হজরত ইমাম সাদিক (আ.) এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

ইমাম হযরত ইমাম সাদিক (আ.) ১৭ই রবিউল আওয়াল ৮৩ হিজরীতে পবিত্র মদিনা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কুনিয়াহ ছিল আব্দুল্লাহ এবং তাঁর উপাধী সাদেক (সত্যবাদী)। তাঁর পিতার নাম হযরত ইমাম মুহাম্মাদ বাকের (আ.) –শিয়াদের পঞ্চম ইমাম- এবং তাঁর মাতার নাম উম্মে ফারওয়া।

হজরত ইমাম সাদিক (আ.) এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

ইমাম সাদিক, শাহাদত, জান্নাতুল বাক্বী, আব্বাসী, শিয়া, যায়েদ বিন আলী, আহলে বাইত, মহানবী, আব্দুল্লাহ, মুহাম্মাদ, মানসুর দাওয়ানেকী, ইয়াযিদ, হিশাম বিন আব্দুল মালেক, ওয়ালিদ, উমাইয়া, আব্বাসী, হাদীস, ফিকাহ, মুহাম্মাদ বাকের, উম্মে ফারওয়া, Imam, imam sadik, imam sadiq, jannnatul baqi,
জন্ম ও বংশ পরিচয় :
শিয়াদের ষষ্ট ইমাম হযরত ইমাম সাদিক (আ.) ১৭ই রবিউল আওয়াল ৮৩ হিজরীতে পবিত্র মদিনা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কুনিয়াহ ছিল আব্দুল্লাহ এবং তাঁর উপাধী সাদেক (সত্যবাদী)। তাঁর পিতার নাম হযরত ইমাম মুহাম্মাদ বাকের (আ.) –শিয়াদের পঞ্চম ইমাম- এবং তাঁর মাতার নাম উম্মে ফারওয়া।
ইমামতের পূর্বে তিনি তাঁর সম্মানিত পিতার ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার ও একনিষ্ঠ ছাত্র প্রশিক্ষণের সাক্ষ্য ছিলেন। ইমাম মুহাম্মাদ বাকের (আ.) বিভিন্ন সময়ে স্বীয় পুত্র হযরত জাফর সাদিক (আ.) এর ইমামত ও বেলায়েতের বিষয়টি শিয়াদের সম্মুখে স্পষ্ট করেছিলেন এবং শিয়াদেরকে নিজের পর স্বীয় পুত্রের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরই ভিত্তিতে ইমাম সাদিক (আ.) এর ইমামতের সপক্ষে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
হযরত ইমাম সাদিক (আ.) স্বীয় পিতা হযরত ইমাম মুহাম্মাদ বাকের (আ.) এর শাহাদতের পর ১১৪ হিজরীতে ৩১ বছর বয়সে ইমামতের দায়িত্ব লাভ করেন। তার ইমামতের সময়টি ছিল স্বৈরাচারী বনি আব্বাস গোষ্ঠীর শাসনামলের শেষের দিক এবং অত্যাচারী আব্বাসী গোষ্ঠীর শাসনামলের শুরু। উমাইয়া শাসকদের হুকুমতের পতন ১৩২ হিজরী ঘটে।
ইমাম সাদিক (আ.) এর যুগটি ছিল অন্যান্য ইমাম (আ.) গণের যুগ অপেক্ষা আলাদা। ঐ সময়কার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল অন্যান্য ইমামদের সময় অপেক্ষা ভিন্ন। কেননা তাঁর যুগটি ছিল অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠী বনি উমাইয়ার ক্ষমতা হতে পতনের সময় এবং উমাইয়া শাসকদের হতে আব্বাসীয় কর্তৃক ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার সময়। এ দুই অত্যাচারী এ দুই শাসক গোষ্ঠী দীর্ঘদিন যাবত ক্ষমতার লোভে পরস্পরের সাথে দ্বন্দে লিপ্ত ছিল। অবশেষে ১২৯ হিজরীতে সশস্ত্র ও সামরিক হামলা শুরু হয়।
এই টানাপোড়ন ও সংঘর্ষের কারণে বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাস ইমামগণ (আ.) এর তত্পরতার প্রতি কঠোর দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ পেত না। এ কারণে এ সময়ে ইমাম সাদিক (আ.) ও শিয়ারা তুলনামূলকভাবে সাংস্কৃতিক ও ইলমি তত্পরতার জন্য উত্তম সুযোগ লাভ করেছিলেন।
ইমাম (আ.) তত্কালীন সরকারের রাজনৈতিক শক্তির দূর্বলতার সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার ও প্রসারের জন্য সচেষ্ট হন। ইমাম (আ.) এর যুগে যেহেতু ইসলামি ভূখণ্ড প্রাথমিক যুগ অপেক্ষা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছিল তাই ইসলাম ও শিয়া মাযহাব, অন্যান্য ধর্ম ও মাযহাবের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ছিল। আর এ কারণেই সাংস্কৃতিক কর্মতত্পরতা ও ছাত্র প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ঐ যুগে প্রকটভাবে দেখা দেয়। এ সময় ইমাম সাদিক (আ.) যথাযথ উত্তমরূপে অন্যান্য ধর্ম ও মাযহাবের সকল প্রশ্ন ও সন্দেহের জবাব অত্যন্ত গভীরভাবে ও মনোযোগ সহকারে দিতেন এবং শিয়া মাযহাবের স্বকীয়তা ও গভীরতা তুলে ধরতেন।
হযরত ইমাম সাদিক (আ.) এর যুগ থেকেই ইমামিয়া শিয়া মাযহাব ফিকাহ, কালাম শাস্ত্র, নৈতিকতা, তাফসীর ইত্যাদি বিষয়ে স্বতন্ত্র স্বকীয়তা লাভ করে। শিয়া মাযহাবের ফিকাহ -যা জাফরী ফিকাহ নামে প্রসিদ্ধ- ইমাম সাদিক (আ.) এর নামের সাথে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা শিয়া মাযহাবের ফিকাহ শাস্ত্রের অধিকাংশ মাসআলা-মাসায়েল তাঁর (আ.) হতেই বর্ণিত হয়েছে। আজকে আমাদের মাঝে যে বিভিন্ন ফিকাহ’র রূপ আমরা দেখতে পাই সেগুলোর উত্পত্তি ইমাম সাদিক (আ.) এর সমসময়ে বা তার পরে। ইমাম সাদিক (আ.) এর এহেন পদক্ষেপের মাধ্যমে মহানবী (স.) কর্তৃক আনীত প্রকৃত ইসলাম আহল বাইত (আ.) এর মাধ্যমে তথা তত্কালীন যুগের ইমাম হযরত সাদিক (আ.) এর মাধ্যমে আমাদের নিকট পৌঁছে। আর এ যুগেই কুফা ও বসরাতে হাদীস ও কালাম শাস্ত্রে ও ফিকাহ শাস্ত্রের ব্যাপক চর্চা হয়।
তাঁর (আ.) সময়টি ছিল সংস্কৃতি ও চিন্তার জাগরণের সময় এবং বিভিন্ন মাযহাবের মাঝে তর্ক-বিতর্কের সময়। মহানবী (স.) এর যুগের পর এমন সুযোগ আর কখনই সৃষ্টি হয়নি। কেননা মহানবী (স.) এর ইন্তেকালের পর হাদীস লেখার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। আর বনি উমাইয়া শাসকদের প্রচণ্ড চাপের কারণে ইমাম (আ.) গণও প্রকাশ্যে মহানবী (স.) এর শিক্ষাকে প্রচার করতে পারতেন না। এ কারণে তত্কালীন মুসলমানরা মহানবী (স.) এর রেখে যাওয়া শিক্ষা লাভ হতে বঞ্চিত হয়।
ইমাম সাদিক (আ.) রাজনৈতিক চাপ মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মহানবী (স.) এর প্রকৃত ইসলামের শিক্ষাকে –যা বংশীয় পরম্পরায় আহলে বাইত (আ.) এর এক সদস্য হতে অন্য সদস্যের মাধ্যে তাঁর নিকট পৌঁছে ছিল- মুসলমানদের মাঝে প্রচার শুরু করলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ছাত্র প্রশিক্ষণে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। বিভিন্ন সূত্র হতে বর্ণিত বিশ্বস্ত রেওয়াতের ভিত্তিতে জানা গেছে যে, ইমাম সাদিক (আ.) এর ছাত্রদের সংখ্যা ছিল ৪ সহস্রাধিক।
তাঁর সময়কার শাসকগণ:
যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমাম সাদিক (আ.) উমাইয়া ও আব্বাসী উভয় শাসক গোষ্ঠীর শাসনামল দেখেছেন। তাঁর যুগে যে সকল উমাইয়া শাসকগণ ইসলামি ভূখণ্ডকে শাসন করেছে তারা হলো :
১। হিশাম বিন আব্দুল মালেক (১০৫-১২৫ হি.)।
২। ওয়ালিদ বিন ইয়াযিদ বিন আব্দুল মালেক (১২৫-১২৬ হি.)।
৩। ইয়াযিদ বিন ওয়ালিদ (১২৬ হি.)।
৪। ইবরাহিম বিন ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালেক (১২৬ হিজরী সন হতে মাত্র ৭০ দিন)।
৫। মারওয়ান বিন মুহাম্মাদ (১২৬-১৩২ হি.)
     
যে সকল আব্বাসীয় খলিফা তার যুগে শাসন করেছে তাদের নাম নিম্নরূপ :
১। আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ ওরফে সাফফাহ (১৩২-১৩৭ হি.)
২। আবু জাফার ওরফে মানসুর দাওয়ানেকী (১৩৭-১৫৮ হি.)
 
এটা ভাবা সমিচীন নয় যে, ইমাম (আ.) রাজনৈতিক সকল বিষয় হতে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। বরং তিনি উপযুক্ত সময়ে নিজের সত্যতার প্রচার ও শাসক গোষ্ঠীর বাতিল হওয়ার বিষয় সম্পর্কে জনগণকে অবগত করতেন। এরই ভিত্তিতে তিনি ইসলামি ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন।
আব্বাসীয়রা ক্ষমতা দখল ও মানুষের অন্তরে স্থান করে নেয়ার কুউদ্দেশ্যে হযরত মহানবী (স.) এর আহলে বাইত (আ.) এর নামের অপব্যবহার করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এমনকি তারা জনগণকে ধোকা দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে ‘আর-রেজা ফি আলে মুহাম্মাদ’ বাক্যকে শ্লোগান হিসেবে বেছে নেয়। তারা জনগণের সম্মুখে এমন ব্যক্তিত্বকে আনতে চেয়েছিল যিনি হবেন মহানবী (স.) এর আত্মীয়দের কেউ এবং জনগণের মাঝে যার জনপ্রিয়তাও থাকবে। সুতরাং আব্বাসীয়দের দৃষ্টিতে জনগণের সম্মুখে দাঁড় করানোর জন্য সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব ছিলেন হযরত ইমাম সাদিক (আ.)।
ইমাম সাদিক (আ.) তাদের প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন: না তোমরা আমার সাথীদের অন্তর্ভূক্ত, আর না বর্তমান সময় আমার সময়। তার অনেক আত্মীয়-স্বজনও আব্বাসীয়দের এমন লোভনীয় প্রস্তাবে প্ররোচিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম (আ.) স্পষ্ট যুক্তি প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে শুধুমাত্র বাইরের দিকটা দেখো না বরং তাদের এহেন আচরণের পিছনে কি কুউদ্দেশ্য তারা মনে মনে লালন করছে। ইমাম (আ.) জানতেন যে, ক্ষমতায় পৌঁছানো ব্যতীত আব্বাসীয়দের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। আর তারা যে আহলে বাইত (আ.) এর সমর্থনের শ্লোগান দিচ্ছে তা শুধুমাত্র আহলে বাইত (আ.) এর ভক্তদের সমর্থন লাভের জন্য।
ইমাম সাদিক (আ.) এর জন্য এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, আব্বাসীয়দের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বরা ইসলাম ও আহলে বাইত (আ.) এর পথ হতে বিচ্যুত। সুতরাং তিনি তাদেরকে সমর্থন ও তাদের পদক্ষেপকে বৈধতা দান করতে অস্বীকৃতি জানান।
তাঁর যুগের অন্যতম ঘটনা ছিল তার চাচা যায়েদ বিন আলী (রা.) কর্তৃক অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তিনি উক্ত সংগ্রামে পরাজিত হন এবং শাহাদত বরণ করেন। তার শাহাদতের সাথে সাথে উক্ত সংগ্রামেরও সমাপ্তি ঘটে।
 
ইমাম সাদিক (আ.) এর শাহাদত:
আব্বাসীয়দের ক্ষমতায় পৌঁছানোর সাথে সাথে যেভাবে তিনি (আ.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, শিয়াদের উপর চাপ বেড়ে যায় এবং মানসুর দাওয়ানেকী ক্ষমতায় আসার পর এ চাপ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ইমাম (আ.)ও প্রচণ্ড চাপের মুখে ছিলেন। মানসুর বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে যখন ইমাম সাদিক (আ.) এর জনপ্রিয়তা কমাতে ব্যর্থ হল তখন সে শিয়াদের এ মহান ইমামকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলো। কেননা সে তার হুকুমতের সম্মুখে ইমাম সাদিক (আ.) কে একমাত্র হুমকি হিসেবে মনে করতো। আর তাই তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলো এবং তাকে হত্যা করলো।
ইমাম সাদিক (আ.) ৬৫ বছর বয়সে ১৪৮ হিজরীতে শাহাদত বরণ করেন। তাকে জান্নাতুল বাক্বীতে অবস্থিত তাঁর পিতা ও পিতামহের মাজারের নিকট সমাধিস্থ করা হয়।

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন