সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৪৬-৫০

সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৪৬-৫০

সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৪৬-৫০


সূরা আম্বিয়ার ৪৬ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَئِنْ مَسَّتْهُمْ نَفْحَةٌ مِنْ عَذَابِ رَبِّكَ لَيَقُولُنَّ يَاوَيْلَنَا إِنَّا كُنَّا ظَالِمِينَ (46) وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِينَ (47)
“আপনার পালনকর্তার আযাবের কিছুমাত্রও তাদেরকে স্পর্শ করলে তারা বলতে থাকবে,হায় আমাদের দুর্ভাগ্য,আমরা অবশ্যই পাপী ছিলাম।” (২১:৪৬)
“আমরা কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করব। কারও প্রতিই জুলুম করা হবে না। যদি কোন আমল (ভালো অথবা মন্দ) সরিষার দানা পরিমাণও হয়,আমি তা (হিসাবে) উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্যে আমিই যথেষ্ট।” (২১:৪৭)

আগের আয়াতে আমরা বলেছি, কাফের-মুশরেকরা যারা কেয়ামতকে অস্বীকার করে তারা অহংকারে ডুবে আছে। তারা না মৃত্যুকে দেখে আর না রাসূল (সা.)এর কথা শোনে। এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ বলেন: আল্লাহর আযাবের কিছুমাত্রও যদি এই পৃথিবীতে তাদেরকে স্পর্শ করে তাহলে তারা অলস নিদ্রা থেকে জেগে উঠবে এবং আল্লাহর নাফরমানি ও গুনাহের কথা স্বীকার করবে। তবু আল্লাহর নবী-রাসূলদের সত্য ও যৌক্তিক বক্তব্যের কোনো প্রভাব তাদের ওপর পড়বে না। এমনকি এ থেকে তারা শিক্ষাও নেবে না। এটা তো এই পৃথিবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আর আখিরাতে যে যার কৃতকর্ম অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করবে। আখিরাতে এমন এক আদালত স্থাপন করা হবে যে আদালতে মানুষের নিজ নিজ আমলনামায় তাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজগুলোরও রেকর্ড তুলে ধরা হবে এবং কোনো কিছুই হিসাব থেকে বাদ পড়বে না।

প্রশ্ন জাগতেই পারে কেয়ামতে মানুষের আমলনামা পরিমাপ করার মানদণ্ড কী হবে? এ জিজ্ঞাসার জবাবে রাসূলগণ, ইমামগণসহ সালেহিন বা ইনসানে কামেল ব্যক্তিদের থেকে বর্ণিত হয়েছে, পরিপূর্ণ ও নিখুঁত আমলকারী মানুষের আমলের সাথে অন্যান্য মানুষের আমলের পরিমাপ করা হবে এবং মূল্যয়ান করা হবে।

এ আয়াতগুলো থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলো:
১. দুনিয়াতে আল্লাহর আযাব এলে মানুষ তাদের গোনাহ’র কথা স্বীকার করতে এবং তা থেকে বাঁচার জন্য তওবা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সতর্ক না হলে আবারো উদাসীনতা এবং অহংকারে পড়ে যাবার আশঙ্কা থেকে যায়, যার ফলে গোনাহর বোঝা আরো বেশি ভারী হয়ে যাবে।
২. আল্লাহ যেমন পরম জ্ঞানী তেমন মহান্যায়বিচারক। সে কারণেই তাঁর কাছে কোনপ্রকার আমল লুকানো থাকবে না। তিনি কেয়ামতের দিন ইনসাফের ভিত্তিতে সবাইকে পুরষ্কার এবং শাস্তি দেবেন।

সূরা আম্বিয়ার ৪৮ ও ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَقَدْ آَتَيْنَا مُوسَى وَهَارُونَ الْفُرْقَانَ وَضِيَاءً وَذِكْرًا لِلْمُتَّقِينَ (48) الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ وَهُمْ مِنَ السَّاعَةِ مُشْفِقُونَ (49)
“আমরা এমনসব পরহেজগারদের কল্যাণের জন্যে মূসা ও হারুনকে দিয়েছিলাম (সত্য ও মিথ্যাকে পৃথককারী) গ্রন্থ ফুরকান, জ্যোতি ও ‘যিকির’। (২১:৪৮)
“যারা না দেখেই তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে এবং কেয়ামতের হিসাব নিকাশের ভয়ে শঙ্কিত।” (২১:৪৯)

আগের আয়াতগুলোতে বর্ণিত তৌহিদ ও কিয়ামত সংক্রান্ত বক্তব্যের পর এ আয়াত থেকে আল্লাহর কয়েকজন পয়গম্বরের জীবনী নিয়ে আলোচনা করা হবে। এসব আয়াতে হযরত মুসা (আ.)এর উপর অবতীর্ণ ঐশী গ্রন্থ তওরাতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

কুরআনে কারিমসহ আসমানি পুস্তকগুলোর ৩টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী এবং বিচিত্র পথ থেকে সত্য পথ তথা আল্লাহর পথকে আলাদা করে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, পথ নির্দিষ্ট হবার পর, সঠিক পথে চলার জন্য যথার্থ নূর বা আলোর প্রয়োজন। আর ঐশী গ্রন্থগুলোই মূলত আলোকিত পথের আলোর দিশারী। তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটি হলো: যারা সত্য পথে থেকেই কুরআনের আলো উপভোগ করেও অলস বা উদাসীন,আসমানী গ্রন্থগুলো তাদেরকে দায়িত্ব সচেতন করে তোলে বা করণীয় সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়।

পরহেজগারদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় বলা হয়েছেঃ আল্লাহর উপর তাদের ঈমান এত দৃঢ় যে আল্লাহকে না দেখেই তারা তাঁকে প্রত্যক্ষকারী এবং সর্বত্র বিরাজমান বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, গোপনেও অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকে কারণ তারা বিশ্বাস করে কেয়ামতে তাদের এই কাজের পরিনতি হবে ভয়াবহ।

এ আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় দিক হলো:
১. যেসব নবী বা পয়গম্বরকে কিতাব এবং শরিয়ত দেওয়া হয়েছে তাঁদের সংখ্যা সীমিত। অন্যান্য নবী ছিলেন ঐশীগ্রন্থধারী পয়গম্বর এবং তাঁদের কিতাবের প্রচারক। যেমন হযরত হারুন তওরাতের প্রচার করেছিলেন।
২. জনগণের সামনে নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা নির্জলা তাকওয়ার প্রমাণ নয় কারণ, বহু লোক আছে যারা লজ্জাবশত কিংবা নিজের মান-সম্মান রক্ষার্থে জনগণের সামনে নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে মৌলিক তাকওয়ার নিদর্শন হলো লোকচক্ষুর আড়ালে আল্লাহকে ভয় করা, কেননা এ ভয়ের কথা আল্লাহ ছাড়া কেউ দেখে না এবং শোনেও না।

সূরা আম্বিয়ার ৫০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَهَذَا ذِكْرٌ مُبَارَكٌ أَنْزَلْنَاهُ أَفَأَنْتُمْ لَهُ مُنْكِرُونَ (50)
“এবং আমরা এই বরকতপূর্ণ, উপদেশময় এবং কল্যাণময় কুরআন (তোমাদের হেদায়েতের জন্যে) নাযিল করেছি। তোমরা কি তাকে অস্বীকার কর?” (২১:৫০)

আসমানি পুস্তকের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সতর্ক ও স্মরণ করানো। মানুষের পবিত্র সত্ত্বায় আল্লাহ যা দিয়ে দিয়েছেন, কু-প্রবৃত্তি সেই সত্ত্বার ওপর আবরণ ফেলে দেয়। আর ঐশী গ্রন্থগুলো সেই আবরণ সরিয়ে দিয়ে মানুষকে তার দায়িত্বের কথাটি স্মরণ করিয়ে দেয়।

আল্লাহর নবীগণও একই উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে এসেছেন। তাঁরা এসেছেন হুঁশিয়ার ও সতর্ক করার মধ্য দিয়ে মানুষকে উদাসীনতার ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে। তাঁদেরকে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছে সাধারণ মানুষের পছন্দনীয় ভাল ও সৎ কাজকে সমাজে ছড়িয়ে দিতে আর জনসাধারণের কাছে ঘৃণ্য অসৎ ও মন্দ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে। অথচ এরপরও বহু মানুষ কুফরিবশত নবী-রাসূলদেরকে অস্বীকার করে এমনকি তাঁদের সত্যের বাণীগুলো গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. আমরা যদি শিক্ষা নেওয়া বা দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করার মানসিকতা নিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করি, তাহলে এ কুরআন অবশ্যই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক ও বরকতময় হবে।
২. ঐশী কিতাব ও নবীগণকে অস্বীকার করার অর্থ হল অহংকার,স্বার্থপরতা ও উদাসীনতার মতো মানবজাতির আধ্যাত্মিক ও মানসিক সমস্যাগুলোর আন্তরিক ও কার্যকর প্রেসক্রিপশন প্রত্যাখ্যান করা।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন