ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের বৈশিষ্টসমূহ

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের বৈশিষ্টসমূহ

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের বৈশিষ্টসমূহ

ইমাম মাহদী, মাসুম, রাসূল, বিহারুল আনওয়ার, ইমাম আলী, ফাতিমাতুয্ যাহরা, ইমাম হাসান আসকারী, ইমাম, মুসা, ঈসা, আল্লাহ, ইমাম হুসাইন, ইমাম সাজ্জাদ, ইমাম বাকের, ইমাম জাফর সাদিক, ইমাম কাযিম, ইমাম মুসা রেযা, ইমাম তাকি আল জাওয়াদ, ইমাম হাদী, হাসান আসকারী

পূর্ববর্তী অধ্যায় সমূহে আমরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের উদ্দেশ্য, সাফল্য বা অবদান সম্পর্কে কথা বলেছি৷এখর আমরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন: হুকুমতের পরিধি, ও তাররাজধানী, হুকুমতের সময় সীমা ও তার কার্যপদ্ধতি ও তার পরিচয় এবং মহান নেতারচারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করব৷

১) - হুকুমতের পরিধি ও তার রাজধানী
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমত হচেছ বিশ্বজনীন৷ কেননা তিনি হচেছন সমগ্র মানব জাতিরমুক্তিদাতা ও তাদের সকল আশার বাস্তবায়নকারী৷ সুতরাং তাঁর হুকুমতের সকল সৌন্দর্য,সৎকার্য ও সুফল সারা বিশ্বকে আচছন্ন করবে৷ এ সত্য বিভিন্ন রেওয়াত থেকে আমাদের সামনেস্পষ্ট হয়ে যায়, নিম্নে তার কিছু উদাহরণ দেওয়া হল:

ক)- অধিক সংখ্যক রেওয়ায়াতেবর্ণিত হয়েছে: পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচারে পরিপূর্ণ হওয়ার পর ইমাম মাহ্দী (আ.) পূনরায়পৃথিবীকে ন্যায়-নীতিতে পূর্ণ করবেন (কামালুদ্দিন, আয়াত বাব ২৫, হাঃ৪ এবং বাব ২৪ হাঃ১ ও ৭)৷الارضবা মাটি শব্দের অর্থ সমগ্র পৃথিবী এবং সেটাকেপৃথিবীর কিছু অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার কোন দলিল আমাদের কাছে নেই৷

খ)- যে সকল রেওয়ায়াতেপৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে সে সকল স্থানেরগুরুত্ব ও ব্যাপকতা থেকে বোঝা যায় যে, তিনি সমগ্র বিশ্বের উপর হুকুমত করবেন৷রেওয়ায়াতে যে সকল শহর ও দেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা কেবল উদাহরণ মাত্র এবংরেওয়ায়াতে সে সময়ের মানুষের উপলব্ধির দিকেও দৃষ্টি রাখা হয়েছে৷
বিভিন্ন রেওয়ায়াতে বর্ণিতহয়েছে যে, ইমাম মাহ্দী (আ.) চীন, রোম, দেইলাম, তুরস্ক, সিন্ধু, ভারত, কাসতানতানিয়াএবং কাবুল বিজয় করবেন (গাইবাতে তুসী এবং ইহতিজাজে তাবরাসী )৷

বলাবাহুল্য যে, ইমামদেরযুগ এই সকল এলাকার পরিধি অনেক বেশী ছিল যেমন: রোম বলতে সমগ্র ইউরোপ এমনকি আমেরিকারকিছু অংশকেও বোঝানে হয়েছে৷ চীন বলতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন: জাপান, করিয়াইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে৷ অনুরূপভাবে ভারত বলতে ভারত উপমহাদেশকে বোঝানো হয়েছে৷কাসতাননিয়া বা ইসতামবুল সে সময়ে বিশেষ গুরুত্বের অধিকারি ছিল এবং তা বিজয় করা অতিগৌরবের বিষয় ছিল৷ কেননা, তা ইউরোপে প্রবেশ করার একটি প্রধান কোরিডোর ছিল৷
মোটকথা বিশ্বেরগুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহের বিজয়ই হচেছ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্বজনীন হুকুমতেরপরিচায়ক৷

গ)- প্রথম ও দ্বিতীয়শ্রেণীর রেওয়ায়াত ছাড়াও আরও অনেক রেওয়ায়েত রয়েছে যা থেকে বোঝা যায় যে, ইমাম মাহ্দী(আ.)-এর হুকুমত বিশ্বজনীন৷
রাসূল (সা.) বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন: আমি তাদের (বার ইমামের) মাধ্যমে ইসলামকে সকল দ্বীনের উপরজয়যুক্ত করব এবং তাদের মাধ্যমে আমার নির্দেশকে বাস্তবয়ন করব৷ আার সর্বশেষ জনের(ইমাম মাহ্দীর) মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করব এবং তাকে প্রাচ্য ওপ্রাশ্চাত্যের অধিপতি করব (কামালুদ্দিন খণ্ড- ১, বাব ২৩, হাঃ ৪, পৃ.-৪৭৭)৷

ইমাম বাকের (আ.)বলেছেন:
القائم منا يبلغ سلطانه المشرق و المغرب و يظهر الله عزوجل به دينه علی الدين کله ولوکره المشرکون

কায়েম হচেছ রাসূল (সা.)-এরবংশ থেকে এবং তিনি প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের অধিপতি হবেন, আল্লাহ তাকে অপর সমস্তদ্বীনের উপর জয়যুক্ত করবেন, মুশরিকরা অপ্রীতিকর মনে করলেও (কামালুদ্দিন খণ্ড- ১, বাব ২৩, হাঃ ১৬, পৃ.-৬০৩)৷

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এরহুকুমতের রাজধানী হচেছ ঐতিহাসিক কুফা শহর৷ সে সময়ে কুফার পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে এবংনাজাফও কুফার মধ্যে পড়বে আর সে কারণেই কিছু কিছু হাদীসে নাজাফকে ইমাম মাহ্দী(আ.)-এর হুকুমতের রাজধানী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে৷

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)বলেছেন: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের রাজধানী হচেছ কুফা শহর এবং বিচার কার্যেরস্থান হচেছ কুফার মসজিদ (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫৩, পৃ.-১১)৷

বলাবাহুল্য যে, কুফা শহরবহু দিন আগে থেকেই রাসূল (সা.)-এর বংশের নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ আলী (আ.)সেখানে হুকুতম করতেন, কুফার মসজিদ ইসলামের চারটি নামকরা মসজিদের একটি সেখানে হযরতআলী (আ.) নামাজ পড়াতেন, খোৎবা দিতেন, বিচার করতেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি ঐ মসজিদেরমেহ্রাবে শাহাদত বরণ করেন৷

২) - হুকুমতের সময়সীমা
দীর্ঘ দিন ধরে মানুষ জালেমও অত্যাচারী শাসকদের হুকুমতের মধ্যে থাকার পর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবেরমাধ্যমে পৃথিবী ভালর দিকে ধাবিত হবে৷ তখন সৎকর্মশীলদের মাধ্যমে পৃথিবী পরিচালিত হবেএবং এটা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি যা অবশ্যই বাস্তবাইত হবে৷
সৎকর্মশীলদের হুকুমত যাইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নেতৃত্বে শুরু হবে এবং দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং আরকখনোই জালেমদের হুকুমত আসবে না৷
হাদীসে কুদসীতে আরও বর্ণিতহয়েছে: ইমাম মাহ্দী হুকুমতে অধিষ্টিত হওয়ারপরতাকিয়ামতপর্যন্তচলতে থাকবে এবং এহুকুমত আল্লাহর ওয়ালী ও তাঁদের বন্ধুদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে (কামালুদ্দিন, খণ্ড-১, বাব ২৩,হাঃ ৪, পৃ.-৪৭৭৷

সুতরাং ইমাম মাহ্দী (আ.)যে, ন্যায়পারায়ণ হুকুমত গড়ে তুলবেন তা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে৷ তারপর আর কোনসরকার আসবে না এবং প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে,যেখানেসকলেই ঐশী হুকুমতের ছত্রছায়ায় জীবন-যাপন করবে৷
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন:আমাদের সরকার শেষ সরকার, অন্য সকলেই আমাদের পূর্বে রাজত্ব করবে৷ কাজেই আমাদেরশাসনব্যাবস্থা দেখে আর কেউ বলতে পারবে না যে, আমরা থাকলেও ঠিক এভাবেই শাসন করাতাম(গাইবাতে তুসী, অধ্যায়-৮, হাঃ ৪৯৩, পৃ.-৪৭২)৷

সুতরাং আবির্ভাবের পর থেকেঐশী হুকুমত কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর জীবনের শেষপর্যন্ত হুকুমত করবেন৷
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এরহুকুমতের সময় সীমা এতটা হতে হবে যে, তিনি সে সময়ের মধ্যে পারবেন পৃথিবীকেন্যায়নীতিতে পরিপূর্ণ করতে৷ কিন্তু এ উদ্দেশ্য কয় বছরের মধ্যে সাধিত হবে তা ধারণাকরে বলা সম্ভব নয়৷ এ জন্য পবিত্র ইমামদের হাদীসের স্মরণাপন্ন হতে হবে৷ তবে ইমামমাহ্দী (আ.)-এর যোগ্যতা, আল্লাহর সাহায্য, যোগ্য সাথী, পৃথিবীর মানুষের প্রস্তুতিসব মিলিয়ে খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি তাঁর মহান উদ্দেশ্যে উপনীত হবেন৷ যুগ যুগ ধরেমানুষ যা অর্জন করতে পারে নি ইমামমাহ্দী (আ.) ১০ বছরের কম সময়ে তা অর্জনকরবেন৷
যে সকল রেওয়ায়াতে ইমামমাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের সময়সীমা বর্ণিত হয়েছে তা বিভিন্ন ধরনের৷ কিছু হাদীসে ৫বছর, কিছুতে ৭ বছর, কিছুতে ৮/৯ বছর, কিছুতে ১০বছর উল্লেখ করা হয়েছে৷ কয়েকটিরেওয়ায়াতে ১৯ বছর কয়েক মাস এমনকি কোন কোন হাদীসে ৪০ থেকে ৩০৯ বছর পর্যন্ত উল্লেখকরা হয়েছে (চেশম আন্দাযী বে হুকুমাতে মাহ্দী (আ.), নাজমুদ্দিন তাবাসী, পৃ.-১৭৩-১৭৫)৷

তবে রেওয়ায়াতে এ ভিন্নতারকারণ আমাদের কাছে স্পষ্ট নয় এবং এত রেওয়ায়াতের মধ্য থেকে সঠিক সময় নির্ধারণ করা অতিকঠিন ব্যাপার৷ তবে বড় বড় আলেমগণ ৭ বছরকে নির্বাচন করেছেন (আল মাহদী,সাইয়্যেদসাদরুদ্দিন সাদর পৃ.-২৩৯, তারিখে মা বায়দে জহুর, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ সাদর)৷

অনেকে আবার বলেছেন ইমামমাহ্দী (আ.) ৭ বছর হুকুমত করবেন কিন্তু তাঁর হুকুমতের প্রতি এক বছর বর্তমান বছরের১০ বছরের সমান৷
রাবি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এরহুকুমতের সময়সীমা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন: ইমাম মাহ্দী(আ.) ৭ বছর হুকুমত করবেন তবে তা বর্তমান বছরের ৭০ বছরের সমান (গাইবাতে তুসী, অধ্যায়৮, হাঃ ৪৯৭, পৃ.-৪৭৪)৷

মরহুম মাজলিসী (রহ.)বলেছেন: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের সময়সীমা সম্পর্কে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছেতার প্রতি দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন মনে করছি: কিছুতে হুকুমতের পরের সময়কে বোঝানোহয়েছে৷ কিছুতে হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়কে বোঝানো হয়েছে৷ কিছুতে বর্তমান বছর ওমাসের কথা বলা হয়েছে এবং কিছুতে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সময়ের বছর ও সময়কে বুঝানোহযেছে, হকিকত আল্লাহই জানেন (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড- ৫২, পৃ.-২৮০)৷

৩)- ইমামের হুকুমতের আদর্শ
প্রতিটি শাসকই তার হুকুমতপরিচালনার জন্য একটি বিশেষ আদর্শ মেনে চলে যা তার হুকুমতের নিদর্শন৷ ইমাম মাহ্দী(আ.)-এরও রাষ্ট্র পরিচালনার একটি বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে৷ যদিও এর পূর্বে ইমামেররাষ্ট্র পরিচালন পদ্ধতির উপর কিছু ইঙ্গিত করা হয়েছে কিন্তু বিষয়টির গুরুত্বের জন্যস্বতন্ত্রভাবে এ বিষয়ের প্রতি এখানে আলোচনা করা হল৷ আর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতসম্পর্কে আরও ভাল করে জানার জন্য রাসূল (সা.) ও পবিত্র ইমামগণের বাণীর দিকে দৃষ্টিদিব৷
প্রথমে যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হল রেওয়ায়াতের আলোকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আদর্শের যে চিত্রবর্ণিত হয়েছে তারাসূল (সা.)-এর আদর্শ ও পদ্ধতিরই অনুরূপ৷ রাসূল (সা.)যেভাবে অজ্ঞদের সাথে সংগ্রাম করেছিলেন এবং চিরন্তন ইসলাম যা দুনিয়া ও আখেরাতেরসৌভাগ্যের সোপান তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ ইমাম মাহদী (আ.)ও তাঁর আবির্ভাবের মাধ্যমেআধুনিক অজ্ঞতার সাথে যা কিনা রাসূল (সা.)-এর সময়ের অজ্ঞতার চেয়েও বেশী ভয়ঙ্কর তারসাথে সংগ্রাম করবেন এবং ইসলামী ও ঐশী মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠাকরবেন৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)বলেছেন:

صنع کما صنع رسول الله (ص) يهدم ما کان قبله کما هدم رسول الله (ص) امر الجاهلية و يستأنف الاسلام جديدا

ইমাম মাহ্দী (আ.) রাসূল(সা.)-এর মতই পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন৷ রাসূল (সা.) যেভাবে অজ্ঞদের সকল কুসংস্কারকেধবংস করেছিলেন, ইমাম মাহ্দী (আ.)ও আধুনিক সকল অজ্ঞতা ও কুসংস্কারকে দূর করে ইসলামেরসঠিক স্বরূপকে প্রতিষ্ঠা করবেন (গাইবাতে নোমানি বাব ১৩, হাঃ ১৩, পৃ.-২৩৬)৷

৪) - ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুদ্ধ পদ্ধতি
ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁরবিশ্বজনীন বিপ্লবের মাধ্যমে কুফর ও র্শিককে পৃথিবীকে থেকে উৎখাৎ করবেন এবং সকলকেপবিত্র ইসলামের দিকে আহবান করবেন৷
এ সম্পর্কে রাসূল (সা.)বলেছেন: তাঁর আদর্শ ও পদ্ধতি আমার আদর্শের আনুরূপ৷ সে জনগণকে আমার দ্বীন ও শরিয়তেপ্রতিষ্ঠিত করবে (কামালুদ্দিন খণ্ড-২, বাব ৩৯, হাঃ ৬, পৃ.-১২২)৷

তবে তিনি এমন সময় আবির্ভূতহবেন যখন সত্য এমনভাবে প্রকাশ পাবে যে, সর্ব দিকে থেকে তা সাবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে৷
তার পরও বিভিন্নরেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম মাহ্দী (আ.) অবিকৃত তৌরাত ও ইঞ্জিলের মাধ্যমেইহুদী ও খ্রীষ্টানদের সাথে আলোচনা করবেন এবং তাদের অনেকেই মুসলমান হয়ে যাবে (আলফিতান পৃ.-২৪৯-২৫১)৷

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী যে জিনিসটি সবাইকে ইসলামের দিকে আকৃষ্টকরবে তা হচেছ যে, ইমাম মাহ্দী (আ.) অদৃশ্য থেকে সাহায্য প্রাপ্ত হচেছন এবং তাঁরমধ্যে নবীদের নিদর্শন রযেছে তা স্পষ্টবুঝা যাবে৷ যেমন: হযরত সুলাইমান (আ.)-এরআংটি, হযরত মুসার লাঠি এবং রাসূল (সা.)-এর বর্ম, তলোয়ার ও পতাকা তাঁর কাছে থাকবে(ইছবাতুল হুদা, খণ্ড- ৩, পৃ:৪৩৯-৪৯৪)৷

তিনি রাসূল (সা.)-এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং বিশ্বজনীন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সংগ্রাম করবেন৷ এটা স্পষ্ট যে, এই সুন্দর পরিবেশে যেখানে সত্য সম্পুর্ণরূপে সবার কাছে স্পষ্টহয়ে যাবে৷ কেবলমাত্র তারাই বাতিলের পক্ষে থাকবে যারা সম্পূর্ণরূপে তাদের মানবতা ওঐশী গুনাবলীকে নষ্ট করে ফেলছে৷ এরা তারা, যারা সারাজীবন অন্যায়-অত্যাচার, ফ্যাসাদ ওকামনা-বাসনার মধ্যে নিমজ্জিত ছিল এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পবিত্র হুকুমত থেকেতাদেরকে উৎখাৎ করা হবে৷ তখন ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর তলোয়ার বের করবেন এবংঅত্যাচারিদের মাথা দিখণ্ডিত করবেন৷ এটা রাসূল (সা.) ও আলী (আ.)-এর পদ্ধতিও বটে(ইছবাতুল হুদা, খণ্ড- ৩, পৃ:৪৫০)৷

৫) - ইমাম মাহদী (আ.)-এরবিচার পদ্ধতি
যেহেতু ন্যায়বিচারপ্রতিষ্ঠা করার জন্য ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে গচিছত করে রাখা হযেছে, তিনি তাঁর দায়িত্বপালন করার জন্য একটি সুন্দর বিচার বিভাগ গঠন করবেন৷ সুতরাং তিনি এ ক্ষেত্রে হযরতআলী (আ.)-এর নীতি অনুসরণ করবেন এবং তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে মানুষের হারিয়ে যাওয়াঅধিকারকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিবেন৷
তিনি এমন ন্যায়ের ভিত্তিতেআচরণ করবেন যে, যারা জীবিত তারা বলবে যে, যারা মৃত্যুবরণ করেছে তারা যদি ফিরে আসততাহলে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়বিচার থেকে লাভবান হতে পারত (আল ফিতানপৃ.-৯৯)৷

বলাবাহুল্য যে, কিছু কিছুরেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম মাহ্দী (আ.) বিচারের আসনে হযরত সুলাইমান (আ.) ওহযরত দাউদ (আ.)-এর মত আচরণ করবেন এবং তাঁদের মত ঐশী জ্ঞানের মাধ্যমে বিচার করবেন, সাক্ষ্য-প্রামাণের মাধ্যমে নয়৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)বলেছেন: আমাদের কায়েম যখন কিয়াম করবে তখন হযরত সুলাইমান (আ.) ও হযরত দাউদ (আ.)-এরমত বিচার করবে অর্থাৎ সাক্ষ্য-প্রামাণের প্রয়োজন হবে না (ঐশী জ্ঞানের মাধ্যমে বিচারকরবেন) (ইছবাতুল হুদা খণ্ড- ৩, পৃ.-৪৪৭)৷

এ ধরনের বিচারের রহস্য হয়তএটা হতে পারে যে, ঐশী জ্ঞানের মাধ্যমে বিচার করলে সঠিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে৷কেননা, মানুষের সাক্ষ্যর ভিত্তিতে বিচার করলে বাহ্যিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হতেপারে প্রকৃত ন্যায়বিচার নয়৷ কারণ মানুষের দ্বারা ভুল হতেই পারে৷ তবে ইমাম মাহ্দী(আ.)-এর বিচার পদ্ধতিকে উপলব্ধি করা অতি কঠিন ব্যাপার তবে তাঁর সময়ের সাথে এপদ্ধতির মিল রয়েছে৷

৬) - ইমাম মাহদী (আ.)-এর পরিচালনা পদ্ধতি
একটি হুকুমতের প্রধানভিত্তি হচেছ তার কর্মীরা৷ একটি প্রশাসনের কর্মচারিরা যদি যোগ্য হয় তাহলে দেশের সকলকর্ম সঠিকভাবে পরিচালিত হবে একং উদ্দেশ্যে উপণীত হওয়া সহজতর হবে৷
ইমাম মাহ্দী (আ.) বিশ্বেরনেতা হিসাবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের জন্য যোগ্য পরিচালক বা গভর্ণর নিয়োগ করবেন৷যাদের মধ্যে একজন ইসলামী নেতার সকল বৈশিষ্ট্য যেমন: জ্ঞান, প্রতিজ্ঞা, নিয়ত, আমলএবং বলিষ্ঠ সিন্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে৷ তাছাড়াও ইমাম মাহ্দী (আ.) সমগ্র বিশ্বেরনেতা হিসাবে সবর্দা তাদের কাজের উপর দৃষ্টি রাখবেন এবং তাদের কাছে হিসাব নিবেন৷ এইপ্রধান বৈশিষ্ট্য যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের পূর্বে সকলেই ভুলে গিয়েছিলহাদীসে তা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পরিচয় হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে৷
রাসূল (সা.)বলেছেন:

علامة المهدی ان يکون شديدا علی العمال جوادا بالمال رحيما بالمساکين

ইমাম মাহদীর চিহ্ন হচেছকর্মচারিদের কাজে কড়া নজর রাখবেন৷ অধিক দান-খয়রাত করবেন এবং মিসকিনদের প্রতি অতিদয়ালূ হবেন (মোজামে আহাদীসে আল ইমাম আল মাহদী, খণ্ড- ১, হাঃ ১৫২, পৃ.-২৪৬)৷

৭) - ইমাম মাহদী (আ.)-এর অর্থনৈতিক পদ্ধতি
অর্থ বিভাগে ইমাম মাহ্দী(আ.)-এর পদ্ধতি হচেছ সাম্য অর্থাৎ সবার মাঝে সমানভাবে অর্থ বন্টন করা৷ যে নীতিরাসূল (সা.) নিজেও অবলম্বন করতেন৷ রাসূল (সা.)-এর পর এ নীতির পরিবর্তন ঘটে এবং অর্থবন্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা দেয়৷ তবে ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সময়েআবারও মানুষের সমান অধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ কিন্তু তারপর উমাইয়্যাশাসকরা মুসলমানদের সম্পদকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে এবংতাদের অবৈধ হুকুতমকে বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী করে৷ তারা মুসলমানদের সম্পত্তিসমূহকেনিজেদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মাঝে বন্টন করে দেয়৷ এ পদ্ধতি ওছমানের সময় থেকে শুরু হয় এবং উমাইয়্যাদের সময়ে তা একটি নীতিতে পরিণত হয়৷
ইমাম মাহ্দী (আ.) একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসাবে বাইতুল মালকে সবার মাঝে সমানভাবে বন্টন করবেন এবং মুসলমানদেরসম্পদকে (আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে) দান করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধকরবেন৷
রাসূল (সা.)বলেছেন:

اذا قام قائمنا اضمحلت القطائع فلاقطائع

আমাদের কায়েম যখন কিয়ামকরবে তখন অত্যাচারি শাসকরা যে সকল সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করেছিল বা আত্মীয়-স্বজন ওবন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বন্টন করেছিল তা ফিরিয়ে নেওয়া হবে এবং তাদের নিকট আর কোনসম্পত্তি থাকবে না (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫২, পৃ.-৩০৯)৷

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এরঅর্থনৈতিক ব্যবস্থার আর একটি বৈশিষ্ট্য হচেছ সকল মানুষের সমস্যার সমাধান করা এবংতাদের জন্য একটি সচছল জীবন গঠন করা৷ ইমাম মাহ্দী (আ.) প্রচুর সম্পদ মানুষকে দানকরবেন এবং নির্ভরশীল ব্যক্তিরা সাহায্য চাইলে তাদেরকে সাহায্য করবেন৷
রাসূল (সা.)বলেছেন:

فهو يحثوا المال حثوا

সে অধিক সম্পদ দান-খয়রাতকরবে (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫২, পৃ.-৩০৯)৷

এ পদ্ধতিতে ব্যক্তি ওসমাজকে সংশোধন করা সম্ভব যেটা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর মহান উদ্দেশ্য৷ তিনি জনগণকেঅর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করার মাধ্যমে মানুষের ইবাদত-বন্দেগির পথকে সুগমকরবেন৷

৮) - ইমাম মাহদী (আ.)-এর ব্যক্তিগত আদর্শ
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এরব্যক্তিগত আচরণ এবং জনগণের সাথে ব্যবহারে তিনি একজন ইসলামী শাসকের উত্তম আদর্শ৷তাঁর দৃষ্টিতে হুকুমত হচেছ মানুষকে খেদমত করার একটি মাধ্যম এবং তাদেরকে পরিপূর্ণতায়পৌঁছানোর একটি স্থান৷ সেখানে পুজিবাদি ও অত্যাচারিদের কোন স্থান নেই৷
তিনি রাসূল (সা.) ও আলী(আ.)-এর ন্যায় জীবন-যাপন করবেন৷ সকল ধন-সম্পদ তাঁর আয়ত্বে থাকা সত্ত্বেও তিনি অতিস্বাভাবিক জীবন-যাপন করবেন৷
ইমাম আলী (আ.) তাঁরসম্পর্কে বলেছেন: সে (মাহ্দী বিশ্বের নেতা হওয়া সত্ত্বেও) প্রতিজ্ঞা করবে যে, প্রজাদের মত চলাফেরা করবে, পোশাক পরিধান করবে ও তাদের মতই বাহনে চড়বে এবং অতিঅল্পতেই সন্তুষ্ট থাকবে (মুনতাখাবুল আছার অধ্যায় ৬, বাব ১১, হাঃ ৪, পৃ.-৫৮১)৷

ইমাম আলী (আ.) ও পার্থিবজগতে খাদ্য, পোশাক ও অন্যান্য সকল দিক দিয়ে রাসূল (সা.)-এর অনুরূপ ছিলেন৷ ইমামমাহ্দী (আ.)ও তাঁর অনুসরণ করবেন৷
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)বলেছেন:

ان قائمنا اذا قام لبس لباس علی و سار بسيرته

আমাদের কায়েম যখন কিয়ামকরবেন হযরত আলী (আ.)-এর পোশাক পরিধান করবেন এবং তার পদ্ধতিতেই দেশ পরিচালনা করবেন(ওছয়েলুশ শিয়া খণ্ড- ৩, পৃ.-৩৪৮)৷

তিনি নিজে কষ্টে জীবন-যাপনকরবেন কিন্তু উম্মতের সাথে একজন দয়ালু পিতার ন্যায় আচরণ করবেন৷ তাদের কল্যাণ ওসৌভাগ্য কামনা করবেন, ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন:

الامام الانيس الرفيق والوالد الشفيق والاخ الشقيق والام البرة بالئلد الصغير مفزع العباد فی الداهية الناد

ইমাম, সহধর্মি, সহপাটি, দয়ালু পিতা, আপন ভাই, সন্তানদের প্রতি মমতাময়ী মাতা এবং কঠিন মুহুর্তে মানুষেরআশ্রয়স্থল (উছুলে কাফী খণ্ড- ১, হাঃ ১, পৃ.-২২৫)৷

হ্যাঁ তিনি সবার সাথে এতঘনিষ্ট ও এত বেশী নিকটবর্তী যে, সকলেই তাঁকে নিজেদের আশ্রয়স্থল মনে করবে৷
রাসূল (সা.) ইমাম মাহ্দী(আ.) সম্পর্কে বলেছেন: তাঁর উম্মত তাঁর কাছে আশ্রয় নিবে যেভাবে মৌমাছিরা রানীমাছির কাছে আশ্রয় নেয় (মুনতাখাবুল আছার অধ্যায় ৭, বাব ৭, হাঃ ২, পৃ.-৫৯৭)৷

তিনি জন নেতার উত্তমদৃষ্টান্ত, তিনি তাদের মধ্যে তাদের মতই জীবন-যাপন করবেন৷ এ কারণেই তিনি তাঁদেরসমস্যাকে সহজেই উপলব্ধি করবেন এবং তার প্রতিকারওতিনি জানেন৷ তিনি একমাত্র আল্লাহরসন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন৷এমতাবস্থায় কেনইবা উম্মত তাঁর পাশে নিরাপত্তা ও শান্তি অনুভব করবে না এবং কোন কারণেতাঁকে ছেড়ে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হবে?

৯) -জনপ্রিয়তা
হুকুমতসমূহের একটি বড়চিন্তা হচেছ কিভাবে জনগণের কাছে প্রিয় হবে৷ কিন্তু তাদের নানাবিধ ত্রুটির জন্যকখনোই তারা মানুষের কাছে প্রিয়ভাজন হতে পারে নি৷ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের একটিবিশেষ বৈশিষ্ট্য হচেছ জনপ্রিয়তা৷ তাঁর হুকুমত শুধুমাত্র পৃথিবীর অধিবাসিদের জন্যইজনপ্রিয় হবে না বরং তা আসমানের অধিবাসি ফেরেশ্তাগণের কাছেও প্রিয়হবে৷
রাসূল (সা.) বলেছেন:তোমাদেরকে মাহ্দীর সুসংবাদ দান করছি যার প্রতি আসমান ও যমিনের সকলেই রাজি ওসন্তুষ্ট থাকবে৷ আর কেনইবা তারা সন্তুষ্ট থাকবে না যখন জানতে পারবে যে, দুনিয়া ওআখেরাতের কল্যাণ ও সৌভাগ্য কেবলমাত্র তাঁর ঐশী হুকুমতের ছায়াতলেই অর্জন করা সম্ভব(বিহার খণ্ড- ৫১, পৃ.-৮১)৷

এ অধ্যায়ের শেষে আমরা ইমাম আলী (আ.)-এর অমিয় বাণী দিয়ে ইতি টানব:
আল্লাহ্ তাআলা তাকে ও তাঁর সাহায্যকারীদেরকে ফেরেশ্তাদের মাধ্যমে সাহায্য করবেন এবং নিজের নিদর্শনের মাধ্যমেও তাকে সাহায্য করবেন৷ তাকে পৃথিবীর উপর বিজয় দান করবেন এবং সকলেই তার দিকে আকৃষ্ট হবে৷ তিনি পৃথিবীকে ন্যায়নীতিতে আলোকিত করবেন৷ সকলেই তার প্রতি ঈমান আনবে এবংকাফেরদের কোন অস্তিত্ব থাকবে না, অত্যাচারি থাকবে না, এমনকি পশু-পাখিরাও একত্রে বসবাস করবে৷ পৃথিবীর সকল সম্পদ বেরিয়ে আসবে, আসমানও তার বরকত বর্ষন করবে এবং যমিনের সকল গুপ্তধন প্রকাশ পাবে৷ সুতরাং তাদের প্রতি সুসংবাদ যারা তাঁর সময়কে দেখবে এবংতার কথা শুনতে পাবে (ইছবাতুল হুদা,খণ্ড- ৩, পৃ.-৫২৪)৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট
 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন