সূরা ত্বোয়া-হা ৭-১২

সূরা ত্বোয়া-হা ৭-১২

সূরা ত্বোয়া-হা ৭-১২

 

সূরা ত্বোয়া-হা’র ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন:
وَإِنْ تَجْهَرْ بِالْقَوْلِ فَإِنَّهُ يَعْلَمُ السِّرَّ وَأَخْفَى (7) اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى (8)
“তুমি উচ্চকণ্ঠে যা-ই বল না কেন, আল্লাহ তো যা গুপ্ত ও অব্যক্ত তা জানেন।”(২০:৭)
“আল্লাহ- তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, সব উত্তম নাম তারই।” (২০:৮)
সূরা ত্বোয়া-হা’র প্রথম কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর তিনটি গুণের কথা বলা হয়েছে। তিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। এই আয়াতে আল্লাহ-তায়ালার আরেকটি গুণ তথা মানুষের অন্তরের কথা তাঁর জানা থাকার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। শুধু মানুষের প্রকাশ্য কথাবার্তাই নয় সেইসঙ্গে সে অন্তরে কী চিন্তাভাবনা করছে সে সম্পর্কেও পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন অন্তর্যামী আল্লাহ। মানুষের সবচেয়ে গোপনীয় বিষয়টিও তার কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। যদি সেই গোপনীয় বিষয়টি ওই ব্যক্তি ভুলে গিয়েও থাকে তারপরও তা আল্লাহর জানা থাকে।
আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহর একক সত্ত্বার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, তিনি ছাড়া অন্য কারো এত বিশাল ক্ষমতা নেই। সব পরিপূর্ণতার আধার তিনি এবং সৃষ্টিজগতে তার এ পরিপূর্ণ সত্ত্বার বহু নিদর্শন বিদ্যমান। সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর অস্তিত্বে আল্লাহ-তায়ালার শক্তিমত্তা, মহানুভবতা, দয়া, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য এসব সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে আল্লাহ অপেক্ষাকৃত পরিপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন বলে তার নিদর্শনাবলী মানুষের মধ্যে বেশি স্পষ্ট। বিশেষ করে ওলি-আউলিয়া ও নবী-রাসূলদের জীবনে আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর প্রতিফলন সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. নিজের জীবনের ওপর আল্লাহর বিশাল শক্তিমত্তা ও মহানুভবতার নিদর্শন লক্ষ্য করলে মানুষ খারাপ কাজ করা থেকে বিরত থাকতে উতসাহিত হবে।
২. একমাত্র তিনিই উপাসনার যোগ্য যার মধ্যে সব ধরনের ভালো গুণের সমন্বয় ঘটেছে এবং যিনি সব ধরনের দোষত্রুটি থেকে মুক্ত।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৯ ও ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَهَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ مُوسَى (9) إِذْ رَأَى نَارًا فَقَالَ لِأَهْلِهِ امْكُثُوا إِنِّي آَنَسْتُ نَارًا لَعَلِّي آَتِيكُمْ مِنْهَا بِقَبَسٍ أَوْ أَجِدُ عَلَى النَّارِ هُدًى (10)
“তোমার কাছে মুসার বৃত্তান্ত এসেছে কি?” (২০:৯)
“সে যখন আগুন দেখল তখন তার পরিবারবর্গকে বলল- তোমরা এখানে থাকো, আমি আগুন দেখেছি, সম্ভবত আমি তোমাদের জন্য সেখান থেকে কিছু আগুন আনতে পারব অথবা আমি ওই আগুনের কাছে কোনো পথ প্রদর্শক পাব।” (২০:১০)
এ সূরার প্রথম কয়েকটি আয়াতে আল্লাহর ক্ষমতা বর্ণনার পর এই আয়াত থেকে ৮০ নম্বর আয়াত পর্যন্ত আল্লাহর নবী হযরত মুসা (আ.) এর ঘটনাবহুল জীবনের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় প্রতিটি মু’মিন বান্দার জন্য হযরত মুসার কাহিনীতে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। বিশেষ করে যারা অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের উচিত অবশ্যই হযরত মুসার জীবনের ঘটনা জানা ও তা থেকে শিক্ষা নেয়া।
এই জীবনচরিতের প্রথম অংশে হযরত মুসা (আ.) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মাদায়েন থেকে স্বপরিবারে নিজ দেশ মিশরে ফেরার পথে তীব্র শীতের রাতে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এমন সময় তিনি অনেক দূরে আগুন দেখতে পেলেন। তিনি ভাবলেন, সেখানে কোনো মানুষ আগুন জ্বালিয়ে হয়তো নিজেদের গরম রাখার চেষ্টা করছে। এ সময় হযরত মুসা (আ.) নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের থামতে বলে জানালেন, আমি একটু দেখে আসি ওখানে কি আছে।
কিন্তু হযরত মুসা যে আগুন দেখতে পেয়েছিলেন সেট প্রকৃতপক্ষে কোনো আগুন ছিল না। একটি গাছের উপর আল্লাহর নূরের প্রতিফলন ঘটেছিল, তবে সে নূর হযরত মুসা ছাড়া আর কেউ দেখতে পায়নি। তিনি পরিবারের লোকজনদের বসিয়ে রেখে ওই আগুনের দিকে এগিয়ে গেলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা আগুন দেখতে পাননি বলেই তারা হযরত মুসার সঙ্গে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
হযরত মুসা (আ.) নিজের পরিবার নিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে ও হারিয়ে যাওয়া পথ খুঁজে বের করতে আগুনের দিকে ছুটে গেলেন। অথচ আল্লাহ তাকে তার উম্মতের মুক্তির পথ দেখিয়ে দিলেন। তার উম্মত অর্থাত বনি-ইসরাইল যে পথ হারিয়ে বসে আছে তার সন্ধান দিলেন মহান আল্লাহ।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
১. অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস বর্ণনা এবং সে সব জাতির উন্নতি ও পতনের কারণগুলোর সঙ্গে পরিচিত করানোর মাধ্যমে পবিত্র কুরআন শেষ নবীর উম্মতকে সঠিক পথে চলার শিক্ষা দিয়েছে।
২. সাধারণত কষ্ট ও সমস্যার ভেতর দিয়ে আল্লাহর দয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কাজেই সামনে সমস্যা দেখলেই ভয় পেলে চলবে না বরং সেই সমস্যার ভেতর থেকেই নিজের আত্মিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করতে হবে।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ يَا مُوسَى (11) إِنِّي أَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى (12)
“এরপর যখন সে আগুনের কাছে আসল, তখন আহ্বান করে বলা হলো- হে মুসা!”(২০:১১)
“আমিই তোমার প্রতিপালক, কাজেই তোমার জুতা খুলে ফেল, কারণতুমি পবিত্র ‘ত্বোয়া’ উপত্যকায় রয়েছো।” (২০:১২)
এ আয়াতে হযরত মুসা (আ.)এর ওপর প্রথম ঐশী বার্তা এবং তার রেসালাতের সূচনার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এ ঘটনাটি ঘটেছিল ‘ত্বোয়া’ উপত্যকার তুর পাহাড়ে। সেখানে আল্লাহ-তায়ালা হযরত মুসার সঙ্গে কথা বলেন। আল্লাহ নিজেকে মুসার রব বা সৃষ্টিকর্তা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। হযরত মুসাকে জুতা নিক্ষেপ করতে বলা হয়েছে দু’টি উদ্দেশ্যে। একটি হচ্ছে, তুমি এখন তোমার পালনকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছো, কাজেই জুতা খুলে তাকে সম্মান দেখাও। দুই, তুমি এখন পবিত্র ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছো। কাজেই জুতা দিয়ে সেই পবিত্র ভূমিকে মাড়িও না। মসজিদসহ অন্যান্য পবিত্র স্থানে জুতা নিয়ে প্রবেশ করা উচিত নয়।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১. হযরত মুসা (আ.) আগুন দেখে সেখানে কোনো জনমানব আছে কিনা তা দেখতে গেলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁকে মহান দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন।
২. ওলি-আউলিয়াদের সামনে এবং পবিত্র স্থানগুলোতে আল্লাহর রহমত লাভের প্রধান শর্ত হচ্ছে, আদব মেনে চলা এবং পবিত্র স্থানের সম্মান রক্ষা করা।
 সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন