নিয়ম-কানুন এরকম নয় যে , কোনো মাধ্যম ছাড়াই বা কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই তারা সরাসরি এভাবে কথা বলতে পারবে। রাসূলের ঘরে ঢোকার পর তিনি আমাকে যথাযথ সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানালেন। আমার জন্যে তিনি গালিচা বিছিয়ে দিলেন আর তিনি নিজে বসলেন মাটিতে। তিনি যে সত্যিই নবী ছিলেন,এই আচরণ থেকে তার আরেকটি প্রমাণ পেলাম। আমার জীবনের যে বিষয়টি রহস্যের মতো আবৃত ছিল , সে সম্পর্কে যখন তিনি ইঙ্গিত করলেন , তখন বুঝতে পারলাম যে,তিনি গভীর রহস্যজ্ঞানী। এইসব ঘটনা এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের ঐশ্বর্য আমাকে মুহাম্মাদের দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করলো এবং সেখানেই আমি মুসলমান হয়ে গেলাম।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন