দোয়ার আদবসমূহ

দোয়ার আদবসমূহ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

 www.9ktenews.com

দোয়ার আদবসমূহ

 

         সব এবাদতের জন্যেই যেমন কিছু নিয়ম-কানুন আছে তেমনিভাবে দোয়ার জন্যও বিশেষ কিছু নিয়ম-কানুন আছে। নিম্নে দোয়ার আদবসমূহ বর্ণিত হল:

 

১- আল্লাহর নামে শুরু করা

যেকোন ভাল কাজই আল্লাহর নামে শুরু করা উচিত, তবে দোয়া তার মধ্যে অগ্রগণ্য।

মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন: যেসব দোয়ার প্রথমে "বিসমিল্লাহির রাহ্‌মানির রাহিম" থাকে, সেসব দোয়া ফেরৎ দেয়া হয় না।

(বিহারুল আনওয়ার, খঃ ৯০, পৃঃ ৪১৩।)

কোরআন মজিদ অধ্যায়ন করলে আমরা দেখতে পাই যে, নবি, ফেরেস্তা এবং আল্লাহর নেক বান্দাগণ দোয়ার সময় আল্লাহর নাম দ্বারা শুরু করতেন। যেমন:-

হজরত আদম ও হাওয়া (আঃ) নিম্নোক্তভাবে দোয়া করেন:

رَبَّنا ظَلَمْنا أَنْفُسَنا وَ إِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنا وَ تَرْحَمْنا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخاسِرين ‏

(তাঁরা উভয়ে বল্লেন:) হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজদের প্রতি জুলুম করেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি করুণা না করেন, তাহলে আমরা অবশ্য অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব।

(সুরা: আল আ'রাফ, ২৩।)

 

হজরত নুহ (আঃ) নিম্নোক্তভাবে দোয়া করেন:

رَبِّ اغْفِرْ لي‏ وَ لِوالِدَيَّ

হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে ক্ষমা করুন!

(সুরা: নুহ, ২৮।)

 

হজরত ইউসুফ (আঃ) নিম্নোক্তরূপে দোয়া করেন:

رَبِّ قَدْ آتَيْتَني‏ مِنَ الْمُلْك

হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন।

(সুরা: ইউসুফ, ১০১)

 

হজরত ইসা (আঃ) দোয়া করেন:

رَبَّنا أَنْزِلْ عَلَيْنا مائِدَةً مِنَ السَّماء

হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের জন্যে আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা প্রেরণ করুন!

(সুরা মায়েদা; 114)

উপরোক্ত আয়াতগুলো হতে বুঝা যায় যে, দোয়ার সময় আল্লাহকে ডাকার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত নাম হচ্ছে 'রব বা পালনকর্তা', যা দয়া ও করুণায় ভরপুর এবং মানুষের জীবনের সাথে সব সময় অতপ্রোতভাবে জড়িত।

 

২- বিনয়ের সহিত দোয়া করা

ক্রন্দন ও অনুনয়-বিনয় হচ্ছে দোয়ার সৌন্দর্য। দোয়ার মধ্যে যদি বিনীতভাব না থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে, দোয়াকারী আল্লাহর করুণার উপর নয় বরং তার নিজের উপর নির্ভরশীল।

পবিত্র কোরআন নিম্নোক্তভাবে দোয়া করার নির্দেশ দিচ্ছে:

ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعاً وَ خُفْيَةً إِنَّهُ لا يُحِبُّ الْمُعْتَدينَ

তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে কাকুতি-মিনতি সহকারে এবং সংগোপনে ডাক। তিনি সীমা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না।

(সুরা: আল্‌ আ'রাফ, ৫৫।)

 

৩- উচ্চস্বরে দোয়া না করা

উচ্চস্বরে দোয়া করা ঠিক নয়। কেননা দোয়াকারীর লক্ষ্য রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত নিকটেই আছেন এবং তিনি তাঁর বান্দার সব চাহিদা সম্পর্কে অবগত। আমরা দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট আমাদের চাহিদাগুলো উপস্থাপন করে থাকি। যেহেতু এটা তাঁরই নির্দেশ

তাছাড়া দোয়ার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহর নিকট হতে চাওয়াই নয় বরং এটা তাঁর নৈকট্য লাভের একটি পথ ও উত্তম এবাদতও বটে। পবিত্র কোরআন শরিফে এরশাদ হচ্ছে:

وَ اذْكُرْ رَبَّكَ في‏ نَفْسِكَ تَضَرُّعاً وَ خيفَةً وَ دُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَ الْآصالِ وَ لا تَكُنْ مِنَ الْغافِلينَ

আর স্বরণ কর স্বীয় পালনকর্তাকে আপন মনে, ক্রন্দনরত ও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় এবং উচ্চস্বর ব্যতিরেকে, নিম্নস্বরের সাথে, সকালে ও সন্ধ্যায়।

(সুরা: আল্‌ আ'রাফ, ২০৫।)

 

৪- নিজ গুনাহ্‌র স্বীকারোক্তি

দোয়ার আদবসমূহের একটি আদব হলো নিজ গুনাহ্‌র স্বীকারোক্তি প্রদান। গুনাহ্‌র স্বীকারোক্তি, মানুষের রুহকে আল্লাহর রহমত ও দয়ার নিকটবর্তী করে এবং তওবা করার পথকে সুগম করে। পবিত্র কোরআন শরিফে আমরা পড়ে থাকি যে, হজরত মুসা (আঃ) নিম্নোক্তভাবে দোয়া করেন:

 

رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسي‏ فَاغْفِرْ لي‏ فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحيم ‏

হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি; অতএব আমাকে ক্ষমা কর! অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।

(সরা: আল্‌ ক্বাসাস, ১৬।)

ইমাম সাদিক (আঃ) বলেন: দোয়াকারী ব্যক্তি প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করবে, অতঃপর নিজের ভুলস্বীকার করবে, তারপর নিজের প্রয়োজন উপস্থাপন করবে।

(বিহারুল আনওয়ার, খঃ ৯০, পৃঃ ৩১৭।)

 

৫- ভয় ও আশা

আমাদের এবাদতের কারণে এতটা তৃপ্ত হওয়া ঠিক হবে না যে, মনে করব আমিই সবচেয়ে উত্তমভাবে এবাদত করেছি। আমার এবাদতে কোনো ত্রুটি নেই। আমিই সবচেয়ে আত্মসংযমি মানুষ। আমার জীবনে কোনো দাগ নেই। এ ধরনের গর্বই পতনের মূল হয়ে দাঁড়াতে পারে।

পক্ষান্তরে এতটা নিরাশ হওয়াও ঠিক হবে না যে, নিজকে ক্ষমার অযোগ্য মনে করব এবং ধারণা করব, আমার দোয়া আল্লাহর নিকট কবুল হবে না! এ ধরণের হতাশা আমাদেরকে নিরুদ্বেগ করে ফেলবে এবং চেষ্টা হতে বিরত রাখবে। বরং 'ভয় ও আশা' পাখির দুই ডানার মত। এ দুই ডানা দ্বারাই আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করব। আল্লাহর রহমতের প্রতি আশা রাখব এবং নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতির ব্যাপারে ভীত হব। আমরা কোরআন শরিফে পড়ে থাকি:

وَ ادْعُوهُ خَوْفاً وَ طَمَعاً إِنَّ رَحْمَتَ اللَّهِ قَريبٌ مِنَ الْمُحْسِنين‏

আল্লাহকে ভয় ও আশা সহকারে ডাক, নিশ্চয়ই আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।

(সুরা: আল্‌ আ'রাফ, ৫৬।)

قُلْ يا عِبادِيَ الَّذينَ أَسْرَفُوا عَلى‏ أَنْفُسِهِمْ لا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَميعاً إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحيم

(হে রসুল!) আপনি বলুন! হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজের উপর জুলুম করেছ তারা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না! নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ্‌ মাফ করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।

(সুরা: আল্‌ যুমার, ৫৩।)

 

৬- আগ্রহের সহিত দোয়া করা

আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে দোয়া করা উচিত। দোয়ার সময় উদার্সিন ও অমনোযোগী থাকা ঠিক নয়। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে, প্রাচুর্যতা-অপ্রাচুর্যতায়, সুস্থতা-অসুস্থতায়, সুখে-দুঃখে সর্বদা ও সর্বাবস্থাতেই বিনয়ের সাথে দোয়া করতে হবে। দোয়া এমনই একটি এবাদত যার জন্যে কোনো নির্ধারিত সময় নেই। অনেকেই মনে করেন যে, দোয়া শুধু বিপদের সময়ের জন্যই নির্দিষ্ট। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। বরং দোয়া হচ্ছে প্রভুর সহিত বান্দার সংযোগ স্থাপনের একটি উন্নত মাধ্যম।

 

৭- 'আসমাউল হুসনা' পাঠ করা

'আসমাউল হুসনা'র (আল্লাহর সুন্দর গুণবাচক নামসমূহ) মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকা, দোয়ার অন্যতম আদব। যেমন: ইয়া ক্বাদেরু (হে সর্বশক্তিমান), ইয়া রাজ্জাকু (হে জীবিকাদানকারী), ইয়া আ'দেলু (হে ন্যায়বিচারক), ইয়া কারিমু (হে দয়ালু), ইয়া রাহিমু (হে দয়াবান) - ইত্যাদি।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে:

وَ لِلَّهِ الْأَسْماءُ الْحُسْنى‏ فَادْعُوهُ بِها وَ ذَرُوا الَّذينَ يُلْحِدُونَ في‏ أَسْمائِهِ سَيُجْزَوْنَ ما كانُوا يَعْمَلُون

আর আল্লাহর রয়েছে সর্বোত্তম নামসমূহ। কাজেই সে নাম ধরেই তাঁকে ডাক! আর ওদেরকে বর্জন কর, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। ওরা নিজদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে।

(সুরা: আল্‌ আ'রাফ, ১৮০।)

 

৮- দোয়ার সময় দু'হাত উত্তলোন করা

দোয়ার সময় দু'হাত উত্তলোন করে বিনয়ের সহিত আল্লাহর কাছে আবেদন করতে হবে। হজরত ইমাম হোসাইন (আঃ) বলেন: রসুলুল্লাহ (সাঃ) দোয়ার সময় এমনভাবে দু'হাত উত্তলোন করতেন, যেভাবে একজন মিসকিন খাদ্যের জন্যে আবেদন করে থাকে।

(বিহারুল আনওয়ার, খঃ ১৬, পৃঃ ৩৭৮।)

হজরত মুসার (আঃ) প্রতি এমর্মে ওহি নাযিল হয়: হে মুসা! বিনয়ের সহিত তোমার হাতদুখানি স্বীয় প্রভুর নিকট সেভাবে উত্তলোন কর যেভাবে গোলাম স্বীয় মনিবের নিকট বিলাপ ও বিনয়ের সহিত আবেদন করে।

(এদ্দাতুদ দায়ী, পৃঃ ১৮২।)

 

৯- মহানবি (সাঃ) ও তাঁর আহ্‌লে বাইতের উপর দরূদ পাঠ করা

রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: আমার উপর দরূদ পাঠ করলে তোমাদের দোয়া কবুল হয় এবং ইহা তোমাদের আমলের জাকাত স্বরূপ।

(বিহারুল আনওয়ার, খঃ ৯১, পৃঃ ৫৪।)

ইমাম আলি (আঃ) বলেন: সব দোয়াই আসমানের পর্দার আড়ালে থাকে; যতক্ষণ না মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর আহলে বাইতের উপর দরূদ পাঠ করা হয়।

(মিজানুল হেকমাহ্‌, হাদিস নং ৫৬২৬।)

 

১০- অজুর সহিত দোয়া করা  

যেহেতু দোয়াকারী ব্যক্তি দোয়ার সময় আল্লাহর সহিত আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, সেহেতু অজু করা এবং যেকোন প্রকার দৈহিক ও আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করা প্রয়োজন।

ইমাম সাদিক (আঃ) বলেন: যে ব্যক্তি অজুর সহিত দোয়া করে, সে খালি হাতে ফিরে না।

(বিহারুল আনওয়ার, খঃ ৯০, পৃঃ ৩১৪।)

 

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন