আতিথ্যের মাস-রমজান : (প্রথম- পর্ব)

আতিথ্যের মাস-রমজান : (প্রথম- পর্ব)

আতিথ্যের মাস-রমজান : (প্রথম- পর্ব)

ফামান শাহিদা মিনকুমুশ্‌ শাহরা ফাল্‌ইয়াসুমহু
" কাজেই তোমাদের মাঝে যে মাসটি পাবে, সে যেন রোযা রাখে।"

সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াত এটি। এই একটি মাত্র আয়াত থেকেই প্রমাণিত হয় যে, সাওম বা রোযা সবার জন্যেই অবশ্য পালনীয় একটি ইসলামী বিধান। ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিধানের একটি হলো রোযা। তবে এই বিধানটি কেবল আমাদের জন্যেই নয় বরং আমাদের পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণের উম্মাতদের জন্যেও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল। যেমনটি কোরআনেই বলা হয়েছে, ‘কামা কুতিবা আলাল লাজিনা মিন ক্বাবলিকুম' অর্থাৎ 'যেমনটি তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও সিয়ামকে ফরয করা হয়েছিল।'

অশোধিত তেলকে যেমন পরিশোধন করেই জ্বালাতে হয়, ব্যবহার করতে হয়, তেমনি মানুষের মন ও আত্মাকেও যথার্থভাবে কাজে লাগানো বা ব্যবহার করার জন্যে বছরে একবার তাকে পরিশোধন করে নিতে হয়। নইলে অশোধিত তেলের মতো ময়লাযুক্ত আত্মা কিংবা মনে খোদায়ী নূর জ্বলবে না। পবিত্র রমযান মাস হলো অন্তরাত্মাকে পরিশোধন করার শ্রেষ্ঠ সময়। ব্যক্তিগত বিচিত্র ভুলের কারণে শয়তানীর যতো আচ্ছাদন পড়েছে মানুষের অন্তরের আয়নায়, যতো মরিচা ধরেছে তাতে অন্যায় আচরণ আর অনৈতিকতার চর্চার কারণে, সেগুলোকে ধুয়ে মুছে পূত-পবিত্র করে মনের ঘরে আধ্যাত্মিকতার প্রদীপ জ্বালানোর সর্বোত্তম সময় রমযান। পবিত্র কোরআনের সূরা যুমারে আল্লাহ বলে দিয়েছেন, ‘ইন্নামা ইউয়াফফাস সাবিরুনা আজরাহুম বিগাইরি হিসাব' অর্থাৎ যারা প্রবৃত্তির রিপুগুলোকে দমন করে সঠিক পথে অটল থাকবে, তাদেরকে অগণিত সওয়াব প্রদান করা হবে। আর রমযান মাসটিই হলো তার অনুশীলনের শ্রেষ্ঠ ও যথার্থ সময়।

এই মাসটি যেন রোযাদারের জন্যে মেহমানীর মাস। রোযাদার হলেন আল্লাহর মেহমান আর মেহমানের সামনে যে দস্তরখান আল্লাহ বিছিয়ে দিয়েছেন তাতে রয়েছে রহমত, তাতে রয়েছে বরকত এবং তাতে রয়েছে মাগফেরাতের বিচিত্র ভোজের রেসিপি। এখন যারা এইসব ঐশী ভোজে নিজেকে তৃপ্ত-পরিতৃপ্ত করতে চান তারা কোনোরকম কার্পণ্য না করে, কোনোরকম অবহেলা কিংবা কালক্ষেপন না করে নিজেকে সমৃদ্ধ করবেন-এটাই স্বাভাবিক। ইবাদাত আর আধ্যাত্মিকতার সুগন্ধি দিয়ে নিজেদের অন্তরাত্মাকে মৌ মৌ করে তুলবেন-সেই সুবর্ণ সময় এসেছে আজ। মৌলাভি যেমনটি বলেছেন,

সত্যের সুগন্ধি শীতল সমীর
এ সময় নিয়ে আসে ঐশী পাঠ
অপূর্ব এ উপহার থেকে সন্তর্পনে
যতো পারো করে যাও লুটপাট।
রহমতের সমীরণ এসে আবার চলে যায়
যাকে ইচ্ছে তাকে সে প্রাণবায়ু দিয়ে যায়
আবার এসেছে আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
প্রস্তুতি নাও হে গোলাম, করো অবগাহন।

হিজরী পঞ্জিকার বারোটি মাসের মধ্যে একটি মাসের নাম হলো রমযান। অথচ মজার ব্যাপার হলো পবিত্র কোরআনে কেবলমাত্র এই রমযান মাসেরই নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকেই বিশ্লেষকমহল মনে করছেন যে, আল্লাহর কাছে এ মাসটির অসামান্য মর্যাদা রয়েছে। যেমনটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেছেন, ‘আস সাওমু লি, অ-আনা আজযি বিহী' অর্থাৎ ‘রোযা আমার জন্যে রাখা হয এবং আমিই তার প্রতিদান দেবো।' পরকালে যে তিনি কী পুরস্কার দেবেন তার কিছুটা ইঙ্গিত নবী কারিম (সাঃ) আমাদের দিয়েছেন। সে থেকে রোযাদারগণ নিশ্চয়ই পরিতৃপ্ত হবার আনন্দ পাবেন। রাসূলে খোদা বলেছেন, ‘রমযান এমন একটি মাস যে মাসে আল্লাহ তোমাদের জন্যে রোযা রাখাকে ফরজ করে দিয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় রোযা রাখবে, তার জন্যে রোযার সেই দিনটি হবে এমন যেন সবেমাত্র সে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে, অর্থাৎ রোযাদার তার সকল গুণাহ থেকে মুক্তি পেয়ে নিষ্পাপ শিশুটির মতো হয়ে যাবে।

আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের প্রতি এ যে কতো বড়ো রহমত, কতো বড় বিশাল এক অনুগ্রহ তা বোঝানো সম্ভব নয়। কেবল অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করার বিষয় এটি। নবী কারিম (সাঃ) বলেছেন, যখনই রমযানের শুভাগমন ঘটে, তখনি আল্লাহর রহমতের দরোজাগুলো খুলে যায় আর জাহান্নামের দরোজাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সেইসাথে শয়তানকে লোহার জিঞ্জীর বা শেকলে আবদ্ধ করা হয়। এই হাদিস থেকে যে বিষয়টি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে তাহলো, রমযান ব্যতীত এগারোটি মাসেও আমরা আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগী করার চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনার কারণে অনেক সময় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ইবাদাত করা হয়ে ওঠে না। এই মাসে যেহেতু শয়তানকে আটকে রাখা হয়, তাই তার মাধ্যমে প্ররোচিত হবার কোনো আশঙ্কা নেই ফলে যতো খুশি ইবাদাত করার সুযোগ রয়েছে এই মাসে। সুবর্ণ এই সুযোগকে আমরা যেন কোনোভাবেই কাজে লাগাতে ব্যর্থ না হই-সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কিন্তু কী কর্মসূচি থাকতে পারে এই মাসে, এবার সেই প্রসঙ্গে অলী-আওলিয়াদের সংক্ষিপ্ত দিক-নির্দেশনা তুলে ধরা যাক। আহলে বাইতের মহান ইমামগণ রমযানের দৈনন্দিন করণীয় সম্পর্কে চমৎকার দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এমনকি কীভাবে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইতে হবে-তারও নির্দেশন রেখে গেছেন তাঁরা।

বেহেশত হলো আল্লাহর ইবাদাত বা আনুগত্যকারীদের পুরস্কার। রোযাও আল্লাহর দেয়া অবশ্য পালনীয় দায়িত্বগুলোরই একটি। রমযান মাসের এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আরো কিছু ইবাদাত অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। যেমন- কোরআন তেলাওয়াত করা, এহসান বা দয়াপরবশ হওয়া, দান-খয়রাত করা, তওবা এস্তেগফার করা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার লাভে যোগ্য সকল গঠনমূলক ইবাদাত এ মাসের অবশ্য করণীয় কিছু দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুটিষ্ট অর্জন করার এবং নৈতিক চরিত্র গঠন করার সৌভাগ্য দিন। যেমনটি হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, ‘ আল্লাহ আমাদের ওপর রোযা ফরজ করেছেন, নৈতিক চরিত্র গঠনে শিক্ষা দেয়ার জন্যে। সেই শিক্ষা যাতে আমরা পেতে পারি এবং তা কাজে লাগাতে পারি সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন