সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ২৫-৩৬ (পর্ব-৫)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ২৫-৩৬ (পর্ব-৫)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ২৫-৩৬ (পর্ব-৫)
সূরা ত্বোয়া-হা’র ২৫ থেকে ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي (25) وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي (26) وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي (27) يَفْقَهُوا قَوْلِي (28)
“মুসা বলল, হে আল্লাহ, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দাও।”(২০:২৫)
“এবং আমার কাজ সহজ করে দাও।”(২০:২৬)
“আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও।”(২০:২৭)
“যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।” (২০:২৮)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ রিসালাতের কঠিন দায়িত্ব হযরত মুসা (আ.) এর ওপর অর্পণের পর তাকে দু’টি মুজিযা বা অলৌকিক ক্ষমা প্রদান করেন যাতে তিনি নিজের নবুওয়াতের ঘোষণা দেয়ার আগে এগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। এ আয়াতগুলোতে আল্লাহর এ নবীর প্রথম কাজের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এখানে তাঁকে ফেরাউনের দরবারে গিয়ে তার সীমা লঙ্ঘন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ। সব মানুষের কাছে হেদায়েতের বাণী পৌঁছে দেয়া নবী-রাসূলদের কাজ হলেও যে সমাজের ওপর ফেরাউনের মতো অত্যাচারী ও সীমা লঙ্ঘনকারী শাসক চেপে বসেছে এবং সব মানুষকে নিজের ক্রীতদাস বানিয়েছে, সে সমাজের শাসকের হাত থেকে জনগণকে মুক্ত করার মাধ্যমে তাদেরকে হেদায়েতের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি দরকার। এ কারণে হযরত মুসা (আ.) সবার আগে আল্লাহর কাছে এ মহান দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয় সামর্থ্য কামনা করেন। তিনি বলেন, এ কাজের জন্য আল্লাহ যেন ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেন। ফেরাউনের মতো প্রতাপশালী শাসকের দরবারে গিয়ে কথা বলতে যেন জিহ্বা জড়িয়ে না যায় সেজন্য আল্লাহর সাহায্য চান তিনি। হযরত মুসা এ রকম বিপজ্জনক দায়িত্ব পালন থেকে পিছপা না হয়ে আল্লাহর কাছে এ দায়িত্ব পালনের জন্য সাহায্য কামনা করেন। আর এটিই ছিল এ কাজে হযরত মুসা (আ.)র সাফল্যের চাবিকাঠি। জিহ্বার জড়তা দূর করার পাশাপাশি তিনি নিজের বুকে শক্তি ও সাহস কামনা করেন এবং বাহ্যিক প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে দেয়ার আবেদন জানান।
এ পাঁচ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. কোন সমাজকে সংস্কার করতে চাইলে আগে সে সমাজের নেতাদের সংশোধন করতে হবে। শাসকশ্রেণী প্রতিরোধ করলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
২. মহান দায়িত্ব পালনের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে ধৈর্য, সহনশীলতা ও দৃঢ় সংকল্প।
৩. বড় বড় দায়িত্ব সামনে আসলে পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তা পালনের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে।
৪. ধর্ম প্রচারকদের বক্তব্য সবার কাছে বোধগম্য হতে হবে। কঠিন শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহার করলে তা বুঝতে মানুষের অসুবিধা হয়।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ২৯ থেকে ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَاجْعَلْ لِي وَزِيرًا مِنْ أَهْلِي (29) هَارُونَ أَخِي (30) اشْدُدْ بِهِ أَزْرِي (31) وَأَشْرِكْهُ فِي أَمْرِي (32)
“এবং আমার গোত্র থেকে আমাকে একজন সাহায্যকারী দাও।”(২০:২৯)
“আমার ভাই হারুনকে।”(২০:৩০)
“তার মাধ্যমে আমার শক্তি বাড়িয়ে দাও”(২০:৩১)
“এবং তাকে আমার কাজে অংশীদার করে দাও।” (২০:৩২)
হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে যে সব সাহায্য চান তার মধ্যে ছিল, তিনি তার কাজে নিজের ভাই হারুনকে সাহায্যকারী হিসেবে চেয়েছিলেন যাতে তাকে সঙ্গে নিয়ে ফেরাউনের দরবারে গিয়ে বিনা দ্বিধায় অত্যাচারী শাসকের কাছে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী পৌঁছে দিতে পারেন।
বিভিন্ন তাফসিরে এসেছে, হারুন ছিলেন হযরত মুসার চেয়ে তিন বছরের বড়। হারুন শুদ্ধ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। হযরত মুসা (আ.) এর জীবদ্দশায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। মুসার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ হারুনকেও নবুওয়াত প্রদান করেন এবং দু’ভাই মিলে ফেরাউনকে হেদায়েতের বাণী শোনাতে যান।

এ চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. বড় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের কথা ভুলে যাওয়া যাবে না।
২. শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেই নয়, সেই সঙ্গে ধর্ম প্রচারের কাজেও অন্যকে অংশীদার করা বা অন্যের সাহায্য নেয়া যায়।
৩. ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি সঙ্গে থাকলে কাজে সাহস বাড়ে এবং মনে বল আসে। তবে শর্ত হচ্ছে, ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিটি হতে হবে সমচিন্তার অধিকারী।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৩৩ থেকে ৩৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
كَيْ نُسَبِّحَكَ كَثِيرًا (33) وَنَذْكُرَكَ كَثِيرًا (34) إِنَّكَ كُنْتَ بِنَا بَصِيرًا (35) قَالَ قَدْ أُوتِيتَ سُؤْلَكَ يَا مُوسَى (36)
“(হে আল্লাহ) যাতে আমরা তোমার প্রচুর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি।”(২০:৩৩)
“এবং তোমাকে আরো বেশি স্মরণ করতে পারি।”(২০:৩৪)
“তুমি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা।” (২০:৩৫)
“আল্লাহ বললেন- হে মুসা! তুমি যা চেয়েছো তা তোমাকে দেয়া হলো।” (২০:৩৬)
এ আয়াতে হযরত মুসা (আ.) এর আবেদনগুলোর উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। তিনি চেয়েছেন মানুষকে এক আল্লাহর প্রতি আহ্বান জানাতে এবং তাদেরকে শিরক ও অত্যাচারী ফেরাউনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে।
সব ঈমানদার ব্যক্তিই মুখে সুবহানআল্লাহসহ অন্যান্য যিকির উচ্চারণ করে থাকেন। কিন্তু আল্লাহর বাণী সমাজে প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষকে শিরক থেকে দূরে রাখার পাশাপাশি মুশরিক শাসকদের উতখাত করা একমাত্র নবী-রাসূলদেরই কাজ। পয়গম্বররা এ কাজ করেন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভের মাধ্যমে। যিনি সারাক্ষণ সব স্থানে সব অবস্থায় আল্লাহর উপস্থিতি উপলব্ধি করেন তার পক্ষেই কেবল ফেরাউনের মতো প্রতাপশালী শাসকের সামনে দাঁড়ানো এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস দেখানো সম্ভব। হযরত মুসা ও হারুনের এরকম ঈমানই ছিল এবং আল্লাহও তাদেরকে সাহায্য করেছেন।
এ চার আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হল:
১. নবী-রাসূলরা মুশরিক শাসকদের উতখাত করে সমাজে আল্লাহর একত্ববাদভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন।
২. আল্লাহ-তায়ালা প্রতিটি মুহূর্তে আমাদেরকে দেখছেন এবং আমাদের প্রয়োজনগুলিও তিনি উপলব্ধি করেন। কিন্তু তারপরও তাঁর কাছে দোয়া করা ও তার সাহায্য চাওয়াকে আমাদের দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন