পবিত্র কোরআনে নেক বান্দাগণের দোয়া

পবিত্র কোরআনে নেক বান্দাগণের দোয়া

পবিত্র কোরআনে নেক বান্দাগণের দোয়া
কোরআন শরিফে নবিগণের দোয়া ব্যতীতও কিছু দোয়ার উল্লেখ রয়েছে। সেসব দোয়া বিভিন্ন নেক বান্দার যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রসুল হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) - এর প্রতি ওহি হিসেবে অবতীর্ণ করেছেন। যথা:

আসহাবে কাহাফের দোয়া
আসহাবে কাহাফ এমন এক যুবকের দল যারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং এক আল্লাহর এবাদত করতেন। কিন্তু তাঁরা যেসমাজে বাস করতেন তার সবাই কাফের ছিল। সে রাজ্যের রাজা ছিল অত্যন্ত জুলুমকারী। আসহাবে কাহাফ, আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছেন, এই ব্যাপারটি রাজা বুঝতে পারে। ফলে রাজা তাদেরকে মূর্তিপূজার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তাঁরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও এবাদত করতে রাজি হন নি। রাজা তাঁদেরকে হত্যার নির্দেশ দেয়। ফলে তাঁরা রাতের অন্ধকারে অত্যন্ মরুভূমির দিকে পালিয়ে যান। পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন। পাহাড়ের গুহায় বিনা বাধায় এবং মুক্তভাবে আল্লাহর এবাদতে মশগুল হন এবং দুহাত তুলে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন:
رَبَّنا آتِنا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً وَ هَيِّئْ لَنا مِنْ أَمْرِنا رَشَداً
হে আমাদের রব্‌! আপনার নিকট হতে আমাদেরকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজ-কর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করুন। (সুরা: কাহ্‌ফ, ১০।)

সাবার রানী বিলকিসের দোয়া
আল্লাহ তাআলা হজরত সুলাইমানকে (আঃ) এক অতুলনীয় হুকুমত দান করেন। তিনি পশু-পাখীর ভাষাও বুঝতেন। একদা হজরত সুলাইমান (আঃ) পাখীদের মধ্যে হুদহুদপাখীকে অনুপস্থিত পেলেন, কিন্তু খুবই অল্প সময়ের মধ্যে হুদহুদপাখী ফিরে এল এবং হজরত সুলাইমানকে (আঃ) সম্বোধন করে বলল: 'আমি সাবা নামক দেশ হতে আপনার জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর এনেছি। সেখানে বিলকিস নামক এক মহিলা রাজত্ব করছে। সে দেশের জনগণ সূর্যকে প্রভু হিসেবে সেজদা করে।'
এ খবর শুনে হজরত সুলাইমান (আঃ) সাবা দেশের রাণী বিলকিসের নিকট পত্র লিখেন। হুদহুদপাখী পত্রখানা রাণী বিলকিসের নিকট পৌঁছে দেয়। রাণী বিলকিস পত্র পাওয়ার পর হজরত সুলাইমান (আঃ) - এর নিকট উপঢৌকন প্রেরণ করে। কিন্তু হজরত সুলাইমান (আঃ) তার উপঢৌকন প্রত্যাখ্যান করেন। কিছুদিন পর রাণী বিলকিস নিজেই হজরত সুলাইমান (আঃ) - এর নিকট এসে উপস্থিত হন। আল্লাহর নবির সঙ্গে আলোচনার পর বুঝতে পারে যে, এতদিন যাবৎ ভুল আকিদা অনুযায়ী সূূূর্যের এবাদত করত। অতঃপর মহান আল্লাহর প্রতি ইমান আনেন এবং আল্লাহর নিকট দোয়া করেন:
رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسي‏ وَ أَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعالَمينَ
হে আমার রব্‌! আমি আমার নিজের উপর জুলুম করেছি। আমি সুলাইমানের সহিত বিশ্বের প্র্রতিপালক আল্লাহর প্রতি ইমান আনলাম। (সুরা: আন্‌ নামল, ৪৪।)

শিক্ষা
১) আল্লাহর প্রতি ইমান এনে মুমিন হওয়ার প্রধান শর্ত হচ্ছে গর্ব ও অহঙ্কার দূর করতে হবে।
২) নবিগণের হুকুমতের উদ্দেশ্য দেশের বিস্তৃতি ঘটানো নয়। বরং তাঁদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের হেদায়াত ও মুক্তি।
৩) ইমানের ভিত্তিই হচ্ছে আত্মসমর্পণ।

বনিইসরাইলদের দোয়া
হজরত মুসা (আঃ) তাঁর ভাই হজরত হারুনকে (আঃ) স্থলাভিষিক্ত করে কিছুসংখ্যক সাহাবাকে নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে তুরপর্বতে গমন করেন। হজরত হারুন (আঃ) অত্যন্ত যত্নসহকারে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন এবং জনগণকে পথর্নিদেশনা দেন।
একটি গ্রুপ ইমান এনে হজরত মুসার (আঃ) সঙ্গে যোগদান করলেও তাদের ধৈর্য ও স্থিরতা ছিল না। তাদের ইমান অত্যন্ত দুর্বল ছিল। বিভিন্ন অজুহাতের মাধ্যমে হজরত মুসা ও হজরত হারুনকে (আঃ) কষ্ট দিত। হজরত মুসা (আঃ) তুরপর্বতে চলে গেলে এদের ইমান আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। অপরদিকে সামেরি নামক এক ব্যক্তি ইমানদারদেরকে বিচ্যুত করার জন্যে অলঙ্কার সজ্জিত একটি গরুর বাছুর তৈরী করে। ফলে অনেক দুর্বল ইমানের লোকেরা সে বাছুরটিকে উপাসনা করতে লাগে। কিন্তু হজরত মুসা (আঃ) ফিরে আসার পর, তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে ও অনুনয়-বিনয়ের সহিত আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করে। যথা:
قالُوا لَئِنْ لَمْ يَرْحَمْنا رَبُّنا وَ يَغْفِرْ لَنا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخاسِرين‏
তারা বলল, 'যদি আমাদের রব্‌ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন এবং আমাদেরকে ক্ষমা না করেন তাহলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হব।' (সুরা: আল্‌ আ'রাফ, ১৪৯।)
উল্লেখযোগ্য বিষয় এইযে, হজরত মুসা (আঃ) - এর উম্মতের একটি ভালদিক হচ্ছে, ভুল বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তওবা করেছিল এবং অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিল। কিন্তু আমরা অনেক সময় নিজদের ভুল বুঝার চেষ্টাই করিনা বা ভুল বুঝতে পেরেও সে ভুলকে সংশোধন করিনা। বরং সেটাকেই সঠিকরূপ দেওয়ার চেষ্টা করি যা আদৌ ঠিক নয়।

হাওয়ারিগণের দোয়া
বনিইসরাইল অত্যন্ত বাহানাকারী জাতি ছিল। হজরত ইসা (আঃ) - এর অনেক মুজিজা দেখেও তাঁর প্রতি ইমান আনেনি। পরিশেষে হজরত ইসা (আঃ) তাদের কুফরি উপলব্ধি করতে পেরে ঘোষণা করেন: 'কারা আছে, আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্য করবে?' হওয়ারিগণ বলল: 'আমরা আল্লাহর পথে সাহায্যকারী হব। আমরা আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছি। আপনি সাক্ষী থাকুন, আমরা আত্মসমর্পণকারী।' অতঃপর হাত তুলে এই দোয়া করেন:
رَبَّنا آمَنَّا بِما أَنْزَلْتَ وَ اتَّبَعْنَا الرَّسُولَ فَاكْتُبْنا مَعَ الشَّاهِدينَ
হে আমাদের রব্‌! আপনার নাজিলকৃত বস্তুর প্রতি আমরা ইমান এনেছি এবং আপনার রসুলের আনুগত্য করেছি। অতএব, আমাদেরকে মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নিন।

শিক্ষা
১) ইমানের শর্ত হচ্ছে নবির আনুগত্য স্বীকার করা।
২) মুমিন হতে হলে আল্লাহর সব নির্দেশই পালন করতে হবে।
৩) সব সময় আল্লাহর নিকট দোয়া করতে হবে যেন ইমানের উপর সাবেতকদম (দৃঢ়পদ) থাকতে পারি।

তালুতের সেনাবাহিনীর দোয়া
পবিত্র কোরআনে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে তারমধ্যে একটি হচ্ছে 'তালুত ও জালুতের' ঘটনা। আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তালুতকে মোমেনদের প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। তালুতের বাহিনী, অত্যাচারী ও কাফের জালুতের বাহিনীর সঙ্গে মোকাবিলার জন্যে যুদ্ধের মাঠে মুখোমুখি দাঁড়ান। এমতাবস্থায় তালুতের মোমেন বাহিনী আল্লাহর নিকট হাত তুলে দোয়া করেন:
رَبَّنا أَفْرِغْ عَلَيْنا صَبْراً وَ ثَبِّتْ أَقْدامَنا وَ انْصُرْنا عَلَى الْقَوْمِ الْكافِرين
হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে ধৈর্য দান কর, আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখ এবং আরাদেরকে কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য দান কর। (সুরা: আল্‌ বাক্বারা, ২৫০।)

হজরত মরিয়মের (আঃ) মাতার দোয়া
হান্না ছিলেন ইমরানের স্ত্রী। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই অত্যন্ত পরহেজগার ছিলেন। হান্না গর্ভবতী হওয়ার পর মানত করেছিলেন যে, তাঁর এ সন্তানকে 'বায়তুল মোকাদ্দাসের' খেদমতের জন্যে উৎসর্গ করবেন। অবশ্য হান্নার ধারণা ছিল যে, পুত্রসন্তানের মা হবেন। কিন্তু সন্তান প্রসবের পর দেখতে পেলেন যে, তাঁর কন্যাসন্তান হয়েছে। সন্তানের নাম রাখলেন মরিয়ম। হজরত জাকারিয়া (আঃ) শিশু মরিয়মকে লালন-পালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। মরিয়মের মাতা হান্নার দোয়া, মহান আল্লাহ নিম্নোক্তরূপে উল্লেখ করেছেন:
رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ ما في‏ بَطْني‏ مُحَرَّراً فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنْتَ السَّميعُ الْعَليم ‏
হে আমার রব্‌! আমার উদরে যে সন্তান আছে তা একান্ত আপনার জন্যে উৎসর্গ করলাম। সুতরাং আমার পক্ষ থেকে আপনি তাকে কবুল করেন। নিশ্চয় আপনি শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। (সুরা: আলে ইমরান, ৩৫।)

শিক্ষা
১) একজন মহিলা আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারেন যে, বছরের পর বছর অপেক্ষা করে সন্তানের মা হবার পর, তাঁর একমাত্র সন্তানকে আল্লাহর ঘরের খেদমতের জন্যে উৎসর্গ করে দেন।
২) মসজিদের খেদমত এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, আল্লাহর প্রিয় বান্দারা সন্তান জন্মগ্রহণের পূর্বেই, খেদমতের জন্যে মানত করেন।
৩) আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করতে হলে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি উৎসর্গ করা উচিত।

হজরত আসিয়ার দোয়া
হজরত আসিয়া ছিলেন ফেরাউনের স্ত্রী। ফেরাউন নিজেকে খোদা হিসাবে উপস্থাপন করেছিল, কিন্তু হজরত আসিয়া তাকে খোদা হিসাবে কবুল করেন নি। কেননা হজরত আসিয়া ছিলেন তৌহিদে বিশ্বাসিনী। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাঁকে প্রিয়বান্দি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
যখন ফেরাউন জানতে পারে যে, আসিয়া একমাত্র মহান আল্লাহর এবাদত করেন। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও সামনে মাথানত করতে রাজী নন, তখন আসিয়াকে নির্যাতন করার নির্দেশ দেয়। ফেরাউনের নির্যাতনে শেষপর্যন্ত আসিয়া মৃত্যুবরণ করেন। নিষ্ঠুর ফেরাউনের নির্যাতনে প্রাণত্যাগ করার পূর্বমুহূর্তে মহান আল্লাহর নিকট নিম্নোক্তভাবে দোয়া করেন:
رَبِّ ابْنِ لي‏ عِنْدَكَ بَيْتاً فِي الْجَنَّةِ وَ نَجِّني‏ مِنْ فِرْعَوْنَ وَ عَمَلِهِ وَ نَجِّني‏ مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمينَ
হে আমার রব্‌! আপনার সন্নিকটে জান্নাতের মধ্যে আমার জন্যে একখানা ঘর নির্মাণ করুন, আমাকে উদ্ধার করুন ফেরাউন ও তার দুষ্কৃতি হতে এবং আমাকে উদ্ধার করুন জালেম সম্প্রদায় হতে। (সুরা: আত্‌ তাহরিম, ১১।)
আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক পরিচিতি থাকলে এবং পরকালীন জীবন বা স্থায়ী জীবন সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে, পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ী ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ সবকিছুই তুচ্ছ মনে হবে। হজরত আসিয়া তৎকালের সবচেয়ে বড় বাদশার স্ত্রী ছিলেন। পার্থিব জীবনের নাজ-নিয়ামতের কোনো অভাব ছিল না। তারপরও সবকিছু ত্যাগ করেছেন এবং নজিরবিহীন শাস্তিভোগ করেছেন। কিন্তু আল্লাহর সহিত কাউকে শরীক করেন নি। সবকিছু ত্যাগ করেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন।

ফেরাউনের জাদুকরদের দোয়া
ফেরাউন হজরত মুসা (আঃ) - এর মোজেজাকে জাদু মনে করে। ফলে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে হজরত মুসা (আঃ) - এর সঙ্গে মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফেরাউন সবচেয়ে প্রসিদ্ধ জাদুকরদেরকে একত্রিত করে এবং তাদেরকে ওয়াদা দেয় যে, যদি মুসাকে পরাজিত করতে পারে তাহলে তাদেরকে বিশেষ পুরস্কার দেবে।
দেশের সমস্ত জনগণকে এক নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেয়। জনগণের সম্মুখে ফেরাউনের জাদুকররা এমন কিছু আশ্চর্যজনক কাজ আন্‌জাম দেয়, যাতেকরে হজরত মুসা (আঃ) অবাক হয়ে যান। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা হজরত মুসাকে (আঃ) আহ্বান করে বলেন, 'হে মুসা! ভয় পেয়ও না। তোমার হাতের লাঠি নিক্ষেপ কর।'
হজরত মুসা (আঃ) আল্লাহর র্নিদেশে তাঁর হাতের লাঠি নিক্ষেপ করেন। লাঠিখানা বিরাট অজগরে পরিণত হয় এবং জাদুকরদের সাপগুলোকে খেয়ে ফেলে। জাদুকররা পরাজিত হয়ে, মাথানত করে সেজদায় পড়ে এবং আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়। তারা হজরত মুসা ও হজরত হারুনকে (আঃ) সত্য নবি বলে ঘোষণা করে।
ফেরাউন অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে জাদুকরদেরকে হত্যার হুমকি দেয়। জাদুকররা ঘোষণা করেন যে, আমরা আল্লাহর নবি মুসার (আঃ) মোজেজা দেখেছি এবং ইমান এনেছি। আমরা তোমাকে আর খোদা হিসেবে মানি না এবং ভয়ও করি না। এরপর তাঁরা আল্লাহর নিকট দু'হাত তুলে দোয়া করেন:
رَبَّنا أَفْرِغْ عَلَيْنا صَبْراً وَ تَوَفَّنا مُسْلِمين ‏
হে আমাদের রব্‌! আমাদেরকে ধৈর্য দান করুন এবং আমাদেরকে মুসলমান হিসাবে মৃত্যু দান করুন। (সুরা: আল্‌ আ'রাফ, ১২৬।)
ইমান গ্রহণকারী জাদুকররা জানতেন যে, ইমান আনার কারণে তাঁদেরকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু তারপরও তাঁরা সত্যকে গ্রহণ করলেন এবং পার্থিব জীবনের উপর আখেরাতের স্থায়ী শান্তিকে প্রাধান্য দিলেন।

বনিইসরাইলের মোমিন ব্যক্তিদের দোয়া
হজরত মুসা ও হজরত হারুন (আঃ) বনিইসরাইলদের মাঝে তাওহিদের দাওয়াত দেন। কিন্তু অল্পসংখ্যক লোক ব্যতীত আর কেউ ইমান আনে নি। কেননা ফেরাউনের অত্যাচারী শাসনব্যবস্থা তাঁদের দাওয়াতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যারা ইমান আনেন তাঁরা জালেমদের জুলুম হতে মুক্তি চেয়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন:
رَبَّنا لا تَجْعَلْنا فِتْنَةً لِلْقَوْمِ الظَّالِمين * وَ نَجِّنا بِرَحْمَتِكَ مِنَ الْقَوْمِ الْكافِرين‏
হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে জালেম সম্প্রদায়ের নির্যাতনের পাত্র করো না। আমাদেরকে তোমার অনুগ্রহে কাফের সম্প্রদায় হতে মুক্তি দাও। (সুরা: ইউনুস, ৮৫-৮৬।)
মোজাহিদগণের দোয়া
মোজাহিদগণ দীনরক্ষার জন্যে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মহান আল্লাহ তাঁদেরকে মনোবল, ধৈর্য ও দৃঢ়তা দান করেন এবং তাওয়াক্কুল (আল্লাহর প্রতি ভরসা) ও তাআব্বুদ (আল্লাহর এবাদত) তাঁদের মাঝে প্রাণবন্ত রাখেন। তারা নিম্নোক্তভাবে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন:
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنا ذُنُوبَنا وَ إِسْرافَنا في‏ أَمْرِنا وَ ثَبِّتْ أَقْدامَنا وَ انْصُرْنا عَلَى الْقَوْمِ الْكافِرينَ
হে আমাদের রব্‌! আমাদের গোনাহসমূহ এবং আমাদের কার্যে সীমাতিক্রমকে মাফ কর, আমাদের পা সুদৃঢ় রাখ এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য কর। (সুরা: আলে ইমরান, ১৪৭।)
বর্তমান যুগে কাফেরদের সহিত অস্ত্রের যুদ্ধের চেয়ে সাংস্কৃতিক যুদ্ধই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা অস্ত্রের যুদ্ধের চেয়ে সাংস্কৃতিক যুদ্ধই বেশী ভয়ানক। আজ আগ্রাসনকারীরা জনসেবা ও শান্তিস্থাপনের নামে, সাংস্কৃতিক কাজের মাধ্যমে যুবক-যুবতীদের চরিত্র ধ্বংস করছে। সামাজিক অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। লজ্জা-শরম কেড়ে নিচ্ছে যা মুসলিম সমাজ ও পরিবারের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পোড়া বাগানের মালিকের দোয়া
ইয়েমেন দেশে একজন ইমানদার ব্যক্তি জীবনযাপন করতেন। তিনি অনেক বড় বাগান এবং আবাদি জমির মালিক ছিলেন। গাছ হতে ফলনামানোর সময় এবং ফসলকাটার সময় দরিদ্র লোকেরা জমা হত এবং সেই ইমানদার ব্যক্তির নিকট সাহায্য পেয়ে উপকৃত হত।

একদা সে মোমিন ব্যক্তির ইন্তেকাল হয়। অতঃপর তার সন্তানরা বাগানটির মালিক হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, এবার ফলনামানোর সময় দরিদ্রদেরকে কোনোরূপ সাহায্য করবে না। তারা অতিভোরে বাগানে যাবে। দরিদ্র লোকেরা টের পাওয়ার আগেই ফলনামিয়ে বাড়িতে ফিরে আসবে। তারা ভুলে গিয়েছিল যে, এসবই আল্লাহর নিয়ামত। এতে দরিদ্রদেরও অংশ রয়েছে।

পরের দিন ভোরে বাগানে গিয়ে দেখে যে, সমস্ত বাগান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাদের মধ্য হতে কেউ কেউ বলে যে, এটা আমাদের বাগান নয়। আমরা ভুলকরে অন্য বাগানে এসেছি। কিন্তু তাদের মধ্য হতে বুদ্ধিমান ভাইটি বলে, 'আমি তো তোমাদেরকে বলেছিলাম যে, আল্লাহর তসবিহ পাঠ কর, আল্লাহকে স্মরণ কর এবং হকদারদের হক আদায় কর। কিন্তু তোমরা আমার কথা শোননি; ফলে এরকম হয়েছে।' অতঃপর অন্য ভায়েরা নিজদের ভুল বুঝতে পারে এবং অনুতপ্ত হয়ে বলে:

قالُوا سُبْحانَ رَبِّنا إِنَّا كُنَّا ظالِمين ‏
তারা বলল, 'আমাদের রব্‌ পবিত্র। নিশ্চয় আমরাই অপরাধী। (সুরা: আল্‌ কালাম, ২৯।)

উল্লেখ্য যে, মরহুম তাবারসি, জনাব মুজাহিদ হতে বর্ণনা করেন, 'বাগানের মালিকরা তওবা করে। তাদের তওবা কবুল হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পূর্বের চেয়েও ভাল বাগান দান করেন।' (তাফসিরে জাওয়ামেউল জামে, খঃ ৪, পৃঃ ৩৪১।)

শিক্ষা
১) মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে হোক আর অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক না কেন, ধন-সম্পদের প্রতি আগ্রহী হয়। কেননা জীবনযাপনের জন্যে ইহা অত্যন্ত জরুরী। বিধায় ধন-সম্পদের প্রতি সাধারণ আগ্রহ থাকা অপছন্দনীয় নয়। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি মনে করে যে, জীবনের সবকিছুই ধন-সম্পদের জন্যে, তাহলে তা অপছন্দনীয়। কেননা এধরনের মানুষ অর্থের জন্যে নিজের ইমান-আকিদা সবকিছু বিসর্জন দিতে পারে। একারণে আলেমগণ জুহ্‌দ বা পরহেজগারীর ব্যাখ্যায় বলে থাকেন যে, অর্থথাকা অপছন্দনীয় নয়। তবে অর্থের প্রতি আসক্ত হওয়া অপছন্দনীয়।

২) আল্লাহর ভালবাসা থাকলে ধন-সম্পদের ভালবাসা তাকে ঘিরে রাখতে পারে না। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা অর্থকে তাঁর নৈকট্য অর্জনের পথে ব্যয় করে থাকেন।

নব মুসলমানদের দোয়া
খ্রিস্টানদের মধ্য হতে একটি জ্ঞানী গ্রুপ, কোরআন শরিফ ও মহানবি (সাঃ) সম্পর্কে পরিচিত হওয়ার পর ইহার সত্যতাকে অনুধাবন করে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত খুশি হয়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন:
رَبَّنا آمَنَّا فَاكْتُبْنا مَعَ الشَّاهِدينَ
হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ইমান এনেছি; সুতরাং তুমি আমাদেরকে সাক্ষ্যবহদের তালিকাভুক্ত কর। (সুরা: আল্‌ মায়েদা, ৮৩।)

প্রত্যেক ব্যক্তিরই উচিত সত্যের সন্ধানে থাকা এবং সত্যকে বুঝার সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করা। উক্ত খ্রিস্টানদলটি সত্যের সন্ধানে ছিল, বিধায় সত্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। (তাফসিরে হেদায়াত, খঃ ২, পৃঃ ৩৮৪।)

অত্যাচারীদের কবলে পতিত ব্যক্তিদের দোয়া
মক্কা নগরীতে এমন কিছু দুর্বল মুসলমান রয়ে গিয়েছিলেন যারা দৈহিক দুর্বলতা এবং আর্থিক দৈন্যতার কারণে হিজরত করতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে কাফেররাও তাঁদেরকে হিজরত করতে বাধাদান করছিল এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতে আরম্ভ করেছিল, যাতে তাঁরা ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এসব সাহাবি নিজদের ইমানি বলিষ্ঠতার দরুন কাফেরদের অসহনীয় উৎপীড়ন সহ্যকরেও ইমানের উপর স্থির থাকেন। অবশ্য তাঁরা এসব অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে অব্যাহতির জন্যে বরাবরই আল্লাহ তাআলার দরবারে মোনাজাত করতে থাকেন। যথা:
رَبَّنا أَخْرِجْنا مِنْ هذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُها وَ اجْعَلْ لَنا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَ اجْعَلْ لَنا مِنْ لَدُنْكَ نَصيراً
হে আমাদের রব্‌! আমাদেরকে এ জনপদ - যার অধিবাসী জালিম, তা হতে অন্যত্র নিয়ে যাও। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে একজন অভিভাবক নির্ধারণ কর এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে একজন সাহায্যকারী নির্ধারণ কর। (সুরা: আন্‌ নিসা, ৭৫।)
মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে জালেমদের কবলে পতিত মুসলমানদের মুক্তির জন্যে আপ্রাণ চেষ্টাকরা।

বিজ্ঞ মোমিনগণের দোয়া
মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরআনে জ্ঞানীব্যক্তির প্রশংসা করেছেন। মোমিনব্যক্তিরা সর্বদা আল্লাহকে স্বরণ করেন এবং নিম্নোক্তভাবে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন:
رَبَّنا ما خَلَقْتَ هذا باطِلاً سُبْحانَكَ فَقِنا عَذابَ النَّارِ * رَبَّنا إِنَّكَ مَنْ تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ وَ ما لِلظَّالِمينَ مِنْ أَنْصار ٍ * رَبَّنا إِنَّنا سَمِعْنا مُنادِياً يُنادي لِلْإيمانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنا فَاغْفِرْ لَنا ذُنُوبَنا وَ كَفِّرْ عَنَّا سَيِّئاتِنا وَ تَوَفَّنا مَعَ الْأَبْرارِ * رَبَّنا وَ آتِنا ما وَعَدْتَنا عَلى‏ رُسُلِكَ وَ لا تُخْزِنا يَوْمَ الْقِيامَةِ إِنَّكَ لا تُخْلِفُ الْميعادَ
হে আমাদের রব্‌! আপনি ইহা অনর্থক সৃষ্টি করেন নি। আপনি পবিত্র, আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।
হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয় আপনি কাউকে আগুনে প্রবেশ করালে তাকে তো লাঞ্চিত করলেন। আর জালেমদের জন্যে কোনো সাহায্যকারী নেই।
হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয় আমরা এক আহ্বানকারীর (রসুলুল্লাহর) আহ্বান শ্রবণ করেছি যিনি ইমানের দিকে আহ্বান করছেন, 'তোমরা স্বীয় রবের প্রতি ইমান আন'। সুতরাং আমরা ইমান আনলাম। হে আমাদের প্রতিপালক! অতএব, আপনি আমাদের গুনাহ্‌সমূহ মাফ করুন, আমাদের খারাপ কাজগুলো দূরীভূত করুন এবং আমাদেরকে নেক্কার লোকদের সহগামী করে মৃত্যু দিন।
হে আমাদের প্রভু! আপনার রসুলগণের মাধ্যমে আমাদেরকে যা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা আমাদেরকে দিন এবং কিয়ামতের দিন আপনি আমাদেরকে অপমান করিয়েন না। নিশ্চয় আপনি ওয়াদার খেলাফ করেন না। (সুরা: আলে ইমরান, ১৯১-১৯৪।)

পুণ্যবান ব্যক্তিদের দোয়া
অনেকেই মনে করে যে, শুধু গুনাহ্‌গার ও সীমালংঘনকারী ব্যক্তিরাই আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করবে। ইমানদার ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করার কোনো অর্থ হয়না। কিন্তু এধরনের চিন্তা ঠিক নয়। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর অলিগণের ক্ষমাপ্রার্থনা করার কথা উল্লেখ রয়েছে। কেননা খোদ এস্তেগফার ও দোয়াকরা হচ্ছে একটি উত্তম এবাদত। যেমনটি আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহর অলিগণ সর্বদা নিম্নোক্তরূপে দোয়া করতেন:
رَبَّنا إِنَّنا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنا ذُنُوبَنا وَ قِنا عَذابَ النَّارِ
হে আমাদের রব্‌! আমরা ইমান এনেছি। সুতরাং আমাদের গুনাহ্‌সমূহ মাফ করুন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করুন। (সুরা: আলে ইমরান, ১৬।)

ইমান ও তাকওয়া হচ্ছে আকিদা ও আমলের সমন্বয়। ইমান ও তাওয়ার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। গুনাহ্‌ হতে দূরে থাকা এবং সৎকাজ আন্‌জাম দেওয়ার মাধ্যমে পরিপূর্ণতায় পৌঁছা সম্ভব। পরহেজগার বান্দারা সর্বদা গুনাহ্‌ মোচনের জন্যে দোয়া করেন, যাতেকরে বেশী বেশী আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করতে পারেন। (তাফসিরে আনওয়ারে দেরাখ্‌শান, খঃ ৩, পৃঃ ২৯।)

মোমেনদের প্রাত্যহিক দোয়া
সুরা ফাতেহা পবিত্র কোরআনের নির্যাস যা আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের নামাজের মাঝে পাঠ করে থাকি। এ সুরার প্রথম অংশে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা এবং দ্বিতীয় অংশে বান্দার চাওয়া বা দোয়ার উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে নিম্নোক্তভাবে দোয়া করতে শিক্ষা দিয়েছেন:
اهْدِنَا الصِّراطَ الْمُسْتَقيمَ * صِراطَ الَّذينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَ لاَ الضَّالِّينَ
(হে আমাদের রব্‌!) আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন। সে সমস্ত লোকের পথ যাদেরকে আপনি নিয়ামত দান করেছেন। তাদের পথ নয় যাদের প্রতি আপনার গজব নাজিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। (সুরা: ফাতেহা, ৬-৭।)

বিনয়ী মুসলমানদের দোয়া
বিনয়ী বান্দারা কখনই কোনো কাজে গর্ব করেন না এবং সর্বদা আল্লাহর নিকট নিম্নোক্তরূপে প্রার্থনা করেন:
رَبَّنا لا تُؤاخِذْنا إِنْ نَسينا أَوْ أَخْطَأْنا رَبَّنا وَ لا تَحْمِلْ عَلَيْنا إِصْراً كَما حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذينَ مِنْ قَبْلِنا رَبَّنا وَ لا تُحَمِّلْنا ما لا طاقَةَ لَنا بِهِ وَ اعْفُ عَنَّا وَ اغْفِرْ لَنا وَ ارْحَمْنا أَنْتَ مَوْلانا فَانْصُرْنا عَلَى الْقَوْمِ الْكافِرينَ
হে আমাদের রব্‌! আমরা যদি ভুলে যায় কিংবা ভুল করি তবে আমাদেরকে পাকড়াও করিও না। হে আমাদের রব্‌! আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেমন গুরুদায়িত্ব অপর্ণ করেছিলে আমাদের উপর তেমন দায়িত্ব অর্পণ করিও না। হে আমাদের রব্‌! আমাদের উপর এমন কোনো ভার অর্পণ করিও না যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আর আমাদের পাপমোচন কর, আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি কৃপা কর। তুমিই আমাদের অভিভাবক। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে জয়যুক্ত কর। (সুরা: বাকারা, ২৮৬।)

সর্বোচ্চ জ্ঞানীব্যক্তিগণের দোয়া
আল্লাহর মারেফত বা পরিচিতি হচ্ছে এবাদত মূল্যায়নের মাপকাঠি। আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে যার জ্ঞান যতবেশি তার এবাদতের গভীরতাও ততবেশি। যারা মহান আল্লাহ সম্পর্কে মারেফত অর্জনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার উচ্চপর্যায়ে উপনীত হয়েছেন তাদেরকে পবিত্র কোরআনের পরিভাষায় 'রাসেখুনা ফিল ইলম্‌' বলা হয়েছে। এ সর্বোচ্চ জ্ঞানীব্যক্তিগণ সর্বদা নিম্নোক্তভাবে দোয়া করেন:
رَبَّنا لا تُزِغْ قُلُوبَنا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنا وَ هَبْ لَنا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ * رَبَّنا إِنَّكَ جامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لا رَيْبَ فيهِ إِنَّ اللَّهَ لا يُخْلِفُ الْميعاد
হে আমাদের রব্‌! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্য লংঘনপ্রবণ করিও না এবং তোমার নিকট হতে আমাদেরকে অনুগ্রহ দাও। নিশ্চয়ই তুমি মহাদাতা। (সুরা: আলে ইমরান, ৮-৯।)
হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি সকল মানুষকে এমন একদিন একত্রিত করবে যাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ নির্ধারিত সময়ের ব্যতিক্রম করেন না।

নিজ এবং অপর মোমিনদের জন্যে দোয়া
আল্লাহ্‌ তাআলা সুরা হাশরের প্রথম অংশে মোহাজের ও আন্‌সারের প্রশংসা করার পর, সেইসব লোকের প্রশংসা করেন যারা রসুলের ইন্তেকালের পর পৃথিবীতে আগমন করবেন এবং ইমানদারদের দলে যোগদান করবেন। আর তাদের সার্বক্ষণিক জিক্‌র ও দোয়া হবে নিম্নোরূপ:
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنا وَ لِإِخْوانِنَا الَّذينَ سَبَقُونا بِالْإيمانِ وَ لا تَجْعَلْ في‏ قُلُوبِنا غِلاًّ لِلَّذينَ آمَنُوا رَبَّنا إِنَّكَ رَؤُفٌ رَحيمٌ
হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের সেই ভাইদেরকে যারা আমাদের পূর্বে ইমান এনেছেন। আর মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ রেখ না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো অত্যন্ত দয়ালু, পরম করুণাময়। (সুরা: আল্‌ হাশর, ১০।)

শিক্ষা:
১) সর্বদা নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে এবং ক্ষমাপ্রার্থনা ও এস্তেগফার অব্যাহত রাখতে হবে।
২) পূর্ববর্তী দীনি ভাইদের জন্যে সর্বদা দোয়া করতে হবে, ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে এবং তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।
৩) হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকতে হবে এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইতে হবে। (তাফসিরে নমুনা, খঃ ২৩, পৃঃ ৫২৩।)

চল্লিশ বছর বয়সে উন্নীত ব্যক্তির দোয়া
মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে পিতা-মাতার হক আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। মাতার গর্ভধারণ, প্রসব, দুগ্ধদান এবং সন্তান পালনের সময়ের কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন, 'তুমি যখন বড় হবে, শক্তিশালী হবে, পরিপূর্ণতায় পৌঁছবে তখন যেন পিতা-মাতাকে ভুলে যেওনা! বরং নিম্নোক্তভাবে তাঁদের জন্যে দোয়া করবে':
رَبِّ أَوْزِعْني‏ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتي‏ أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَ عَلى‏ والِدَيَّ وَ أَنْ أَعْمَلَ صالِحاً تَرْضاهُ وَ أَصْلِحْ لي‏ في‏ ذُرِّيَّتي‏ إِنِّي تُبْتُ إِلَيْكَ وَ إِنِّي مِنَ الْمُسْلِمينَ
হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও যাতে আমি তোমার শুকরিয়া আদায় করতে পারি, আমার প্রতি ও আমার পিতা-মাতার প্রতি তুমি যে অনুগ্রহ করেছ তার জন্যে এবং যাতে আমি নেককাজ করতে পারি যা তুমি পছন্দ কর; আমার জন্যে আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ কর। আমি তোমারই অভিমুখী হলাম এবং আমি অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা: আল্‌ আহ্‌কাফ, ১৫।)

উপরোক্ত আয়াত হতে বোঝা যায় যে, মানুষের জীবনে দুইবার দুই ধরনের পরিপক্বতা আসে। যথা:-

১) প্রথমবার হচ্ছে শিশু ও কিশোরকাল হতে যৌবনকালে উপনীত হওয়া। সাধারণত যৌবনকালে উপনীত হওয়ার পর প্রতিটি ব্যক্তির দৈহিক পরিপক্বতা আসে।
২) দ্বিতীয়বার হচ্ছে চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পর মানুষের জীবনে আবারও পরিপক্বতা আসে। এ পরিপক্বতা হচ্ছে বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের পরিপক্বতা। এ বয়সে উপনীত হওয়ার পর মানুষ অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকে। তাই তো হাদিসে এসেছে যে, চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পরও যদি কোনো ব্যক্তি তওবা না করে তাহলে শয়তান তার মুখমণ্ডলের উপর হাত বুলিয়ে আদর করে আর বলে, 'সাবাস তোমাকে! তুমি আর মুক্তি পাবে না'।

মুখলেস বান্দাদের দোয়া
পবিত্র কোরআনে এসেছে, মহান আল্লাহ্‌ জাহান্নামিদেরকে বলবেন, 'আমার মুখলেস বান্দারা আমার নিকট দোয়া করত কিন্তু তোমরা তাদেরকে ঠাট্টা করতে।' এ মুখলেস বান্দাদের দোয়া নিম্নোরূপ:
رَبَّنا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنا وَ ارْحَمْنا وَ أَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمينَ
হে আমাদের রব্‌! আমরা ইমান এনেছি, সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, আর তুমিই সর্র্বোত্তম অনুগ্রহকারী। (সুরা: আল্‌ মুমিনুন, ১০৯।)

কিয়ামত দিবসে মোমিনদের দোয়া
কিয়ামত দিবসে আল্লাহ্‌ তাআলা মোমিনগণকে বিশেষ সম্মানে সম্মানিত করবেন এবং একপ্রকার নুর দান করবেন। ফেরেস্তাগণ মোমিনগণকে বেহেস্তের পথ দেখাবেন। মোমিনগণ বেহেস্তের দিকে এগিয়ে যাবেন এবং দোয়া করবেন:
رَبَّنا أَتْمِمْ لَنا نُورَنا وَ اغْفِرْ لَنا إِنَّكَ عَلى‏ كُلِّ شَيْ‏ءٍ قَدير
হে আমাদের রব্‌! আমাদের নুরকে পূর্ণতা দাও এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। (সুরা: আত্‌ তাহরিম, ৮।)

মোমিনদের জন্যে ফেরেস্তাগণের দোয়া
আল্লাহর আরশ বহনকারী ফেরেস্তাগণ সর্বদা মহান আল্লাহর তসবিহ পাঠ করেন এবং মোমিন বান্দাদের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে দোয়া করেন:
رَبَّنا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْ‏ءٍ رَحْمَةً وَ عِلْماً فَاغْفِرْ لِلَّذينَ تابُوا وَ اتَّبَعُوا سَبيلَكَ وَ قِهِمْ عَذابَ الْجَحيمِ * رَبَّنا وَ أَدْخِلْهُمْ جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتي‏ وَعَدْتَهُمْ وَ مَنْ صَلَحَ مِنْ آبائِهِمْ وَ أَزْواجِهِمْ وَ ذُرِّيَّاتِهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزيزُ الْحَكيمُ * وَ قِهِمُ السَّيِّئاتِ وَ مَنْ تَقِ السَّيِّئاتِ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهُ وَ ذلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظيم
হে আমাদের পালনকর্তা! তোমার রহমত ও জ্ঞান সর্র্বব্যাপী। সুতরাং যারা তওবা করে ও তোমার পথের অনুসরণ করে তাদেরকে তুমি ক্ষমা কর এবং তাদেরকে দোজখের আজাব হতে রক্ষা কর।
হে আমাদের পালনকর্তা! তাদেরকে তুমি অনন্তকাল বসবাসের জান্নাতে প্রবেশ করাও যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদেরকে দিয়েছ এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী এবং সন্তান-সন্ততির মধ্যে যারা সৎকাজ করেছে তাদেরকেও। নিশ্চয় তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
আর তুমি তাদেরকে শাস্তি হতে রক্ষা কর, সেদিন তুমি যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবে, তাকে তো অনুগ্রহই করবে; আর ওটা তো মহাসাফল্য। (সুরা: মুমিন, ৭-৯।)

পিতা-মাতার জন্যে দোয়া
সন্তানের উপর পিতা-মাতার অনেক অধিকার রয়েছে। মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে তাঁদের অধিকার বাস্তবায়ন করার জন্যে সন্তানদের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন এবং পিতা-মাতার জন্যে নিম্নোক্তভাবে দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন:
رَبِّ ارْحَمْهُما كَما رَبَّياني‏ صَغيرا
হে আমার রব্‌! তুমি তাঁদের উভয়ের (পিতা-মাতা) প্রতি দয়া কর যেরূপে তাঁরা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। (সুরা: বনিইসরাইল, ২৪।)
ইমাম সাদিক (আঃ) বলেন: পিতা-মাতাকে মেহেরবানি ও আন্তরিকতা ব্যতীত দর্শন করো না। তাঁদের সহিত উচ্চস্বরে কথা বলো না। তাঁদের হাতের উপর তোমাদের হাত রেখো না এবং তাঁদের সামনে দিয়ে পথ চলো না। (মাজমাউল বায়ান ফি তাফসিরিল কোরআন, খঃ ৬, পৃঃ ৬১৩।)
ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: 'যে সেবা-যত্নকারীপুত্র স্বীয় পিতা-মাতার দিকে দয়া ও ভালবাসা সহকারে দৃষ্টিপাত করে, তার প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে সে একটি কবুল হজ্জের সওয়াব পায়।' লোকেরা আরজ করল, 'সে যদি দিনে একশবার এভাবে দৃষ্টিপাত করে?' তিনি বল্লেন: 'হ্যাঁ, একশবার দৃষ্টিপাত করলেও প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে এই সওয়াব পেতে থাকবে। সুবহানাল্লাহ, তাঁর ভাণ্ডারে কোনো অভাব নেই।' (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, পৃঃ ৭৭১।)
যানবাহনে আরোহণের দোয়া
পবিত্র কোরআন বিভিন্নভাবে মানুষের ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করে মহান আল্লাহর সহিত সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছে। যানবাহন এমন একটি নিয়ামত যা মানুষের জীবনের বিস্তৃতি ঘটার জন্যে অতীব জরুরী। এ কারণে ইহা সর্বকালেই মানুষের নিকট অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে। তাছাড়া মানুষ যানবাহনকে দ্রুতগামী ও আরামদায়ক করার জন্যে অনেক চেষ্টা চালিয়েছে এবং প্রচুর সফলতাও অর্জন করেছে। এ বিশেষ নিয়ামতে আরোহণ করার সময় পবিত্র কোরআনে বিশেষ দোয়ার উল্লেখ রয়েছে। যথা:
سُبْحانَ الَّذي سَخَّرَ لَنا هذا وَ ما كُنَّا لَهُ مُقْرِنينَ * وَ إِنَّا إِلى‏ رَبِّنا لَمُنْقَلِبُونَ
তিনি পবিত্র যিনি একে আমাদের বশীভূত করেছেন (তাছাড়া) আমরা তো একে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না। আর আমরা অবশ্যই আমাদের পালনকর্তার দিকে ফিরে যাব। (সুরা: আজ্জুখরুফ, ১৩-১৪।)

দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্যে দোয়া
মোমিন ব্যক্তিরা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্যে সর্বদা নিম্নোক্তরূপে দোয়া করে থাকেন:
رَبَّنا آتِنا فِي الدُّنْيا حَسَنَةً وَ فِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَ قِنا عَذابَ النَّار
হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দাও এবং আখেরাতেও কল্যাণ দাও। আর আমাদেরকে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা কর। (সুরা: আল্‌ বাকারা, ২০১।)
এ দোয়ার ফজিলত সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবি (সাঃ) একজন রোগীর নিকট গিয়ে দেখেন যে, সে রোগের কারণে কষ্টভোগ করছে। মহানবি (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, 'তুমি কি দোয়া করেছ? আল্লাহর নিকট হতে কিছু চেয়েছ?' রোগী বলে, 'জি হ্যাঁ, এভাবে আল্লাহর নিকট দোয়া করেছি: হে আল্লাহ! তুমি যদি আখেরাতে আমাকে শাস্তি দিতে চাও তাহলে তার পরিবর্তে এ দুনিয়াতেই আমাকে শাস্তি দাও।' মহানবি (সাঃ) বলেন, 'সুবহানাল্লাহ! তুমি এ ধরনের আজাব সহ্য করতে পারবে না। কেন এভাবে দোয়া করনি?' অতঃপর তিনি (সাঃ) নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন।
رَبَّنا آتِنا فِي الدُّنْيا حَسَنَةً وَ فِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَ قِنا عَذابَ النَّار
উক্ত রোগীটি এভাবে দোয়া করার পর আল্লাহ তাআলা তাকে সুস্থতা দান করেন।
 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন