ইতিহাসের কলঙ্ক ইবনে যিয়াদ

১৩৭৪ বছর আগে ৬১ হিজরির এ দিনে (দোসরা মহররম) কারাবালার কালজয়ী বিপ্লবের মহানায়ক হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) বিশ্বের সবচেয়ে করুণ অথচ বীরত্বপূর্ণ ঘটনার অকুস্থল কারবালায় এসে পৌঁছেন। ইসলামকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের দৃষ্টান্ত রেখে ৮ দিন পর মানবতার শত্রুদের হা

 ইতিহাসের কলঙ্ক ইবনে যিয়াদ

ইমাম হুসাইন, ইবনে জিয়াদ, কারাবালা, ইয়াজিদ, মদীনা, মক্কা

এস, এ, এ

১৩৭৪ বছর আগে ৬১ হিজরির এ দিনে (দোসরা মহররম) কারাবালার কালজয়ী বিপ্লবের মহানায়ক হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) বিশ্বের সবচেয়ে করুণ অথচ বীরত্বপূর্ণ ঘটনার অকুস্থল কারবালায় এসে পৌঁছেন। ইসলামকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের দৃষ্টান্ত রেখে ৮ দিন পর মানবতার শত্রুদের হাতে এখানেই তিনি শাহাদত বরণ করেছিলেন।

জালিম ও মহাপাপিষ্ঠ শাসক ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি মহা-বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন যাতে নানাজান বিশ্বনবী (সা.)’র ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা পায় এবং প্রকৃত ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পথ খুলে যায়। মদীনা থেকে মক্কায় গিয়ে তিনি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এরপর নিরাপত্তার কারণে এবং পবিত্র ও শান্তির নগরী মক্কায় রক্তপাত এড়ানোর জন্য তিনি হজ শেষ না করেই ইরাকের কুফার দিকে রওনা দেন।

বিশ্বনবীর নাতি ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়েছেন শুনে কুফার দোদুল-মনা লোকেরা তাঁকে ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়ার ও ইসলামী হুকুমাত কায়েমের মাধ্যমে মদ্যপ, জুয়াড়ি ও ব্যভিচারী ইয়াজিদের প্রজা হওয়ার কলঙ্ক থেকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। কুফাবাসী’র পক্ষ থেকে ১৮ হাজার চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছে এবং প্রতিটি চিঠির মধ্যে ১০০ জনের স্বাক্ষর ছিল। কিন্তু প্রয়োজনের সময় কারবালায় খুব কম লোকই তাঁকে সহায়তা দিয়েছে। ফলে ইয়াজিদের ত্রিশ হাজার সদস্যের সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় ১০০ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি বীরের মত লড়াই করে শহীদ হন। এই অসম লড়াইয়ে তাঁর পরিবারের অনেক সদস্যসহ ৭২ জন সঙ্গী শহীদ হন। (তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে কেবল পুত্র আলী ইবনুল হুসাইন বা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) অসুস্থতার কারণে বা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।)

ইমাম হুসাইন (আ.) কুফার দিকে যাচ্ছেন- গুপ্তচরদের কাছ থেকে পাওয়া এমন খবর সম্ভাব্য গণ-বিপ্লব বা গণ-জাগরণ সৃষ্টির ভয়ে ইয়াজিদ ও তার দলবলকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। ইমামের সফরের সম্ভাব্য পথ ও ততপরতা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় ছিল এইসব গুপ্তচর।

ইয়াজিদের নিয়োগ-করা কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে হোর ইবনে ইয়াজিদ রিয়াহি (রা.) নামের একজন সেনা কর্মকর্তা চিঠি লিখে এই খবর দেন যে, রাসূল (সা.)'র নাতি হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীরা কারবালায় এসেছেন। ( হোর ইমামকে বাধা দানকারী প্রথম ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও দশই মহররমের প্রাক্কালে তিনি তওবা করে ইমামের –আ. শিবিরে যোগ দিয়ে বীরের মত যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন। সে প্রথম দিকে কল্পনাও করতে পারেনি যে রাসূল-সা.'র নাতির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার স্পর্ধা দেখাতে পারে মুসলমান নামধারী উমাইয়া শাসক-চক্র।)

ইবনে জিয়াদ একদিকে ওমর সাদ নামের সেনা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয় ইমামের (আ.) সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে এবং অন্যদিকে দূতের মাধ্যমে ইমামের (আ.) কাছে চিঠি পাঠায় ইয়াজিদের আনুগত্য অথবা যুদ্ধ-এ দুইয়ের যে কোনো একটিকে বেছে নিতে। (ওমর সাদ কুফাবাসীদের নিয়ে গঠিত চার হাজার সেনা নিয়ে ইরানের রেই শহরের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু কারবালায় ইমামের (আ.) আগমনের ফলে তাঁকে ওই অভিযান বাতিল করতে ও ইমাম হুসাইন (আ.)'র সঙ্গে যুদ্ধ করতে বলে ইবনে জিয়াদ।)

ইমাম (আ.)'র কাছে জিয়াদের লেখা চিঠির ভাষা ছিল এমন: "হে হুসাইন! কারবালায় তোমার আগমনের বিষয়ে অবহিত হয়েছি। আমিরুল মুমিনিন ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন এক মুহূর্তের জন্যও যেন চোখ বন্ধ না করি এবং খাবার খেয়ে পেট না ভরি যাতে তোমাকে জ্ঞানী ও দয়াময় আল্লাহর সঙ্গে মিলিত (হত্যা) করতে পারি, কিংবা তোমাকে তাঁর (আল্লাহর) হুকুম ও ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার নির্দেশ মানতে বাধ্য করতে পারি।"

ইমাম (আ.) এই চিঠি পাঠ করে তা এক পাশে নিক্ষেপ করে বলেন: "যে জাতি নিজের সন্তুষ্টিকে আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর প্রাধান্য দেয় সেই জাতি সফল হবে না বা মুক্তি পাবে না।" ইবনে জিয়াদের দূত বলল: হে আবা আবদুল্লাহ! (ইমামের উপাধি) চিঠির জবাব দেবেন না? ইমাম (আ.) বললেন: "এর উত্তর হল যন্ত্রণাদায়ক খোদায়ী আজাব বা ঐশী শাস্তি যা শিগগিরই তাকে গ্রাস করবে।" দূত এই উত্তরের কথা ইবনে জিয়াদের কাছে গিয়ে বললে সে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।

ইমাম হুসাইন (আ.)’র এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল। কারবালা পরবর্তী ঘটনা-প্রবাহের এক পর্যায়ে মুসআব ইবনে যোবায়েরের সঙ্গে এক যুদ্ধে প্রাণ হারায় ইবনে জিয়াদ। ইবনে জিয়াদের সেনাদলকে কতল করেন মুসআব। আর তাদের মাথাগুলা জড়ো করা হয় কুফা মসজিদের আঙ্গিনায়। লোকেরা এ দৃশ্য দেখার জন্য জড় হয়। দর্শকদের মধ্যে আমারাহ ইবনে ওমায়ের বলেন: যখন ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ ও তার সেনাদের কাটা মস্তক আনা হল ও মসজিদের আঙ্গিনায় সেগুলো স্তূপীকৃত করা হল আমি তখন সেখানে গেলাম। লোকেরা বলছিল, এসে গেছে, এসে গেছে। দেখতে পেলাম একটি সাপ এসেছে। সাপটি স্তূপীকৃত খণ্ডিত মাথাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে প্রবেশ করছিল। সবশেষে সাপটি ইবনে জিয়াদের নাকের দুই ছিদ্রের ভেতর ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ মাথার ভেতরে থেকে আবার বেরিয়ে এসে চলে যায়। কিন্তু সাপটি কোথায় গেল তা দেখা যায়নি। কিছুক্ষণ পর আবার দেখা যায় সাপটিকে। লোকেরা আবার বলল, এসে গেছে। সাপটি দুই তিনবার এই কাণ্ড ঘটায়। (হাদিস গ্রন্থ,’তিরমিজি: ২য় খণ্ড, ২১৮ পৃষ্ঠা)

সব ঘটনাকে ম্লান করে দেয়া ঘটনা কারবালার কালজয়ী বিপ্লব মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামের চেতনা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছে। আর এ জন্যই বলা হয়: ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কি বাদ। অর্থাত প্রতিটি কারবালার পরই জীবিত হয় ইসলাম। ইমাম হুসাইন (আ.) মনে করতেন তাঁর শাহাদত ও রক্তদান ছাড়া যদি ইসলাম পুনরুজ্জীবিত না হয় তাহলে শাহাদতই উত্তম এবং ইয়াজিদের মত শাসক যদি বিনা বাধায় ও আপত্তিতে ‘ইসলামী সমাজের নেতা’ হন তাহলে ইসলাম চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে। সত্যের পথে শাহাদত মধুর চেয়েও মিষ্টি –এই সংস্কৃতি চালু করে গেছেন কারবালার বীর শহীদানরা। ইসলামকে আর কোনো কিছুই এত প্রাণ ও মর্যাদা দেয় না যা দেয় শাহাদত।
 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন