কারবালার সংস্কৃতিতে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ

কারবালার সংস্কৃতিতে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ

কারবালার সংস্কৃতিতে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ

হিজরি ৬১ সালের ১০ই মহররম কারবালার ময়দানে এরকমই একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিলো। কারবালার মরুপ্রান্তরে ইমাম হোসেইন (আঃ) ও তার ৭২ জন সাথী যে বীরত্বগাঁথা সৃষ্টি করেছিলেন, তা ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট ক্ষণে শুধুমাত্র একটি যুদ্ধ ছিলো না। ঐ বীরত্বগাঁথার ব্যাপ্তি এত বিস্তৃত ছিলো যে, তা স্থান ও কালকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। যে সব কারণে ইমাম হোসেইন (আঃ) এর আন্দোলন এত বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছে তার মধ্যে এর মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং এর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ অন্যতম। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেইন (আঃ) অত্যাচারী শাসক এজিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, "আমি সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে সংগ্রামে নেমেছি"।
কাজেই বলা যায়, ইমাম হোসেইন (আঃ) নৈতিক ও মানবীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। কারবালার ময়দানে হোসেইন বিন আলী (আঃ) এর সাথে যেসব মহান শহীদ আত্মত্যাগ করেছিলেন, তাদের সবার প্রতিটি পদক্ষেপে এসব মূল্যবোধ অক্ষুন্ন রাখার প্রচেষ্টা ছিলো লক্ষ্যণীয়। নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি সাহসিকতা ও বীরত্ব ছিলো কারবালা আন্দোলনের প্রধান আকর্ষণ।
এবার আমরা কারবালার মরু প্রান্তরের শহীদদের কিছু আধ্যাত্মিক ও নৈতিক আচরণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরবো। পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য নিজের মধ্যে উন্নত মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন। অন্যদিকে পৃথিবীর সাময়িক চাকচিক্যের মোহে পড়ার অর্থ হচ্ছে মানবীয় ও আধ্যাত্মিক গুণাবলীকে জলাঞ্জলি দেয়া। মানুষ কখনো কখনো তাৎক্ষণিক সুখ পাওয়ার জন্য এবং হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অনেক তুচ্ছ কাজ করতে এবং অনেক অপমান অপবাদ সহ্য করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। কিন্তু যারা পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনের চেয়ে পরকালের জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছেন তারা মানবীয় ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ রক্ষা করার জন্য নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছেন। ইমাম হোসেইন (আঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, "বীরের মতো মৃত্যু কাপুরোষিতভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে শ্রেয়।" জীবন সম্পর্কে যার গভীর ও উন্নততর মূল্যয়ন রয়েছে তার পক্ষেই কেবল এ ধরনের মন্তব্য করা সম্ভব। ইমাম হোসেইন ও তার সঙ্গীসাথীগণ এক আল্লাহর আনুগত্যের ছায়াতলে এ ধরনের স্বাধীনচেতা মানসিকতার অধিকারী হয়েছিলেন। স্বাধীনতার অমীয় সুধা তারাই পান করতে পারেন যারা তাদের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে মহান আল্লাহর দাসত্বকে মেনে নিয়েছেন। আল্লাহকে স্মরণ ও তার ওপর নির্ভরতা ছিলো ইমাম হোসেইন (আঃ) এর সঙ্গীদের মূল শ্লোগান। জীবন চলার কঠিন সময়গুলোতে তার পক্ষেই স্বীয় অবস্থানে অটল থাকা সম্ভব মহাশক্তির সাথে যিনি সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। কারবালার ময়দানে সেই চরম ও বিভীষিকাময় মুহুর্তে ইমাম ও তার সাথীগণ আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে নিজেদের শান্ত ও নির্বিকার রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের চোখেমুখে ভয়, উৎকণ্ঠা বা শঙ্কার লেশমাত্র দেখতে পাওয়া যায় নি। ইমাম হোসেইন (আঃ) সে সময় বারবার লা হাওলা অলা কুওয়াতা ইল্লাহ বিল্লাহ' যিকির উচ্চারণ করছিলেন। আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরতার কারণে ইমাম ও তার মাত্র ৭২ জন সাথী পাপিষ্ঠ এজিদের ৩০ হাজার বাহিনীকে রুখে দাঁড়াতে দ্বিধা করেন নি। ইমাম আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছেন এভাবে : "হে আল্লাহ সকল কঠিন ও চরম মুহুর্তে আমার আশা একমাত্র তুমি। আমার মওলা হচ্ছেন সেই আল্লাহ যিনি কোরান নাযিল করেছেন"।
আশুরার দিন ইমামের একজন সাথী যখন যোহরের নামাজের সময় হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন, তখন ইমাম আকাশের দিকে তাকিয়ে ফরিয়াদ করে বলে ওঠেন : "তুমি নামাজের কথা মনে করেছো, আল্লাহ যেন তোমাকে খাঁটি নামাজ আদায়কারীদের অন্তর্ভূক্ত করেন"। এরপর তিনি নামাজ পড়ার সুযোগ দেয়ার জন্য শত্রুবাহিনীকে কিছুক্ষণের জন্য তাদের হামলা বন্ধ করার আহবান জানান।

কারবালার ময়দানে ইমাম হোসেইন (আঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। কারবালায় শাহাদাতের কয়েকদিন আগে থেকে তিনি বিভিন্নভাবে সাথীদের ধৈর্যধারণের বিষয়টি শিক্ষা দিয়ে আসছিলেন। পাপাত্মা এজিদের বাহিনী কারবালায় যে নারকীয় হত্যাযঙ্গে মেতে উঠেছিলো তা দেখে সহ্য করা কোন মানুষের পক্ষেই হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও তার প্রতিশ্রুত পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় ইমামের সাথীগণ এ ব্যাপারে ছিলেন নির্বিকার ও দৃঢ়চিত্ত। শত্রুবাহিনী যখন ইমামের দুধের শিশু থেকে শুরু করে তরুণ ও যুবক সন্তানদের এবং তার প্রাণপ্রিয় ভাইকে হত্যা করে চলছিলো, তখন আশুরার মহান বিপ্লব সফল করার জন্য ইমামের আকাঙ্খা ও শপথ আরো কঠিন হচ্ছিলো। প্রিয় নবীজির বংশধরদের শাহাদাৎ তাকে বিন্দুমাত্র তাঁর অবস্থান থেকে টলাতে পারে নি।

ইমাম যখন কুফা যাওয়ার পথে কারবালায় যখন ইমামের কাফেলাকে হোর ইবনে ইয়াযিদের নেতৃত্বাধীন সেনাদল আটকে দিয়েছিলো, তখন ইমামের একজন সঙ্গী বলেছিলেন, এই সেনাদলের আকার অনেক ছোট। আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করলে তাদের পরাভূত করতে পারবো। তখন ইমাম বললেন, "আমি আগে যুদ্ধ শুরু করবো না"। তিনি বরং হোরের তৃষ্ণার্ত সেনাদের পানি করানোর জন্য তার সাথীদের নির্দেশ দিলেন। শত্রুবাহিনী হত্যা করতে এসেছে জেনেও তাদের প্রতি এই ছিলো ইমামের ব্যবহার। এই মহানুভব আচরণের পাশাপাশি কারবালার ময়দানে ইমাম হোসেইন (আঃ) ও তার সাথীদের সাহসিকতার কাহিনীও প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে। এ সম্পর্কে এজিদের বাহিনীর এক সেনার বর্ণনা ইতিহাসে এসেছে এভাবে : "তারা যখন তরবারি হাতে নিয়ে আমাদের দিকে ছুটে আসতো তখন সিংহের ন্যায় আমাদের সেনাদের ছত্রভঙ্গ করতে করতে এগিয়ে যেতো। কয়েক ঘন্টা সময় পেলে তারা আমাদের নাস্তানাবুদ করে ফেলতো। মৃত্যুর পরোয়া না করে তারা সামনের দিকে এগিয়ে আসতো এবং আমাদের বহু সেনাকে খতম করার পর আমাদের সেনাদের হাতে মারা পড়তো।"

ইমাম হোসেইন (আঃ) এর সঙ্গীরা কারবালার ময়দানে আনুগত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আশুরার আগের রাতে ইমাম তার সাথীদের মুক্ত করে দিয়ে বলেছিলেন, যার ইচ্ছা সে চলে যেতে পারে, কারণ, তাঁর সাথে থাকার অর্থ হচ্ছে নির্ঘাত মৃত্যু। কিন্তু ইমাদের সঙ্গীরা প্রত্যেকে নানাভাবে তাদের আনুগত্যের শপথ করে ইমামকে ত্যাগ করবেন না বলে ঘোষণা করলেন। মুসলিম ইবনে উজ্জাহ নামের ইমামের এক সাথী বললেন, "আমাকে যদি একবার হত্যা করে পুনরায় জীবিত করা হয় এবং ৭০ বার এ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়, তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো না। আমি নিজের জীবন দিয়ে আপনাকে রক্ষার চেষ্টা করবো, যাতে কেয়ামতের ময়দানে বিশ্বনবী (সাঃ) কে বলতে পারি, নিজের অস্তিত্ব দিয়ে আমি আপনার বংশধরকে রক্ষার চেষ্টা করেছি।"

কারবালার ময়দানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এসব ঘটনা প্রমাণ করে ইমাম ও তাঁর সাথীগণ পরিপূর্ণ মানব হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর আরো কাছে পৌঁছতে সচেষ্ট ছিলেন। শত্রুশিবিরকে উপদেশ দান অথবা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় ইমাম বা তার সাথীগণ বিন্দুমাত্র মানবীয় ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ বিসর্জন দেন নি। ইমাম শিবিরে যখন পানি ছিলো তখন তিনি পিপাসার্ত শত্রুসেনাদের তৃষ্ণা মেটাতে কার্পন্য করেন নি, আবার যুদ্ধের ময়দানে চরম সাহসিকতার সাথে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ইমামের এ নমনীয়তা ও দৃঢ়তা প্রমাণ করে তিনি অতি উচ্চ লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। মানবতার মুক্তি এবং মানবীয় ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা ছিলো ইমামের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই মহান লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনীয়তা কেয়ামত পর্যন্ত শেষ হবে না বলে ইমামের শিক্ষা মানব জাতির পথ প্রদর্শক হয়ে থাকবে চিরকাল। আমরা যেন কারবালার বীরত্বগাঁথা থেকে কিছুটা হলেও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, মহররমের শোকাবহ দিনগুলোতে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
ইসলামী আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ইমাম হোসেন (আঃ)-এর ভূমিকা
অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো, নবী-রাসুলসহ মুমিনদের একটি অন্যতম দায়িত্ব। আর ইহ ও পরকালীন কল্যাণ নিশ্চিত করতে ন্যায়ের পথে চলা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-র প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেন (আঃ)-ও সর্বদা ন্যায়ের পথে চলেছেন, কখনোই অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। কিন্তু একজন মুমিন শুধু নিজেই ন্যায় ও সত্যের পথে চলেন না, পাশাপাশি সমাজকেও সত্যের পথে পরিচালিত করতে সচেষ্ট হন। আর ইমাম হোসেন (আঃ)-তো সাধারণ কোন মুসলমান নন,তিনি আহলে বাইতের মহান ইমাম,মুমিনদের নেতা। সমাজকে সঠিক পথ প্রদর্শনের গুরু দায়িত্ব তার উপর অর্পিত।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-র ওফাতের পর অজ্ঞতার অন্ধকার ক্রমেই মুসলিম সমাজকে গ্রাস করছিল। প্রকৃত ইসলাম ধীরে ধীরে সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল। মানুষ নামাজ আদায় করার জন্য দিনে কয়েকবার মসজিদে যেত কিন্তু আল্লাহর সঠিক ইবাদতের প্রকৃত রহস্য সম্পর্কে তারা ছিল অসচেতন । সারাক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করতো, কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতো না।
ইসলামের প্রকৃত আদর্শ, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল। ধর্মীয় মুল্যবোধ ও চিন্তা-চেতনা প্রায় ভুলুন্ঠিত। গোষ্ঠী প্রীতি ও সম্পদের প্রতি লালসা ধর্মের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিল। শাসক শ্রেনী ক্রমেই দুর্নীতিপরায়ন ও জুলুমবাজে পরিণত হচ্ছিল। ধর্মহীন ও কপট ব্যক্তিরা সমাজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের মতো করে ইসলাম ধর্ম ব্যাখ্যা করছিল। এর ফলে সমাজ জীবনে প্রকৃত ইসলামের প্রভাব নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছিল। আর অধিকাংশ মানুষ আস্তে আস্তে বিভ্রান্তিকর এ পরিস্থিতির সাথে অভ্যন্ত হয়ে এটাকেই স্বাভাবিক পরিস্থিতি হিসেবে মেনে নিচ্ছিল। কারোরই যেন কোন প্রতিক্রিয়া নেই। আর এজিদের শাসনামলে ধর্মহীন তৎপরতা চরমে উঠে। এ অবস্থায় ইমাম হোসেন (আঃ) জনগণকে সজাগ ও সচেতন করে তোলার চেষ্টা করলেন। সবাইকে আল্লাহ ও রাসূলের পথে ফিরে আসার আহ্বান জানালেন। সমাজের প্রভাবশালীদের কাছে চিঠি লিখে এ পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান জানালেন। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হলো না।

শুধুমাত্র প্রচার কাজ বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ঘুমিয়ে পড়া মুসলিম উম্মাহকে জাগিয়ে তোলা তখন সম্ভব ছিল না। তৎকালীন দুর্নীতিবাজ ও কপট শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে ব্যাপকভিত্তিক সংগ্রামই ছিল সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ, কাজেই ইমাম সংগ্রামের পথ বেছে নিলেন। ইমাম হোসেন (আঃ)-এর লক্ষ্য ছিল উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির স্বরূপ উন্মোচন করে মানুষের অন্তরাত্মা ও বিবেককে জাগিয়ে তোলা, প্রকৃত ইসলামী আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সেই স্পর্শকাতর সময়ে এটিই ছিল ইমামের জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। এ কারণে তিনি হজ্বের গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা অর্ধসমাপ্ত রেখে কুফার পানে ছুটলেন। পথিমধ্যে দেখা হলো তৎকালীন প্রখ্যাত কবি ফারাযদাকের সাথে। তিনি ফারাযদাককে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, বর্তমান সমাজ আল্লার প্রতি আনুগত্য থেকে দূরে সরে এসে শয়তানের পথ অনুসরণ করছে। অনাচার ও দুর্নীতি করছে। নি:স্ব ও দরিদ্রদের সম্পদ কুক্ষিগত করছে। কাজেই ইসলামী মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন ও জিহাদ করতে হবে। কবি ফারাযদাকের উদ্দেশ্যে দেয়া ইমাম হোসেন (আঃ)-র ঐ বক্তব্য থেকে তৎকালীন সমাজের দূরবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে।

ইমাম হোসাইন (আ) তার সংগ্রাম তথা আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমার আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করা, আমি চাই সমাজে কোরআন ও সুন্নাহর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করতে, যা আজ শাসক গোষ্ঠির হাতে উপেক্ষিত এবং অনিরাপদ হয়ে পড়েছে এই আন্দোলনের প্রথম দিকে কুফা ও অন্যান্য এলাকার কিছু মানুষ ইমাম হোসাইন (আ) এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল, কিন্তু প্রশাসনের প্রচন্ড চাপের মুখে এক পর্যায়ে তার তাদের আনুগত্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় । আবার অনেকেই পার্থিব স্বার্থে বা ঈমানী দুর্বলতার কারণে ইমামের আন্দোলনের সাথে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকে। আবার একদল মুসলমান আন্দোলনে না গিয়ে ঘরে বসে ইমাম হোসাইন(আঃ)-র জন্য দোয়া করাকেই নিজেদের কর্তব্য মনে করেছিল। কিন্তু ইমাম হোসেন(আঃ) তার আন্দোলন ও সংগ্রামের কোন পর্যায়েই কপটতার আশ্রয় নেননি এবং নিজেও কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেননি। ঐশী ধর্ম ইসলামের আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে মানুষের জন্য ইহ ও পরকালীন কল্যাণ নিশ্চিত করাই ছিল তার আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য।

কোনো আন্দোলন যদি আদর্শ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভিত্তিক হয় তাহলে তার বিজয় অবসম্ভাবী। কখনো কখনো সাময়িক বিজয় অর্জিত না হলেও চূড়ান্ত বিজয় আসবেই। ইমাম হোসেন(আঃ)-ও তার লক্ষ্যে উপনীত হবার মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছেন। তিনি মক্কা থেকে কারবালা যাবার পথে বিভিন্ন ভাষণে সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, আমার যাত্রার উদ্দেশ্য হলো কপট উমাইয়া শাসকদের স্বরূপ উন্মাচন করা, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। আল-কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মুহাম্মাদী দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করা ছাড়া আমার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। তিনি তার কারবালায় নিজের জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে ইসলামের ধারক-বাহক সেজে বসা কপট ও ভন্ড উমাইয়া শাসকদের স্বরূপ উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন। ইমামের আন্দোলন ও আত্মত্যাগ ইসলামকে কুসংস্কার ও বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে নতুন জীবন দিয়েছে। ফলে উন্মোচিত হয়েছে নয়া দিগন্তের। কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার পর দীর্ঘ তেরো শতাব্দিরও বেশি অতিবাহিত হলেও মুসলমানদের মন থেকে ঐ ঘটনার প্রভাব মুছে যায়নি। ইমাম হোসেন(আঃ)-র শাহাদাতের ঘটনা আজও মানব সমাজকে সত্যের পথে সংগ্রামে উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে।

ইমাম হোসেন (আঃ) তার জীবন দিয়ে সবার সামনে এটা স্পষ্ট করে গেছেন যে, সমাজে যখনই জুলুম,নির্যাতন, অনাচার প্রাধান্য বিস্তার করবে এবং ন্যায় ও সত্যের আলোকে নিভিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলবে তখন প্রকৃত মুসলমানদের চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। ধর্মীয় আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হতে হবে এবং প্রয়োজনে ধর্মের পথে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন না হবারও শিক্ষা দিয়ে গেছেন ইমাম হোসেন(আঃ)। আমরা ইমাম হোসেন(আঃ) শিক্ষা ও আদর্শকে অনুসরণ করে ইহ ও পরকালীন নিশ্চিত করতে সক্ষম হবো, এ প্রত্যাশা রইল।
তাসুয়া

মুহররমের নয় তারিখে কারবালায় ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনার বার্ষিকী আবারো আমাদের স্মৃতির দরোজায় কড়া নাড়ছে। আরবি ভাষায় এর প্রতিশব্দ হচ্ছে তাসুয়া। তাসুয়া আয়নার মতো আমাদের সামনে আসে আর তাতে প্রতিবিম্বিত হই আমরা সবাই। কী করেছিলেন ইমাম হোসাইন (আ),কী করনীয় আমাদের,আর কী করছি আমরা-এসবের একটা অনুভূতি জাগিয়ে দেয় আমাদের মনে। ইসলামের ইতিহাসে তাই এই দিনটি খুবই তাৎপর্যবহ। আমরা তাই তাসুয়া সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করে ইমাম হোসাইন (আ) এর মহান আত্মত্যাগসমৃদ্ধ বিশেষ আন্দোলনের সাথে নিজেদের যোগসূত্র তৈরীর চেষ্টা করবো-আল্লাহ আমাদের এই প্রচেষ্টা কবুল করুন
কারবালার ঘটনার একটা বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ইমাম হোসাইন (আ) এর বিশেষ এই বিপ্লব ছিল মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের বিপ্লব,আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের পথে প্রাণবাজি রাখার অকুতোভয় বিপ্লব। এই বিপ্লব তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনা ছিল না বরং এটা ছিল একটা সংস্কৃতিক বিপ্লব যা সর্বদা অম্লান এবং জীবন্ত। যেই সংস্কৃতির উত্থান ঘটেছিল ইসলামের শিক্ষার আলোকে, যেই সংস্কৃতি ইসলামের চিরন্তন মূল্যবোধগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেজন্যে কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনা যুগ যুগ ধরে ঝর্ণাধারার মতো সত্য ও ন্যায়ের তৃষ্ণায় তৃষিতদের পিপাসা নিবারণ করেছে এবং সেইসাথে বহু সত্য ও ন্যায়কামী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে।
ইমাম হোসাইন (আ) এর সঙ্গী-সাথী বা সৈনিকদের ব্যাপারে একটা বিষয় ভালোভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে তা হলো ইমামের সাথীরা ইমামকে যথার্থভাবেই চিনতে পেরেছিলেন এবং জেনে-শুনে-বুঝেই তাঁর আন্দোলনে একাত্ম হয়েছিলেন। ইমামকে ভালোবেসে স্বতস্ফূর্তভাবে ইমানী শক্তিতে বলিয়ান হয়েই তাঁর প্রদর্শিত পথে জীবন উৎসর্গ করতে অকুতোভয় ছিলেন। মানুষের মাঝে যে অজ্ঞতা বা মূর্খতা বিরাজ করছিল তা ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের জন্যে তরবারীর আঘাতের চেয়েও ছিল বেশি কষ্টকর। সেজন্যে মানুষের চিন্তারাজ্য থেকে অজ্ঞতার পর্দাগুলো সরিয়ে ফেলার জন্যে একটা জেহাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত ছিল। কারবালার ইতিহাসে এসেছেঃ ইমামের সাথীরা অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং সুস্পষ্ট চিন্তার আলোকেই সত্য ও ন্যায়ের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন।

সংঘর্ষ চলাকালে ইমাম হোসাইন (আ) এর সঙ্গী-সাথীগণ প্রথমে প্রাণবন্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ইমাম এবং নবীজীর খান্দানের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন, তারপর যুদ্ধের ময়দানে পা রেখেছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে শত্রুরা নবীজীর খান্দানের স্বরূপ ধ্বংস করার জন্যে ব্যাপক অপপ্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল। এ কারণে ইমামের সাথীগণ প্রতিটি মুহূর্তে ইমাম হোসাইন (আ) এর আন্দোলন,তাঁর পদ্ধতি ও আদর্শকে রক্ষায় তৎপর হতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরহেজগারী ছিল ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গীদের আদর্শ। তাদেঁর পবিত্র চিন্তা এবং উন্নত আত্মার কারণে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-অত্যাচারের মোকাবেলায় চুপ করে বসে থাকতে পারেন নি। নিঃসন্দেহে কারবালার যুবকদের প্রশিক্ষিত এবং উন্নত নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী ছিল। এসব গুণের সমাবেশ তাঁদেরকে ইতিহাসের অমর চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (আ) এর সাথীগণ ছিলেন ইমানের সবোর্চ্চ শিখর আরোহী,নৈলে এভাবে প্রাণ বিলানো সহজ ব্যাপার ছিল না।
কারবালার ইতিহাস স্রষ্টাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে-কোনো মূল্যে ইমাম হোসাইন (আ) এর ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাগুলোর ব্যাপারে আন্তরিক ও বিশ্বস্ত থাকা। চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তাঁরা ইমামের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে রাজি ছিলেন না। ইমামের সাথীদের মাঝে হযরত আব্বাস (আ) এর স্থান ছিল অনেক উর্ধ্বে। আব্বাস ছিলেন ইমাম আলী (আ) এর সন্তান এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর ভাই। তাঁর মায়ের নাম ছিল উম্মুল বানিন। ইমাম হোসাইন (আ) এর খান্দানের লোকজন বিশেষ করে যুবকদের মাঝে তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং নৈতিক ও চারিত্র্যিক গুণের প্রশংসা ছিল সবার মুখে মুখে। তাঁর চেহারা ছিল চাদেঁর মতো সুন্দর ,সে কারণে তাকেঁ উপাধি দেওয়া হয়েছিল বনি হাশেমের চাঁদ। ইমাম হোসাইন (আ) এর ব্যাপারে ছোটোবেলা থেকেই তাঁর আলাদা একটা টান যেমন ছিল তেমনি ছিল শ্রদ্ধা ও সম্মান।
তিনি সবসময়ই ইমাম হোসাইন (আ) কে শ্রদ্ধা করতেন। কারবালার সংগ্রামে সৈনিকদের অধিনায়কের দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পন করা হয়েছিল। ইমাম হোসাইনের যত্ন নেওয়া,নারী ও শিশুদের তাঁবুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা, ইমাম হোসাইনের সন্তানদের জন্যে পানি আনার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিষয়ে কারবালায় হযরত আব্বাসের অবিস্মরণীয় ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় তাকেঁ মহাকাব্যের বীরের মতো অমর করে রেখেছে। ইয়াযিদের সেনারা ইমাম হোসাইন এবং তাঁর সঙ্গীদেরকে পর্যুদস্ত করার জন্যে পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু ইমামের সন্তানেরা যখন পানির পিপাসায় কাতরাচ্ছিল তখন আব্বাস (আ) নির্ভীকচিত্তে নজিরবিহীন এক কাণ্ড ঘটালেন। তিনি শত্রুপক্ষের অবরোধ ভেঙ্গে দিয়ে ফোরাত নদীতে গিয়ে পৌঁছলেন। নদীতে নেমে আঁজলা ভরে পানি নিলেন খাবার জন্যে।এমন সময় ইমাম হোসাইনের তৃষিত সন্তানের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি আর পানি খেতে পারলেন না।

তিনি মশক বা পানির পাত্র ভর্তি করে হাতে নিয়ে দ্রুত তাঁবুর পথে রওনা হয়ে গেলেন। এমন সময় শত্রুদের একটি তীর তাঁর ঐ হাতে এসে বিধেঁ যায়।আব্বাস পানির পাত্রটি অপর হাতে নিলেন।এবার ঐ হাতটিকেও শত্রুদের তীর এসে কেটে দেয়। তারপরও তিনি যে-কোনো উপায়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন ইমামের তাঁবুর কাছে পানির মশক নিয়ে যেতে।তাই পানির মশকটি মুখে নিলেন। কিন্তু শত্রুদের তীর সেখানেও আঘাত হানে। এভাবে ইমাম হোসাইন (আ) এর সিপাহীদের পতাকাবাহী হযরত আব্বাস (আ) শাহাদাত বরণ করেন।
এভাবে ইমামের সন্তান আলী আকবার,হুর ইবনে ইয়াযিদ রিয়াহি,হাবিব ইবনে মাজাহের,ওহাব,কাসেম ইবনে ইমাম হাসান সবারই বীরত্বপূর্ণ এবং আনুগত্যপূর্ণ কাহিনীতে কারবালার ইতিহাস ভরপুর। এরকম নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গী-সাথীদের উদ্দেশ্যে ইমাম মোনাজাতে বলেছিলেনঃ ''আমি আমার সাথীদের মতো এতো ভালো ও উন্নত আর কোনো সঙ্গী দেখি নি। আমার সাথে সহযোগিতা করার জন্যে আল্লাহ তোমাদেরকে উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করুন। ''
আশুরা বিশেষ আলোচনা : বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহীদ
বিপ্লবী, কেননা ১০ ই মুহররম কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ) শাহাদাতের রক্ত বইয়ে দিয়ে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন,তা ছিল মহান এক বিপ্লব। যে বিপ্লবের তাৎপর্য উপলব্ধি করে কবি বলেছিলেনঃইসলাম যেন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ' অর্থাৎ প্রতিটি কারবালার পর ইসলাম তার প্রাণ ফিরে পায়। এখন তো বিশ্ব মুসলমানের জন্যে প্রতিটি দিনই আশুরা আর প্রত্যেক ভূ-খণ্ডই কারবালা। তাই ফিরে ফিরে আসে আমাদের সামনে ইমাম আলী (আ) এর সুযোগ্য উত্তরাধিকার ইমাম হোসাইন (আ) এর কারবালার ট্র্যাজিক বিপ্লবের স্মৃতি। যিনি ছিলেন শাহাদাৎকামিতা আর মানবিকতার মহান শিক্ষক। আমরা এই শিক্ষকের প্রদর্শিত আশুরা বিপ্লব নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।

ইরাকের মোসুল শহরের মুফতি আল-উবাইদি বলেছেন- 'মানবেতিহাসে কারবালা বিপর্যয় একটি বিরল ঘটনা।একইভাবে বিপর্যয়ের কারণগুলিও বিরল। হোসাইন ইবনে আলী (আ) জনস্বার্থ এবং মজলুমের অধিকার রক্ষা করার সুন্নাতকে নিজের দায়িত্ব বলে মনে করলেন এবং এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি কোনোরকম অলসতা করেন নি। তিনি কারবালার মহান ত্যাগের ময়দানে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। এ কারণে তিনি আল্লাহর দরবারে শহীদদের নেতা হিসেবে পরিগণিত হলেন এবং পৃথিবীর ইতিহাসে তাই তাকেঁ সংস্কারকামীদের নেতা বলে অভিহিত করা হয়।
বিশিষ্ট চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ ইদ্রিস হোসাইনী বলেছেনঃ একদিন আমার এক ঘনিষ্টজন আমার কাছে জানতে চাইলো কী কারণে আপনি আহলে বাইতের আদর্শ গ্রহণ করলেন? আমি বললামঃ 'ইমাম হোসাইন (আ) আশুরার দিনে তাঁর শাহাদাতের অপ্রীতিকর যে ঘটনা এবং দুঃখজনক যেসব দৃশ্যাবলি বিশেষ করে ইমাম ও তাঁর বংশধরদের সাথে যেসব আচরণ করা হয়েছে তা কোনো সুস্থ কিংবা হেদায়েতপ্রাপ্ত মানুষের চিন্তার পরিণতি হতে পারে না। নবীজীর আহলে বাইতের পবিত্র যে রক্তধারা কারবালার বালিকণার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তা কোনো মামুলি জলের প্রবাহ ছিল না। ঐ রক্ত ছিল এমন একজন শ্রেষ্ঠ ও অভিজাত ব্যক্তির যাঁর সম্পর্কে নবী (সা) বারবার প্রশংসা করেছেন। তাই এরকম একজন মানুষ কক্ষণো ভ্রান্ত পথে থাকতে পারে না এবং তাঁর হত্যাকারীরাও কোনোভাবেই সঠিক পথে থাকতে পারে না।'
ইমাম হোসাইন (আ) তাঁর পিতা ইমাম আলী (আ) এর মতোই ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মজলুমদের একজন। বর্তমানে আশুরা এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর স্মৃতিময় ইতিহাসকে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্মরণ করা হয়। এর কারণটা হলো মানুষ সবসময়ই স্বাধীনতাহীনতা এবং ন্যায়নীতিহীনতার মুখোমুখি হয়েছে এবং অত্যাচারীদের নির্যাতনে পিষ্ট হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ইমাম হোসাইন (আ) হলেন জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক, মুক্তি ও স্বাধীনতার ডাক প্রদানকারী এবং ন্যায়নীতির পতাকা বহনকারীদের প্রতীক। আশুরা ঘটনা বা ইতিহাস তাই নির্যাতিত,লাঞ্ছিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠিকে অত্যাচারী ও বলদর্পী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের মুক্তি ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রেরণা জোগায়। কেননা বিশ্বের স্বাধীনতাকামীদের মহান নেতার ওপর জুলুমের সেই ইতিহাস যতোই উচ্চারিত হবে ততোই মজলুমদের ন্যায়কামী আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতরো হবে,যার পরিণতিতে বলদর্পীদের প্রাসাদের ভিত্তিতে কম্পন সৃষ্টি হবে।
ইতিহাস সৃষ্টিকারী মহান ব্যক্তিত্ব ইমাম হোসাইন (আ) ৫৭ বছর জীবিত ছিলেন।মদীনায় রাসূলে খোদা (সা) এর পবিত্র সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন ছয় বছর। ত্রিশ বছর কাটিয়েছেন পিতা ইমাম আলী (আ) এর চড়াই-উৎরাইময় জীবনের সাথে। ভাই ইমাম হাসান (আ) এর শাহাদাতের পর দশ বছর উম্মাতের ইমামতির গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এই কয় বছরে তাঁর প্রজ্ঞা, বীরত্ব,মহত্ব এবং বাস্তববাদী চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ছিল লক্ষ্যনীয়।তবে মানব সমাজে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং বিখ্যাত হলেন আশুরা বা ঐতিহাসিক কারবালা ট্যাজেডির জন্যে।সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে আশুরার দিনে তিনি যে মহান আত্ম কোরবানী করলেন তা-ই তাকেঁ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহীদের মর্যাদায় ভূষিত করেছে। ইরানের বিশিষ্ট কবি ফুয়াদ কেরমানী বলেছেনঃ
শত্রুরা তোমাকে মেরেছে,কিন্তু নেভে নি তো নূর তোমার
হ্যাঁ,ওই নূর তো নেভার নয়,কেননা সে নূর যে খোদার ।
ইমাম হোসাইন (আ) এর যুক্তি অনুযায়ী জীবন মানুষের সম্মান ও মর্যাদার ওপর প্রতিষ্ঠিত এক অর্থপূর্ণ ও সুন্দর ব্যাপার। এই জীবনটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা বিশেষ দান। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মানবীয় পূর্ণতায় পৌঁছা। এই লক্ষ্যে পৌঁছার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো স্বাধীনতা এবং ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা। মানব সমাজের জন্যে ন্যায়নীতি এবং স্বাধীনতা হলো অক্সিজেনের মতো যা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। এরকম একটি সুষ্ঠু পরিবেশের জন্যেই তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করেছেন। সম্মানজনক মৃত্যুকে তিনি মহান সৌভাগ্যের বলে মনে করেন। ইমাম হোসাইন (আ) হলেন হযরত ইব্রাহিম (আ),হযরত মূসা (আ),হযরত ইসা (আ) এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর মতো বিখ্যাত নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকারী। তাঁরা সবসময় মানবীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোর জাগৃতির ব্যাপারে ছিলেন সৎ এবং ন্যায়ের মানদণ্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
তিনি তাঁর সুমহান আত্মাকে মানবতার মুক্তির জন্যে ওয়াক্‌ফ করে দিয়েছিলেন এবং মানুষের সমুন্নতির জন্যে সংগ্রাম করেছিলেন। এ বিষয়টি উপলব্ধি করে এক আরব কবি বলেছিলেনঃ
আত্মা যখন মহান হয়,দেহ তখন নিরুপায়
কিছুই করার থাকে না তার
কেবল আত্মার অনুসরণ করার।
কিন্তু ছোটো আত্মার লোকেরা কেবল দেহের পেছনে ছুটে বেড়ায়। বিবেক-বুদ্ধির তোয়াক্কা না করে দুর্দশার পেছনে ঘুরে বেড়ায় আর পরিণতি ভোগ করে নির্দ্বিধায়। এধরনের লোকেরা সর্বপ্রকার অন্যায়-অত্যাচার চালাতে দ্বিধা করে না।
ইসলামের সংস্কৃতিতে শাহাদাত হচ্ছে ইমানের নূরের দীপ্তির উৎস এবং জাতীয় জীবনোন্নয়নের চাবিকাঠি। এ কারণেই মানব সমাজ সত্য ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবসময় আত্মত্যাগী অর্থাৎ প্রাণ উৎসর্গকারী জনগোষ্ঠির প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছে। শহীদেরা নিজেদের রক্ত দিয়ে পরিবেশকে পবিত্রতা দেয় যাতে অন্যেরা সেই পবিত্র পরিবেশে বিকশিত হতে পারে এবং স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। শহীদেরা তাই মৃথ্যুকে ভয় পায় না এবং জেনেশুনেই শাহাদাতের পথ বেছে নেয়। ইমাম সাজ্জাদ (আ) বলেছেন , হোসাইন (আ) এবং তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারীগণ কারবালার ময়দানে ছিলেন নির্ভীক। তাদেঁর চেহারা উজ্জ্বল ছিল। তাদেঁর দেহের প্রতিটি অঙ্গ ছিল দৃঢ় ও অবিচল। তাদেঁর আত্মা বা প্রাণ ছিল প্রশান্ত। শত্রুরা তাদেঁরকে দেখে বলাবলি করছিলোঃ দেখো দেখো! হোসাইন মৃত্যুভয়ে বিন্দুমাত্র শঙ্কিত নয়।
সংঘর্ষ চলার কিছুক্ষণ পর উত্তপ্ত কারবালায় ইমাম পানির পিপাসায় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাই সামান্য থামলেন। শত্রুপক্ষের একজন এ সময় ইমামের দিয়ে একটি পাথর ছুড়েঁ মারলো। ঐ পাথরের আঘাতে ইমামের কপাল থেকে রক্ত ঝরছিল। ইমাম তাঁর জামা দিয়ে রক্ত পরিস্কার করছিলেন। এমন সময় নিষ্ঠুর হৃদয় একজন রাসূলে খোদার সন্তানকে লক্ষ্য করে তীর মারলো। তীর গিয়ে ইমামের বুকে বিধেঁ যায়। তাঁর পবিত্র দেহ থেকে দরদর করে রক্ত বইতে থাকে। ইমাম হোসাইন (আ) আকাশের দিকে মাথা তুলে বলেনঃ হে খোদা! তুমি জানো এই সেনারা এমন একজনকে হত্যা করছে যে ছাড়া এই পৃথিবীর বুকে রাসূলের আর কোনো সন্তান অবশিষ্ট নেই।  সূত্রঃ ইন্টারনেট
 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন