ইসলামের অনন্য মহামানব ইমাম বাক্বির (আ.)

ইমাম মুহাম্মদ বাক্বির (আ.)'র জন্ম হয়েছিল পবিত্র মদীনায় ৫৭ হিজরির পয়লা রজব অথবা তেসরা সফর। কারবালার মহা-ট্র্যাজেডি ও মহা-বিপ্লবের সময় তিনি পিতা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ও দাদা ইমাম হুসাইন (আ.)'র সঙ্গে ছিলেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র চার বছর। তাঁর মা ছিলেন হ

ইসলামের অনন্য মহামানব ইমাম বাক্বির (আ.)

ইমাম মুহাম্মদ বাক্বির (আ.)'র জন্ম হয়েছিল পবিত্র মদীনায় ৫৭ হিজরির পয়লা রজব অথবা তেসরা সফর। কারবালার মহা-ট্র্যাজেডি ও মহা-বিপ্লবের সময় তিনি পিতা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ও দাদা ইমাম হুসাইন (আ.)'র সঙ্গে ছিলেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র চার বছর।
তাঁর মা ছিলেন হযরত ইমাম হাসান মুজতবা (আ.)'র কন্যা ফাতিমা। এভাবে ইমাম বাক্বির (আ.) ছিলেন পিতা ও মাতা- উভয়ের দিক থেকেই হযরত আলী (আ.) ও নবী-নন্দিনী ফাতিমা (সা.)'র বংশধর।
পিতা ইমাম সাজ্জাদ তথা আহলে বাইতে জন্ম-নেয়া চতুর্থ ইমাম হযরত ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.) হিজরি ৯৫ সালে শাহাদত বরণ করলে তিনি মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব তথা ইমামত লাভ করেন। আর সেই থেকে শাহাদত লাভের সময় পর্যন্ত তথা ১৯ বছর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। মদীনায় পবিত্র জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে পিতার কবরের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। প্রায় একই স্থানে রয়েছে ইমাম হাসান মুজতবা (আ.) ও ইমাম বাক্বির (আ.)'র পুত্র তথা বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতে জন্ম-নেয়া ষষ্ঠ ইমাম হযরত ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.)'র কবর। এখানে তাঁদের সবার কবরের ওপরই ছিল সুদৃশ্য গম্বুজসহ মাজার। কিন্তু প্রায় ১২/১৩ শত বছর ধরে এইসব মাজার টিকে থাকা সত্ত্বেও এখন থেকে প্রায় ৮৮ বছর আগে ধর্মান্ধ ওয়াহাবিরা এই পবিত্র মাজারগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে।
সিরিয়ার এক ব্যক্তি নিজেকে অত্যধিক জ্ঞানী বলে মনে করতেন। সুযোগ পেলেই ইমাম বাক্বির (আ.)-কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলা ছিল তার স্বভাব। একদিন সে ইমামের ক্লাসে অংশ নেয়া প্রসঙ্গে ইমামকে বললেন: নবীর আহলে বাইতের প্রতি আমার কোনো অনুরাগ নেই। কিন্তু যেহেতু আপনি কথা বলার শিল্পে ও নানা জ্ঞানে বেশ দক্ষ তাই আপনার ক্লাসে আসি। কিন্তু আমি আপনার অনুরাগী ও অনুসারী নই। ইমাম বাক্বির আ. বললেন: আল্লাহর কাছে কোনো কিছুই গোপন থাকবে না। এভাবে সে ইমামের প্রতি অপমানজনক আচার-আচরণ চালিয়ে যাচ্ছিল।
সিরিয় এই পণ্ডিত কিছুকাল পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। নানা ধরনের চিকিতসায় কোনো সুফল আসছিল না। চলাফেরার শক্তি হারা ওই পণ্ডিতের অবস্থা এক রাতে বেশ শোচনীয় হয়ে পড়ে। সে এ সময় স্বপ্ন দেখে যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে ও এই সময় ইমাম বাক্বির (আ.) তার আরোগ্যের জন্য দোয়া করছেন; আর আল্লাহ ইমামের দোয়া কবুল করায় পণ্ডিত আবারও জীবন ফিরে পেয়েছে। এই স্বপ্নের কথা তুলে ধরে পণ্ডিত বন্ধুদের দিয়ে ইমামকে অনুরোধ জানান তিনি যেন তাকে দেখতে আসেন। ইমামের কাছ যাওয়ার শক্তি তার ছিল না বলে সে দুঃখ প্রকাশ করে।
এদিকে আহলে বাইতের এমন ঘোর বিরোধী ব্যক্তির মুখে এমন কথা শুনে সবাই বিস্মিত হয়। যাই হোক, ইমাম তাকে দেখতে আসেন ও ওই পণ্ডিতের পরিবারের সদস্যদের বলেন তার জন্য বিশেষ ওষুধ তৈরি করতে। ইমাম নিজের হাতে তাকে ওষুধ সেবন করান। ইমামের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ওই ব্যক্তি কয়েক দিনের মধ্যেই মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠে। এবার সে নিজেই ইমাম বাক্বির (আ.)'র কাছে এসে অত্যন্ত আদব সহকারে বসে ইমামের কাছে ক্ষমা চায় ও অশ্রুসজল চোখে বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি মানুষের মধ্যে আল্লাহর হুজ্জাত বা প্রমাণ এবং যারাই আপনাকে ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বা জোটবদ্ধ হবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইমাম বাক্বির (আ.) ছিলেন অন্য ইমামদের মতই মানুষের জন্য সর্বাত্মক পথ-প্রদর্শক, সংশোধক ও সমাজ-সংস্কারক। তাঁর ইবাদত-বন্দেগি, খোদাভীরুতা, মহানুভবতা ও দয়া ছিল সবার জন্যই অনুকরণীয় আদর্শ। মানুষকে হেদায়াতের কঠিন দায়িত্ব পালনে মশগুল থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে কৃষিকাজের মত কঠোর পরিশ্রম করতেন। ইমাম অলসতা ও বেকারত্বকে ঘৃণা করতেন।
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রচারের জন্য এই মহান ধর্ম ইমাম বাক্বির (আ.)'র কাছে চির-ঋণী হয়ে আছে। ইমাম অনেক সুযোগ্য ছাত্র তৈরি করেছিলেন। তাঁকে বাক্বির বলা হয় এ কারণে যে তিনি ছিলেন দ্বিন ও দুনিয়ার জ্ঞানের বিকাশকারী এবং বিশ্লেষক। আল্লাহ-প্রদত্ত অলৌকিক জ্ঞানের অধিকারী ইমামের জ্ঞানের কাছে সে যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীরাও ছিলেন শিশুর মত তুচ্ছ। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর সাহাবি জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারিকে বলেছিলেন, তুমি আমার সন্তান তথা বংশধর বাক্বিরকে দেখা পর্যন্ত জীবিত থাকবে। তুমি তখন তাঁকে আমার সালাম পৌঁছে দিও। জাবির শিশু ইমাম বাক্বির (আ.)'র সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাঁর পায়ে চুমো দিয়ে বলেছিলেন,
"হে নবীর সন্তান! আপনার জন্য আমার জীবন উতসর্গিত হোক। আপনার পিতা নবী (সা.)'র সালাম গ্রহণ করুন, কারণ, তিনি আপনাকে সালাম দিয়েছেন। ইমাম বাক্বির (আ.) অশ্রুসজল চোখে বললেন: সালাম ও দরুদ আমার পিতা নবী (সা.)'র ওপর ততদিন ধরে বর্ষিত হোক যতদিন এই আকাশ ও জমিন টিকে থাকবে। আর তোমার ওপরও সালাম হে জাবির, যেহেতু তুমি তাঁর সালাম আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছ।"

জনৈক আসাদ বিন কাসির বলেছেন : আমি একবার আমার দরিদ্র অবস্থা এবং আমার ওপর ভাইদের অত্যাচারের ব্যাপারে ইমামের কাছে নালিশ করলাম। তিনি বললেন : "যে ভাই সামর্থবান ও সম্পদশালী অপর ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে, কিন্তু ঐ ভাই দরিদ্র হয়ে গেলে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ও তার ওপর অত্যাচার চালায় সে অত্যন্ত খারাপ মানুষ।" এরপর তিনি আমাকে ৭০০ দেরহাম দান করার নির্দেশ দিলেন যাতে আমি সেই অর্থ দিয়ে আমার দারিদ্র্য দূর করতে পারি। এরপর ইমাম আমাকে বললেন : "তুমি স্বচ্ছল হতে পারলে কিনা তা আমাকে জানিও"।
জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছিল অন্যান্য ইমামদের মতই ইমাম বাক্বির (আ.)'র চরিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি বনি উমাইয়া শাসকদের নানা কুকীর্তির সমালোচনা করতেন। শাসকদের জুলুম জাতির জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনে বলে তিনি মনে করতেন। হিশাম বিন আবদুল মালিক ইমামের এইসব ভূমিকার জন্য তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হন ও গোপনে তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেন। হিশাম তাঁকে সিরিয়ায় নিজ দরবারেও তলব করেন। ইমাম বাক্বির আ. সেখানে উপস্থিতি হয়ে বলেন:
তোমার হাতে রয়েছে ক্ষণস্থায়ী রাজত্ব, কিন্তু আমাদের জন্যই হল চিরস্থায়ী নেতৃত্ব ও শাসন এবং খোদাভীরুদের জন্যই রয়েছে শুভ-পরিণাম। সিরিয়ায় ইমাম বাক্বির (আ.)'র উপস্থিতি তাঁর আধ্যাত্মিক ও জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্বকে সবার কাছেই স্পষ্ট করে দেয়। সেখানেও তিনি খাঁটি ইসলামকে স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেন। ফলে গণ-জাগরণের ভয়ে ভীত হিশাম ইমামকে আবারও মদীনায় ফেরত পাঠান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিশামের হিংসার হিংস্র আগুন ইমাম বাক্বির (আ.)-কে শহীদ করার মাধ্যমে ইসলামের এই অনন্য মহামানবকে মুসলমানদের কাছ থেকে চিরতরে কেড়ে নেয়। কিন্তু হিশামের হিংসার অনল নেভাতে পারেনি ইমামের রেখে যাওয়া জ্ঞানের আলো এবং আহলে বাইতের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা। আহলে বাইত চিরকালই প্রকৃত মুমিনের হৃদয়ে বিরাজ করছেন ইসলামের প্রকৃত নেতা হিসেবে।
ইমাম মোহাম্মাদ বাক্বির (আ.)'র একটি বাণী শুনিয়ে এবং সবাইকে আরো একবার গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়ে এই মহান ইমামের শাহাদত-বার্ষিকীর আলোচনা শেষ করবো।
ইমাম বাক্বির (আঃ) বলেছেন : যে ব্যক্তির অন্তরে জ্বলজ্বলে ও সাদা কোন অংশ নেই, সে মুমিন নয়। যখন ব্যক্তি কোন পাপ কাজ করে তখন ঐ সাদা অংশের ওপর কালো একটি ছাপ পড়ে। যদি সে তওবা করে আল্লাহর কাছে অনুশোচনা করে তবে সেই কালো ছাপ মুছে যায়। আর যদি সে তওবা না করে পাপ কাজ অব্যাহত রাখে, তবে কালো ছাপ গভীর থেকে গভীরতর হয়। একসময় তার অন্তরে আর কোন সাদা জায়গা থাকে না,পুরোপুরি কালো হয়ে যায়। এ ধরনের অন্তরের অধিকারীরা কখনো সুপথ পায় না।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন